By আহমেদ জাভেদ
শিক্ষায় বিচ্ছিন্নতা বনাম বিচ্ছিন্নতার শিক্ষা
Media School January 21, 2022
প্রতীকী ছবি।
বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যাচর্চার গুণমানের অবনমিত অবস্হা সম্পর্কে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। সম্ভবত এ কারণেই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের জ্ঞানী-গুণীজনের এ দেশে আসা-যাওয়া কম—যা প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য দেশে আমাদের ঠিক বিপরীত চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। জ্ঞানের মহাসড়কের সঙ্গে বাংলাদেশের বিযুক্ততা জ্ঞানের গুণগত অভাবের দিকেই ইঙ্গিত দেয়।
বিদ্যাচর্চার রূপান্তর ক্ষমতা প্রচণ্ড। শিক্ষার এই রূপান্তরের দিকটির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এ কারণেই তিনি ভারতের উন্নতির জন্য শিক্ষাকে সবচেয়ে শক্তিশালী ও কার্যকর পদ্ধতি মনে করতেন। শিক্ষার গুণমান বৃদ্ধির মাধ্যমে তিনি সমগ্র ভারতবর্ষের সমাজকে আলোকিত করতে সচেষ্ট হন। তার প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন ও বিশ্বভারতী আন্তর্জাতিক পর্যায়ের চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের জন্ম দিয়েছে।
নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ল্যামন্ট ইউনিভার্সিটি প্রফেসর হিসেবে অর্থনীতি ও দর্শন বিভাগে কর্মরত। এই জগদ্বিখ্যাত মানুষটি শান্তিনিকেতন বিদ্যাপীঠেরই ছাত্র। সম্প্রতি তার আত্মজীবনী ‘হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড : আ মেমোয়ার’ (‘স্মৃতিকথা : ঘরে-বাইরে’) গ্রন্থে শান্তিনিকেতনে তার ১০ বছরের শিক্ষাজীবনের অভিজ্ঞতার কথা খুব সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেছেন। অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের ভাষায় : সেখানে শিক্ষার অভিমুখটি ছিল সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দেশগুলোর শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে ছাত্রছাত্রীর পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ছাত্রছাত্রীর মনে সত্যিকারের বিশ্ববীক্ষার উদ্বোধন ঘটানো।
শান্তিনিকেতনে যে বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হতো, সেটি হলো শিশুদের মনকে কৌতূহলী করে গড়ে তোলা। শান্তিনিকেতন শিশুর কৌতূহলকে তার কল্পনার সঙ্গে যুক্ত করে নিজেকে বিকশিত করতে শেখায়। শান্তিনিকেতন তার শিক্ষার্থীর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতায় নিপুণভাবে তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে চলত না। ফলে, শান্তিনিকেতনে পরীক্ষায় ভালো ফল করার চাপ ও ভালো গ্রেড অর্জনের অভিমুখী করে শিক্ষার্থী তৈরি করা হতো না। কেবল তা-ই নয়, বরং এহেন প্রতিযোগিতার প্রতি বিদ্যার্থীদের যথেষ্ট নিরুত্সাহিত করা হতো। শান্তিনিকেতনের উন্মুক্ত গ্রম্হাগারের বইয়ের তাকে থরে থরে সাজানো গ্রন্থগুলো যেন ছিল আশায় ঘেরা এক সমৃদ্ধ পৃথিবী। স্কুলের পরীক্ষায় আমি ভালো ফল না করায়, আমি আমাকে নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট ছিলাম।
শিক্ষার এই ধারাটিই বৈশ্বিক জ্ঞানের মহাসড়ক। রবীন্দ্রনাথ তার সব রচনায় শিক্ষার এই অন্তভুর্ক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির দর্শনই ছাত্রছাত্রীর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিশ্বসভ্যতার এই একক বৃক্ষটি সমগ্র মানবজাতির বহু বছরের অভিজ্ঞতা ও শ্রমসাধনায় তিলে তিলে গড়ে উঠেছে। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত মানুষ জন্মেছে এবং যত ধরনের সম্প্রদায় এসেছে তারা পরস্পর আদান-প্রদানের মাধ্যমে পরস্পরের কাছ থেকে যা-কিছু শিখেছে তার সবটা মিলে এই বিশ্বসভ্যতা গড়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ এই বিশ্বসভ্যতাকে ভারতের অভিজ্ঞতায় ধারণ করার জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে এই ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে, জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার এই বিনিময়ের মাধ্যমে বিশ্বসভ্যতা বিভিন্ন জায়গায় তার শেকড় ও শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে দিয়েছে। এই বিশ্বসভ্যতাই নানা ধরনের বৈচিত্র্যময় ফুল ফুটিয়ে পৃথিবীকে বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।
বাংলাদেশে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিমুখটি রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের শিক্ষাপদ্ধতির একেবারে বিপরীত। আমাদের শিক্ষার্থীর মধ্যে বিশ্ববীক্ষা সৃষ্টির পথটি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা হয়েছে। খুব কম শিক্ষকই এমন আছেন, যিনি নিজে তার জীবনে বিশ্ববীক্ষার ধারণা লালন করেন। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, বিশ্ববীক্ষা তো বহু দূরের বিষয়, শিক্ষার্থীর কাছে খোদ বাংলাদেশই অনুপস্হিত। অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বাংলাদেশে বাংলাদেশই অনুপস্হিত।
উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশ প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের ধারণা আয়ত্ত করার পর অন্তত আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশের শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির সঙ্গে পরিচয় সেরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি জানা তো সুদূরপরাহত বিষয়। বিশেষ করে, আমাদের দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশের বড্ড অভাব অথবা প্রায় নেই বললেই চলে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের জন্ম একটি প্রগতিশীল বড় ঘটনা হলেও ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে তা উল্লেখ করা হয়নি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মনে নিজের মাতৃভাষা বাংলার প্রতি কোনো মমত্ব বা মর্যাদা নেই। মাতৃভাষার বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী আত্মত্যাগী মানুষের কথা কিছু কিছু অতি সম্প্রতি স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে যুক্ত হলেও সেগুলোর অনেকগুলো ভয়ানকভাবে অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত, অনাকর্ষণীয় ও ভুলে ভরা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী উপস্হাপনা অনাকর্ষণীয় হওয়াতে শিক্ষাথীর্রা সেখান থেকে অনুপ্রাণিত হচ্ছে না।
আর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলাদেশ ও জাতির জনকের কথা হাতে গোনা কয়েকটি বিষয় ছাড়া অন্য সব জায়গায় অনুপস্হিত। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমাদের সিলেবাসে বা পাঠ্যক্রমে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতির পিতার অবদান উপেক্ষিত। সুতরাং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় যেসব স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সনদ দিয়ে যাদের বের করছে, তারা বাংলাদেশের প্রয়োজন ও শক্তির জায়গা শনাক্ত করতে পারছে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্হা ভয়ানকভাবে ‘এলিয়েনেটেড বা বিচ্ছিন্ন’।
শিক্ষার এই ‘বিচ্ছিন্নতা’র প্রভাব একজন শিক্ষার্থীর জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এ দেশের সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাস বিচ্ছিন্ন ছাত্রছাত্রী তাদের কর্মজীবনে ও পরিণত বয়সে শিক্ষাজীবনের এই মারাত্মক ক্ষত শিগগিরই কাটিয়ে উঠতে পারে না। তদুপরি তারা সভ্যতা সম্পর্কে ‘খণ্ডিত’ দৃষ্টিভঙ্গি সহজেই গ্রহণ করে বাছবিচার ছাড়াই। এই ‘খণ্ডিত’ দৃষ্টিকোণটির আওতায় পৃথিবীর সবকিছুকে দেখার পদ্ধতি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও খণ্ডিত। এই দৃষ্টিভঙ্গি মতে, বিভিন্ন সময়ের সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও তার প্রকাশভঙ্গিকে আলাদা আলাদা সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করে। এই ধারার ব্যাখ্যায় বিভিন্ন সময়ের সভ্যতার অংশগুলোর মধ্যে প্রতিকূল সম্পর্ক দেখানো হয়—যেখানে তারা পরস্পর মুখোমুখি সংঘাতময় অবস্হানে দাঁড়িয়ে থাকে। বর্তমান সময়ে এই দৃষ্টিভঙ্গিটি বেশ প্রচলিত—যেটি ‘সভ্যতার সংঘাত’ নামে আমাদের সামনে আত্মপ্রকাশ করেছে।
বিদ্যায়তনিক পরিসরের শিক্ষার এই ‘বিচ্ছিন্নতাবোধের চর্চা’ ও সভ্যতাসংক্রান্ত ‘খণ্ডিত’ দৃষ্টিভঙ্গি মিলেমিশে একাকার হয়ে আমাদের দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিকতার চর্চায় এসে পড়ে। এর প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখতে পাই সবকিছুকে আপেক্ষিক ধারণা হিসেবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। এই ‘চর্চা’কে আমরা ‘সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বলতে পারি। ঘটনা হলো, এক সংস্কৃতির বিতর্ক ও যুক্তি অন্য সংস্কৃতির ওপর প্রভাব পড়ে। পারস্পরিক এই আদান-প্রদানকে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতাবাদীরা গ্রহণ করতে চান না।
তারা ‘নিজস্বতা’ ও ‘বিশুদ্ধতা’র মেকি দাবি তোলেন। উত্তরাধুনিকতাবাদ, উত্তর-উপনিবেশবাদ এবং এই ধরনের সমগোত্রীয় অনেক তত্ত্বচর্চা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির মহলে গত কয়েক দশক ধরে বেশ পোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক একধরনের বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেখানেও উপরিউল্লিখিত সমস্যাই ঘুরেফিরে আসে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও আর্থসামাজিক অবস্হান ও অবস্হা সেখানে বিবেচ্য নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার ইতিহাস ও মনন সে চিন্তায় অনুপস্হিত।
অর্থাৎ বাংলাদেশ সেই বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হলো ধর্মীয় উগ্রবাদ ও স্বাধীনতাবিরোধীরা মিলেমিশে একাকার। ফলে বাংলাদেশ সামনের দিকে কীভাবে এগোতে পারে, তার সম্ভাবনা কীভাবে কাজে লাগাতে পারে আর বাধাগুলো কীভাবে অতিক্রম করতে পারে—সে বিবেচনা তাদের চর্চায় একেবারে অনুপস্হিত। বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম দিয়ে দেশের প্রগতির পথে অবদান রাখার কথা তারা কখনই মনে আনেন না।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ‘বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি।
*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক ইত্তেফাক-এ, ২০ জানুয়ারি ২০২২। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।