Media School

Dhaka    Thursday, 26 December 2024

By সজীব সরকার

শিশুদের কার্টুন-ভিডিও গেইমেও কি যৌনতা আর সহিংসতা অপরিহার্য?

Media School May 17, 2024

গণমাধ্যমের রাজনৈতিক অর্থনীতির পক্ষপাতমূলক নীতির কারণে নারী শেষ পর্যন্ত `দৃশ্যবস্তু`ই হয়ে ওঠে।

নগ্নতা বা যৌনতা শ্লীল না অশ্লীল - এ লেখার আলোচ্য তা নয়। এখানে আলোচনা (আসলে প্রশ্ন) করতে চাই : শিশুদের জন্য নির্মিত কার্টুন বা ভিডিও গেইমগুলোতে নির্বিচার যৌনতা ও সহিংসতা কেন?

দেশি-বিদেশি টিভি চ্যানেলগুলোতে হরহামেশাই যেসব কার্টুন দেখানো হচ্ছে, সেগুলোতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যৌনতা বা যৌন উদ্দীপক দৃশ্য কিংবা বার্তার ছড়াছড়ি। 'টম অ্যান্ড জেরি' কিংবা 'অগি অ্যান্ড দ্য ককরোচেস'-এর মতো বিখ্যাত যেসব কার্টুন পৃথিবীজুড়ে শিশুরা দেখে বড় হচ্ছে, সেগুলোরও একই অবস্থা। নারী চরিত্রগুলোর শরীরকে যৌন-উদ্দীপক উপায়ে অঙ্কন ও উপস্থাপন করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে নারী চরিত্রের মুখমণ্ডল টিভির পর্দায় অনুপস্থিত রেখে 'নারী' হিসেবে ক্লোজ শটে প্রদর্শন করা হচ্ছে কেবল তার বক্ষদেশ বা নিতম্ব। বিপরীত লিঙ্গের ইঁদুর বা বেড়াল দেখে জেরি কিংবা টমের চোখ বের হয়ে আসে; দুই পাটি দাঁত দৃশ্যমান হয়- জিভ খুলে মাটি অবধি নামে।

বিপরীত লিঙ্গের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণের এমন বিকৃত ও লালসাপূর্ণ উপস্থাপন কোমলমতি শিশুমনে যৌনতার বিকৃত ও লালসাপূর্ণ অর্থবোধকতাই তো তৈরি করে। আর বিপরীত লিঙ্গের দুটি চরিত্র একসাথে হলে যে সেখানে প্রেম বা যৌনতাই দেখাতে হবে, এই নিয়ম কে করে দিয়েছে? বিপরীত লিঙ্গের দুজনের মধ্যে সরল বন্ধুত্ব কি দেখানো যায় না? বরং সেটিই তো করা উচিত! কৈশোর বা এর পরের বয়সীদের জন্য তৈরি করা অনুষ্ঠানে এ ধরনের সম্পর্কের উপস্থাপন করা চলতে পারে হয়তো, তবে সেটিও যথেষ্ট সতর্কতার সাথে এবং এমনভাবে করতে হবে, তারা যেন এসব অনুষ্ঠান থেকে মানবীয় সম্পর্কগুলো নিয়ে গুরুত্ব ও শ্রদ্ধার সাথে ভাবতে শেখে।

এ ছাড়াও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কার্টুনগুলোর আরেকটি উপজীব্য হলো সহিংসতা। নানা কৌশলে একজন আরেকজনকে কীভাবে জব্দ করবে ও পিটিয়ে শায়েস্তা করবে- পুরো স্টোরিলাইন হলো এই। পূর্বোক্ত টম অ্যান্ড জেরি, অগি অ্যান্ড দ্য ককরোচেস কিংবা লুনি টিউনস সিরিজের রোড রানার বা বাগস বানি-এর মতো বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কার্টুনগুলোর মূল উপজীব্যই পারস্পরিক সহিংসতা। একজন অন্যজনকে ভয়ঙ্কর সব উপায়ে মেরে ভর্তা বানাচ্ছে - এই থিমকে শিশুদের জন্য নিদারুণ আনন্দের খোরাক বানানো হয়েছে। অর্থাৎ শৈশব থেকেই এমন নিদারুণ সহিংসতাকে আনন্দের উপকরণ ও স্বাভাবিক হিসেবে নিতে শিখছে শিশুরা। ফলে শিশুরা নিজের জীবনেও সহিংসতাকে স্বাভাবিকভাবেই প্রয়োগ করতে শেখে খুব সহজেই।

ভিডিও গেইমগুলোর ক্ষেত্রেও নির্বিচার যৌনতা আর সহিংসতার কারণে একই হতাশা ব্যক্ত করতে হচ্ছে। বরং বলতে হবে, ভিডিও গেইমগুলো এ ক্ষেত্রে আরো অনেক বেশি সহিংস। এসব গেইমে নারী চরিত্রগুলোকে 'অতি-যৌন-উদ্দীপক' করে তোলা হচ্ছে। 'ইরোটিক' পোশাক আর যৌনতার ইঙ্গিতপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি যুক্ত করে নারী চরিত্রগুলোকে আপাদমস্তক 'যৌনসামগ্রী' করে তোলা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে শক্তিশালী নারী চরিত্র হিসেবে দেখানো হলেও 'ওয়ারিয়র প্রিন্সেস'-এর চরিত্র 'জেনা', 'টুম্ব রেইডার' সিরিজের লারা ক্রফট বা বিখ্যাত কমিক চরিত্র 'ওয়ান্ডার ওম্যান' - প্রত্যেকেরই পোশাক 'সেক্সুয়ালাইজড'। বিপরীত দিকে পুরুষ চরিত্রগুলো সবল-শক্তিশালী; অনেক ক্ষেত্রে এসব পুরুষ চরিত্র নারীর প্রতি সহিংস আচরণও করছে। জনপ্রিয় 'জিটিএ' গেইমের একটি ভার্সনে পুরুষ চরিত্রগুলো নারী চরিত্রগুলোকে প্রকাশ্যে যৌন নির্যাতন (ধর্ষণ) করতে পারে এবং এই নির্যাতনের ধরন আবার ইচ্ছেমাফিক 'কাস্টমাইজ' করা যায়।

গেইমের বিষয়টি এখানেই সীমিত নেই; 'ভিডিও গেইম' নাম দিয়ে রিলিজ করা হয়েছে অনেক পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট যেখানে একজন 'গেমার' নিজের পছন্দমতো নারীচরিত্রগুলোকে (শরীরের কোনো অঙ্গের/অংশের আকার বা শারীরিক কাঠামো) কাস্টমাইজ করতে পারে এবং পুরুষ চরিত্রটি দিয়ে ওই নারী চরিত্রটির সঙ্গে ইচ্ছেমাফিক যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এসব 'গেইমে' জোর প্রয়োগ করে যৌনতার পাশাপাশি যৌনতায় গেমারের পছন্দমাফিক নানা প্রকারের সহিংসতা যুক্ত করারও অপশন থাকে।

নারী নির্যাতন বা যৌন সহিংসতার প্রশ্নে পশ্চিম-পূর্ব কিংবা সভ্য-অসভ্য দেশ বলে খুব পার্থক্য নেই; সব সমাজেই নারীরা নানা উপায়ে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। একদিকে অ্যাকাডেমিক পরিমণ্ডলে যেখানে জেন্ডার সচেতনতা বাড়িয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা কমানোর প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে, অন্যদিকে আবার শৈশবেই নারীর প্রতি সহিংসতা ও ভোগলিপ্সার দীক্ষা নিয়ে সামাজিকীকরণ হচ্ছে এসব ভিডিও গেইম আর কার্টুনগুলোর মাধ্যমে। শিশুদের জন্য নির্মিত অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রগুলোতেও যে এমন উদাহরণ একেবারে নেই - তা বলা যায় না।

শিশু ছাড়া অন্য বয়সীদের জন্য নির্মিত নাটক-সিনেমা-মিউজিক ভিডিও - কোনটি বাসায় শিশুদের সামনে চালিয়ে দেখার উপযোগী? টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে আগে বিশেষ করে বিদেশি চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সংবেদনশীল কোনো দৃশ্য (সহিংসতা বা নগ্নতা/যৌনতা) কেটে বাদ দেওয়া হতো। কিন্তু এখন অনেক ক্ষেত্রেই আর তা করা হয় না; একাধিক চ্যানেলেই দেখা যায়, সেসব দৃশ্য বজায় রেখেই চলচ্চিত্রগুলো সম্প্রচার করা হচ্ছে। এ ছাড়াও সস্তা বাজেটের এবং রুচি বিবর্জিত ও মানহীন তথাকথিত পপুলার সিনেমা - যেগুলোর মূল উপকরণই নগ্নতা, যৌনতা ও সহিংসতা - সেগুলোও টিভিতে নির্বিচারে সম্প্রচার করা হচ্ছে।

নগ্নতা বা যৌনতা জীবনেরই অংশ; এটি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার রক্ষণশীলতা বা ট্যাবুর বাড়াবাড়ি কখনোই নেই। কিন্তু কথা হলো, গণমাধ্যম কখনোই শতভাগ স্ক্রিনিং করতে পারে না- কে তার দর্শক। তাই নাটক-সিনেমা-গান - নির্বিচারে সব আধেয়তে শরীরসর্বস্বতা বা যৌনতার অকারণ উপস্থাপন শিশুদের মনের ওপর কী প্রভাব ফেলে - গণমাধ্যমগুলোর (বিশেষ করে এসব আধেয় নির্মাতাদের) তা ভেবে দেখা উচিত। বর্তমান সময়ে জীবনের অপরিহার্য অংশ হিসেবে গণমাধ্যম সামাজিকীকরণের অন্যতম শক্তিশালী 'এজেন্ট' হয়ে উঠেছে। তাই সমাজকে তারা কী বার্তা দিচ্ছেন এবং শিশুরা কী ধরনের সামাজিকীকরণের সংস্পর্শে আসছে - এই দিকটি উপেক্ষা করলে এর পরিণতি কী হয়, তা কিন্তু আমাদের সবারই জানা।

পরিণত দর্শকদের বেলায় বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কোনো আধেয়তে যৌনতা বা নগ্নতা গল্পের প্রয়োজনে থাকতেই পারে; কিন্তু কেবল দর্শক টানতে নগ্নতা বা যৌনতার ছড়াছড়ি - যা এখন ব্যবসার সবচেয়ে বড় 'পুঁজি' হয়ে উঠেছে - এর থেকে শিশু-কিশোররা রেহাই পাচ্ছে না। আর অপরিণত বয়সে এসব আধেয় তাদের মনের ওপর যে চাপ তৈরি করছে এবং যেভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, সমাজে নারীর প্রতি বিদ্বেষ ও সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে তা বড় ভূমিকা রাখছে। যোগাযোগবিদ, গণমাধ্যম গবেষক ও তাত্ত্বিক জর্জ গার্বনার (১৯১৯-২০০৫) টেলিভিশনের আধেয় নিয়ে তার বিখ্যাত গবেষণার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত 'কালটিভেশন' তত্ত্বে অনেক আগেই দেখিয়েছিলেন, গণমাধ্যম আধেয়তে সহিংসতার উপস্থাপন অডিয়েন্সের ওপর কতোটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তাই, একটি সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের জন্য গণমাধ্যমের আধেয়তে অকারণ যৌনতা, শিশুর প্রতি সহিংসতা, নারীর প্রতি সহিংসতা ও সর্বোপরি মানুষের প্রতি মানুষের সহিংসতা - এমনসব অসংবেদনশীল বার্তার ঢালাও উপস্থাপন বন্ধ করা দরকার। এর বিপরীতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সব মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বার্তা যোগ করা উচিত। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং বিপরীত লিঙ্গের মানুষদের মধ্যে সরল বন্ধুত্ব আর নির্মল প্রেম - উভয়ই উপস্থাপন করা দরকার। মানবিক সম্পর্কগুলোর ব্যাপারে ইতিবাচক ও নান্দনিক ভাবনার স্ফূরণ ঘটে এবং পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধন আরো মজবুত হয় - এমন বার্তা দেওয়া দরকার।

বিশ্বব্যাপী সব সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ও সহিংসতা এখনকার দিনে অন্যতম বড় সঙ্কট হয়ে উঠেছে। এর পেছনে গণমাধ্যমের এমন নেতিবাচক ভূমিকা অনেকখানিই দায়ী। গণমাধ্যমগুলোকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। সব দেশেই সম্প্রচার নীতিমালার আধুনিকায়ন দরকার।

আধুনিকতা যথাক্ষেত্রে নগ্নতা বা যৌনতাকে স্বাভাবিক ও সহজভাবে গ্রহণ করতে শেখায়; আধুনিকতা মানে কেবলই নগ্নতা ও যৌনতানির্ভর হয়ে ওঠা না। সহিংসতা ছাড়াও শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা করা সম্ভব। গণমাধ্যমগুলোকে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা, যা এই লেখার মূল লক্ষ্য- শিশুদের মনকে কলুষিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়; মুনাফার অজুহাতেও নয়, আধুনিকতার অজুহাতেও নয়। যৌনতা ও সহিংসতা সম্পর্কে অকারণ রাখ-ঢাক যেমন ঠিক নয়, তেমনি এর অকারণ-নির্বিচার প্রদর্শনও ভালো কথা নয়।

শিশুদের নির্মল মনকে নিষ্কলুষই থাকতে দিন! যৌনতা ছাড়াও যে নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্কের ভিন্ন কোনো ভিত থাকতে পারে, তা তাদের শিখতে দিন। সহিংসতা বিনোদন তো নয়ই এবং তা 'গ্লামারাস' কোনো বিষয়ও নয় - এই সত্য তাদের শিখতে সুযোগ করে দিন। এর ভিন্ন কিছু শেখালে পুরো দায় সমাজকেই নিতে হবে এবং ভুক্তভোগীও হবে গোটা সমাজ।

*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় টকঅবদ্যটাইম ডটকম-এ, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। সম্পাদকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।