Media School

Dhaka    Thursday, 21 November 2024

By সজীব সরকার

সেক্স ও জেন্ডার : মৌলিক পার্থক্য

Media School May 15, 2024

একজন মানুষকে অন্তত দুই উপায়ে বা দুটি প্রেক্ষাপটে দেখার সুযোগ রয়েছে :

এক. মানুষটি কী ধরনের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মেছে; এবং
দুই. সমাজ তাকে কীভাবে দেখে বা তাকে কী হিসেবে দেখে।

প্রথম দৃষ্টিকোণটি হলো এমন, যেখানে একজন ব্যক্তির শারীরিক বা জৈবিক কিছু চিহ্ন বা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে তাকে নারী, পুরুষ বা ভিন্ন পরিচয়ে চিহ্নিত করা হয়। আর দ্বিতীয়টিতে ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয় পরিবার ও সমাজে চিরাচরিতভাবে তার কাছে প্রত্যাশিত ভূমিকার ভিত্তিতে।

অর্থাৎ, 'পুরুষ' শব্দটি শুনলে এর দুই রকম ব্যাখ্যা আমাদের মনে তৈরি হতে পারে : এক. একজন পুরুষ দেখতে কেমন বা তার শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো কেমন; এবং দুই. পরিবারে ও সমাজে ব্যক্তিটির ভূমিকাগুলো কী। একইভাবে, 'নারী' শব্দটি শুনলেও এমনই দুটি অবয়ব আমাদের মনে ফুটে ওঠে।

বিষয়টিকে উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যাক :

একজন পুরুষের যৌনাঙ্গ আর নারীর যৌনাঙ্গের গড়ন-গঠন আলাদা। সাধারণত পুরুষদের মুখ ও শরীরের অন্যান্য অংশে লোমের আধিক্য থাকে যা নারীর ক্ষেত্রে থাকে না। প্রজনন তথা সন্তান জন্মদান প্রক্রিয়ায় একজন পুরুষ ও একজন নারীর ভূমিকাতেও ভিন্নতা রয়েছে। শুধু নারীই নিজের গর্ভে সন্তান ধারণ করতে পারে এবং তাকে স্তন্যদান করতে পারে; জরায়ু, ডিম্বাশয় ও হরমোনের মতো নানা কারণে নারীদের এসব সক্ষমতা থাকে যা পুরুষদের থাকে না। সার্বিকভাবে, একজন নারী ও একজন পুরুষের শারীরিক গঠন দেখতেও অনেকটাই আলাদা হয়।

এমন বেশকিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একজন ব্যক্তিকে নারী বা পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। নারী ও পুরুষের বাইরে ভিন্নতর যারা আছে, তাদেরকেও এসব চিহ্নের বিচারেই আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়। মানুষে মানুষে জৈবিক এসব ভিন্নতা বা পার্থক্যই হলো 'সেক্স'।

এর বিপরীতে, পরিবার ও সমাজ বিভিন্ন সেক্সের মানুষের কাছে ভিন্নতর আচরণ ও ভূমিকা প্রত্যাশা করে। যেমন : পুরুষ চাকরি করে সংসারের খরচ যোগাবে, বাজার করবে, পরিবারের সব সদস্যের 'রক্ষকের' ভূমিকা পালন করবে; নারীরা সংসার সামলাবে, রান্না-ধোয়া-মোছা করবে, স্বামী-সন্তান ও আত্মীয়-পরিজনদের সেবা-যত্ন করবে - ইত্যাদি। এ ছাড়াও, সমাজ মনে করে, একজন পুরুষ আবেগবপ্রবণ না হয়ে বরং বাস্তববাদী ও কঠোর আচরণের হবে এবং এর বিপরীতে সমাজ মনে করে নারীরা আবেবপ্রবণ, ভীতু ও ঘরোয়া স্বভাবের হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, এ ধরনের বৈশিষ্ট্য 'সেক্স'-এর মতো জৈবিক, জন্মগত বা অনিবার্য-অপরিহার্য কোনো বৈশিষ্ট্য নয়; এর সবই সমাজ কর্তৃক আরোপিত। আর, সমাজ নির্ধারিত এসব পার্থক্যই হলো 'জেন্ডার'।

সেক্স ও জেন্ডার - দুটির ক্ষেত্রেই বাংলায় 'লিঙ্গ' শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তাই, বাংলায় আলোচনার ক্ষেত্রে 'লিঙ্গ' শব্দটি ঠিক কী অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি থাকা জরুরি।

তাহলে, সেক্স হলো মানুষের জন্মগত ও স্বাভাবিক কিছু বৈশিষ্ট্য বা এসব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কাউকে নারী, পুরুষ বা ভিন্নভাবে দেখার পার্থক্য। কিন্তু, জেন্ডার হলো মানুষের সমাজ-নির্ধারিত বৈশিষ্ট্য। এ কারণে, সব সময় সব সমাজে নারী বা পুরুষের ক্ষেত্রে তাদের সেক্স আইডেনটিটি (জৈবিক বৈশিষ্ট্য) অভিন্ন থাকলেও সমাজভেদে জেন্ডার আইডেনটিটি (সমাজ-নির্ধারিত পরিচয়) ভিন্ন রকম হয়ে থাকে।

বিশেষ করে ডেন্ডার ধারণার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, এটি কেবল নারী-পুরুষ (এবং এ দুয়ের বাইরে অন্যদের) মধ্যে পার্থক্যকেই নির্দেশ করে না, বরং একটি সমাজ কাঠামোর মধ্যে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বা সম্পর্কের বোঝাপড়ার দিকটিকেও নির্দেশ করে। জেন্ডার ধারণার মধ্যে একটি সমাজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ সার্বিক চিত্রের প্রতিফলন থাকে।

সেক্সের ধারণার সঙ্গে সবসময় জেন্ডারের স্বাভাবিক বা অপরিহার্য সম্পর্ক থাকে না। যেমন : জৈবিক বৈশিষ্ট্যের কারণে একজন পুরুষ কখনোই নিজের শরীরে সন্তান ধারণ করতে পারে না বা সন্তানকে স্তন্যদান করতে পারে না। এই পার্থক্য হলো সেক্স যা অপরিহার্য বা অনিবার্য। কিন্তু, এর মানে এই নয় যে একজন পুরুষ ভিন্নভাবে সন্তানের দেখাশোনা করতে পারবে না (যেমন : সন্তানকে ধোয়ানো-মোছানো)। অথচ, পরিবার ও সমাজব্যবস্থা এমন একটি অবস্থা বা রেওয়াজ তৈরি করে রেখেছে, যেখানে সন্তান জন্মের পরও সন্তানের সেবা-যত্নের সব দায়িত্ব মূলত নারীর ওপরই বর্তায়।

আবার, পরিবারে সাধারণত একজন নারী সদস্যই রান্না-বান্না বা ধোয়া-মোছার কাজগুলো করে; কিন্তু, এসব কাজ একজন পুরুষ করতে সক্ষম নয় - বিষয়টি এমন নয়। কেননা, সন্তানকে ধোয়ানো-মোছানো বা রান্নার সঙ্গে নারী বা পুরুষের জৈবিক কোনো অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যের সম্পর্ক নেই। দেশ-বিদেশে খ্যাতিমান অনেক শেফ পুরুষ। অনেক পরিবারেই পুরুষ সদস্যরা রান্না, সন্তানের দেখভাল বা ধোয়া-মোছার কাজগুলো আংশিকভাবে হলেও করে।

তাহলে, সেক্স জন্মগত ও তাই অপরিহার্য পার্থক্য হলেও জেন্ডার যেহেতু জন্মগত বৈশিষ্ট্য বা পার্থক্য নয়, তাই এসব ভূমিকা অপরিহার্য বা অপরিবর্তনীয়ও নয়। সুশিক্ষা ও সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে জেন্ডার বৈষম্য দূর করা গেলে জেন্ডার ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এসব ভূমিকাও অনেকখানিই বদলে যাবে।

এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে- সেক্স ও জেন্ডারের আলোচনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেবল নারী ও পুরুষ - এই দুই ধারণার মধ্যেই সীমিত থাকে। অথচ, এই দুই ধারণার বাইরেও আরো অনেক বৈশিষ্ট্যের-বৈচিত্র্যের মানুষ রয়েছে। সত্যিকার অর্থে জেন্ডার বৈষম্য থেকে মুক্ত একটি সমাজ গঠন করতে হলে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হলে সেই মানুষদেরও এ আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।