By সজীব সরকার
সংবাদমাধ্যম ও প্রকাশনার নানা ধরন
Media School May 17, 2024
প্রতীকী ছবি।
আগে সংবাদমাধ্যমের আলোচনায় আসা যাক।
প্রচলিত সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যমগুলোকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারের সুযোগ রয়েছে। কী ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে, প্রকাশিত পত্রিকার ক্ষেত্রে এর আকার কী, প্রকাশের উদ্দেশ্য কী বা কাদের জন্য প্রকাশিত হচ্ছে, প্রকাশকাল - এমন একাধিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে গণমাধ্যমকে নানা শ্রেণিতে ফেলা চলে।
শুরুতেই আসা যাক প্রযুক্তির প্রেক্ষাপটে। প্রথমেই গণমাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমকে এমন ৩টি ধারণায় ফেলা যেতে পারে :
১. মুদ্রিত মাধ্যম (প্রিন্ট মিডিয়া) : কাগজে ছাপা পত্রিকা, সাময়িকী ইত্যাদি
২. সম্প্রচার মাধ্যম (ইলেকট্রনিক বা ব্রডকাস্ট মিডিয়া) : রেডিও ও টেলিভিশন এবং
৩. অনলাইনভিত্তিক মাধ্যম : অনলাইন পত্রিকা বা ওয়েব পোর্টাল
মুদ্রিত তথা কাগজে ছাপা পত্রিকার ক্ষেত্রে কাগজের আকারভেদে পত্রিকাকে মূলত এমন ২টি ধরনে ফেলে বিবেচনা করা হতো :
১. ব্রডশিট : যেগুলো সাধারণত বড় আকারের কাগজে ছাপা হয়। যেমন : আমাদের সময়, সমকাল, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, প্রথম আলো, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ইত্যাদি পত্রিকা।
২. ট্যাবলয়েড : ব্রডশিটের চেয়ে ছোট আকারের কাগজে ছাপা পত্রিকা। যেমন : মানবজমিন, যুক্তরাজ্যভিত্তিক দ্য সান বা জার্মানির বিল্ড পত্রিকা।
পত্রিকার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য বা সাংবাদিকতার ধরনের ভিত্তিতে সংবাদপত্রকে সাধারণত এমন ২ ভাগে ফেলে বিবেচনা করার চল ছিলো :
১. মূলধারার সংবাদপত্র ও
২. ট্যাবলয়েড পত্রিকা
এখানে যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয়, তা হলো- মূলধারার সংবাদপত্র বলতে যা বোঝানো হতো, তা মূলত ব্রডশিটে অর্থাৎ বড় কাগজে ছাপা হতো। আর, এসব পত্রিকা মূলত বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যদিকে, ট্যাবলয়েড পত্রিকা ছাপা হতো ছোট আকারের (ট্যাবলয়েড সাইজ) কাগজে এবং এসব পত্রিকার সাংবাদিকতা মূলত ছিলো 'গসিপ', 'স্ক্যান্ডাল' বা 'সেনসেশনাল' খবর ছাপা। ট্যাবলয়েড পত্রিকার কাছে কেউ বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা আশা করতো না।
ব্রডশিট ও ট্যাবলয়েড - এ দুই ধরনের কাগজে পত্রিকা ছাপানোর আরেকটি উদ্দেশ্য ছিলো সহজেই পত্রিকার ধরন বা চরিত্র সম্পর্কে পাঠককে ধারণা দেওয়া। কাগজের আকার দেখে পাঠক বুঝে নিতে পারতেন, কোন পত্রিকার চরিত্র কেমন বা কোন পত্রিকা কী ধরনের খবর ছাপে। এতে পাঠকেরও নিজের পছন্দের ধরনের পত্রিকা বেছে নিতে সুবিধা হতো।
বিশেষ করে কম্পিউটার প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়া, পত্রিকার বাজারে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি বেড়ে যাওয়া এবং কাগজের ধরন ও মান অনুযায়ী এর সহজলভ্যতাসহ নানা কারণে এখন বিশ্বজুড়েই ব্রডশিট ও ট্যাবলয়েডের পত্রিকার চরিত্র সম্বন্ধে পুরনো ধারণাগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। যেমন : বাংলাদেশেই এমন অনেক পত্রিকা ব্রডশিট কাগজে ছাপা হচ্ছে যেগুলোকে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার উদাহরণ হিসেবে হয়তো গ্রহণ করা কঠিন। আবার, ট্যাবলয়েড আকারে ছাপা পত্রিকাও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করছে। এমনকি, এ দুই আকারের বাইরেও এখন আরো অনেক আকারের কাগজ পাওয়া যায় এবং সেসব কাগজে নানা ধরনের পত্রিকা বা সাময়িকী ছাপা হচ্ছে।
তাই, এখন আর কেবল কাগজের আকার দেখেই একটি পত্রিকাকে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণিতে ফেলে দেওয়াটা যৌক্তিক বা নির্ভরযোগ্য হবে না; কাগজের আকারের পাশাপাশি এর খবরের বিষয় নির্বাচন, খবর প্রকাশের ভাষা ও ছবিসহ সার্বিক ধরন এবং সাংবাদিকতার প্রবণতা - ইত্যাদি নানা বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।
প্রকাশকাল বা সময়ের চলকের ভিত্তিতে পত্রিকাকে এমন নানা শ্রেণিতে ফেলা যায় :
১. দৈনিক : প্রতিদিন যা ছাপা হয়
২. সাপ্তাহিক : সপ্তাহে একবার ছাপা হয়
৩. পাক্ষিক : পনেরো দিনে একবার ছাপা হয়
৪. মাসিক : মাসে একবার ছাপা হয়
৫. ত্রৈমাসিক : তিন মাসে একবার ছাপা হয়
৬. চতুর্মাসিক : চার মাসে একবার ছাপা হয়
৭. ষান্মাষিক : ছয় মাসে একবার ছাপা হয়
৮. বার্ষিক : বছরে একবার ছাপা হয়
দীর্ঘ বিরতিতে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোকে সাধারণ 'সাময়িকী' বলা হয়। যেমন : সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা, স্কুল-কলেজের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের 'বার্ষিকী', ব্যাংক-বীমাসহ সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের নানা রকমের প্রকাশনা, সংবাদপত্রের বিশেষ ক্রোড়পত্র ইত্যাদি। আরো রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাডেমিক বা গবেষণা জার্নাল।
এসবের বাইরে মুদ্রিত প্রকাশনার মধ্যে আরো রয়েছে সেমিনার-ওয়ার্কশপের তথ্য নিয়ে প্রকাশিত কাগজপত্র, নানা বিষয়ের তথ্যপত্র, পোস্টার, লিফলেট বা হ্যান্ডবিল, ব্রোশিওর ইত্যাদি প্রকাশনা। তবে, এগুলোকে সবসময় ঠিক 'গণমাধ্যম' হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না।
অনলাইন পত্রিকা বা ওয়েব পোর্টাল হিসেবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অনেক প্রকাশনা রয়েছে। এসবের বেশিরভাগই মূলত :
১. পুরোপুরি অনলাইন পত্রিকা
২. মুদ্রিত বা কাগজে ছাপা কোনো পত্রিকার অনলাইন ভার্সন
৩. কোনো রেডিও বা টিভি চ্যানেলের অনলাইন ভার্সন - ইত্যাদি।
এর বাইরে অন্যান্য অনলাইন-প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে ব্লগ, ভ্লগ, সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর (যেমন : ফেসবুক বা ইউটিউব) প্রকাশনা ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে কিছু রয়েছে যা প্রতিষ্ঠিত কোনো গণমাধ্যমের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, আবার কিছু পরিচালিত হয় ব্যক্তিগত উদ্যোগে। আর, বিশেষ করে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত এসব প্ল্যাটফর্ম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাংবাদিকতা চর্চা করে না; এখানে বরং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনার চর্চাই বেশি। যেমন : ফুড রিভিউ, ট্রাভেল ব্লগ - এ ধরনের প্ল্যাটফর্মকে কোনো বিচারেই গণমাধ্যম বা সাংবাদিকতার শ্রেণির মধ্যে আনা যাবে না।
আবার, প্রকাশস্থলের বা মাধ্যমটির আওতার ভিত্তিতে সংবাদপত্রকে এভাবেও দেখা হয় :
১. স্থানীয় : বিশেষ একটি এলাকা থেকে এবং উৎসের খুব কাছাকাছি এলাকার পাঠকদের জন্য প্রকাশিত
২. আঞ্চলিক : খানিকটা বড় পরিসরে প্রকাশিত
৩. জাতীয় : সারা দেশের খবর এবং সারা দেশের পাঠকের জন্য প্রকাশিত
৪. আন্তর্জাতিক : পুরো বিশ্বের খবর ও বৈশ্বিক পাঠকের জন্য প্রকাশিত
এ ছাড়াও সংবাদ সংস্থা বা নিউজ এজেন্সি বলে পরিচিত কিছু মাধ্যম আছে, যারা মূলত প্রচলিত ধারার অন্যান্য গণমাধ্যমগুলোর খবরের উৎস হিসেবে কাজ করে। যেমন : এপি, এএফপি ও রয়টার্স। বাংলাদেশে বাসস বা ইউএনবি। তবে, পাঠকের খবর পাঠাভ্যাসে এখন অনেক বদল ঘটেছে; অনেকেই এখন এসব সংস্থা বা এজেন্সির খবর সরাসরিই পড়েন। আবার, কিছু মাধ্যম সংবাদ সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম - দুভাবেই পরিচিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন : বিবিসি বা সিএনএন।
আরো অনেকভাবেই গণমাধ্যম বা এ ধরনের প্রকাশনাগুলোকে নানা আঙ্গিকে বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে।