Media School

Dhaka    Thursday, 21 November 2024

By রাজীব সরকার

যতীন সরকার : সাঁকো বাঁধার নিপুণ কারিগর

Media School June 30, 2020

সাহিত্যসাধনার সঙ্গে যতীন সরকার যুক্ত করতে চেয়েছেন প্রাকৃতজন তথা গণমানুষের চৈতন্যকে। ছবি : সংগৃহীত।

'প্রবন্ধ' শব্দটির অর্থ প্রকৃষ্টরূপে বন্ধনযুক্তি-আশ্রয়ী চিন্তাগুলোর মধ্যে যখন প্রকৃষ্ট বন্ধন রচিত হয়, তখন তা প্রবন্ধে রূপান্তরিত হয়মননশীল সাহিত্যের প্রধান শাখা প্রবন্ধআধুনিক বাংলা সাহিত্যে সৃজনশীল রচনার যে সম্ভাবনা বিকাশ দেখা যায়, মননশীল রচনার ক্ষেত্রে তা অনুপস্থিতপ্রবন্ধসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় অনগ্রসরইংরেজি, ফরাসি, জার্মান বা স্প্যানিশ প্রবন্ধের তুলনায় বাংলা প্রবন্ধসাহিত্য দুর্বলএসব পাশ্চাত্য ভাষায় বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ে এমনসব প্রবন্ধ বই রচিত হয়েছে, যা শুধু বিষয়বস্তুর গুণে নয়, রচনাশৈলীর গুণেও সাহিত্যপদবাচ্যবাংলা সাহিত্যে মৌলিক চিন্তাসম্পন্ন মননশীল প্রাবন্ধিক দুর্লভসেই দুর্লভ প্রাবন্ধিকদের অন্যতম যতীন সরকার

প্রাবন্ধিক যতীন সরকার বাঙালি বিদ্বৎসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ১৯৬৭ সালে 'পাকিস্তানোত্তর পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা উপন্যাসের ধারা' নামে একটি প্রবন্ধ লিখেএজন্য বাংলা একাডেমি থেকে 'ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক' স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনিদৈনিক পত্রিকায় সাহিত্যপত্রে গভীরতাস্পর্শী প্রবন্ধ নিয়মিত লিখে চললেও তাঁর প্রথম বই 'সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা' প্রকাশিত হয় বেশ বিলম্বে, ১৯৮৫ সালে, যখন তাঁর বয়স পঞ্চাশপ্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেধাবী সাহিত্য-সমালোচক হিসেবে তিনি দুই বাংলাতেই খ্যাতি অর্জন করেনএরপর একে একে প্রকাশিত হয় তাঁর মূল্যবান প্রবন্ধের সম্পাদিত বইএর বাইরে তাঁর অনন্য স্মৃতিকথা 'পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন' 'পাকিস্তানের ভূতদর্শন' পাঠকসমাজে বিপুলভাবে অভিনন্দিত হয়েছেশিক্ষার্থীদের জন্য ব্যতিক্রমী বই 'গল্পে গল্পে ব্যাকরণ' 'ব্যাকরণের ভয় অকারণ' উচ্চপ্রশংসিত হয়েছেপ্রাবন্ধিক যতীন সরকারের সীমানা তাই সুদূরবিস্তৃত - সাহিত্য, ধর্ম, সংস্কৃতি, শিক্ষা, দর্শন, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতিবিষয়ক আলোচনায় সমৃদ্ধ তাঁর ঈর্ষণীয় সৃষ্টিভাণ্ডার

যে-কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তিরই জীবনদর্শন থাকেমহৎ শিল্পী বা লেখকও এর ব্যতিক্রম নননিজের জীবনদর্শনকে মূর্ত করে তোলা যতীন সরকারের প্রবন্ধের শিরোনাম 'আমি অদৃষ্টে বিশ্বাসী, নিয়তিবাদী বিজ্ঞানসচেতন'। তিনি দ্বান্দ্বিক ঐতিহাসিক বস্তুবাদে বিশ্বাসী, যা মার্কস-অ্যাঙ্গেলসের চিন্তার সংহত রূপবিচার-বিশ্লেষণহীন মার্কসবাদী তিনি ননপ্রকৃতি সমাজের দ্বান্দ্বিকতা, ইতিহাসের বিচিত্রবিধ গতি এবং ব্যক্তিমানুষের চিন্তা কর্মের বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব সম্পর্কে তিনি সচেতনপারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে বাদ প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে তত্ত্বের বোধ গড়ে ওঠার প্রাচীন ভারতীয় ন্যায়সূত্র তিনি কৈশোরেই চেতনায় ধারণ করেছিলেনযৌবনে মার্কসীয় সাহিত্যপাঠ এবং নিবিড় অনুশীলন তাঁকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের অনুসারী হতে প্রেরণা জোগায়প্রথাগত মার্কসবাদীদের মতো ধর্মচর্চাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখেননি, অস্বীকার করেননি সভ্যতার অগ্রগতিতে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার প্রগতিশীল অবদানকেতিনি আস্থা রেখেছেন বিপ্লবী লেনিনের কথায়সমকালীন মার্কসবাদীদের অনেকেই যখন টলস্টয়কে 'বুর্জোয়া' আখ্যা দিয়ে বর্জন করতে চেয়েছিলেন তখন লেনিন বলেছিলেন, 'কোনো শিল্পী যদি প্রকৃতই মহৎ হন তবে তাঁর রচনায় বিপ্লবের কোনো না কোনো মর্মগত অংশ প্রতিফলিত না হয়ে পারে না।' তাই ভাববাদী হওয়ার পরও রবীন্দ্রনাথের মতো মহত্তম শিল্পী যতীন সরকারের মানসগুরুতিনি বিশ্বাস করেন-

"সঠিক কর্ম সম্পাদনের জন্য সঠিক তত্ত্বের আশ্রয় অবশ্যই নিতে হবে, কিন্তু কোনো পুরনো তত্ত্বই নতুন সমস্যার ক্ষেত্রে হুবহু প্রযুক্ত হতে পারে না; সে-কারণেই প্রতিনিয়ত পুরনো তত্ত্বের পুনর্গঠন নবায়ন করে নিতে হবে, নতুন পরিস্থিতিতে উপজাত সমস্যা সমাধানের সূত্র নিজেকেই আবিষ্কার করে নিয়ে ধীরতার সঙ্গে কর্তব্য সম্পাদনে ব্রতী হতে হবে।"

এই বোধ থেকেই তিনি ঐতিহ্য আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়েছেনপাভলভ-প্রবর্তিত মস্তিষ্কভিত্তিক মনোবিজ্ঞানের কুশলী প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি মধ্যবিত্ত, কৃষকসহ প্রাকৃতজনের জীবনধারার নানা জটিল স্তরে আলোকপাত করেছেনউন্মোচন করেছেন আমাদের রাজনৈতিক সামাজিক ইতিহাসের বহুবিধ জটতাঁর ঐতিহ্যনিষ্ঠা মুক্তবুদ্ধি, বস্তুবাদ সমাজতন্ত্রের দেশীয় প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আমাদের সচেতন করেছেগভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি অবলোকন করেছেন বাঙালির লৌকিক সংস্কৃতিকেবস্তুবাদী অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা আমরা পশ্চিম থেকে পেয়েছি - প্রচলিত ধারণাকে তিনি খারিজ করে দিয়েছেনতিনি দেখিয়েছেন, প্রাচ্যেও অতীতে এর চর্চা ছিল ভূখণ্ডের মানুষের লোকায়ত জীবনদর্শনে ভাববাদ যেমন ছিল, তেমনি ছিল বস্তুবাদেরও প্রভাবসত্য, ন্যায়, সাম্যের ধারণা এদেশে ছিলএখানেই জন্মগ্রহণ করেছেন শ্রীচৈতন্য, গৌতম বুদ্ধ, চার্বাক

চিন্তা যুক্তির ঈর্ষণীয় ভারসাম্য বজায় রেখেছেন যতীন সরকারপ্রচলিত, জনপ্রিয় মতের বিরোধিতা করতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। 'পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা' কবি হিসেবেই ইকবালের পরিচিতিতাঁর সাহিত্যিক প্রতিভা আড়ালে চলে গিয়েছিল ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের ডামাডোলে১৯৭৮ সালে গণসাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হলো তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধ 'ইকবাল আমাদের'। এটি এমন একসময় যখন বাংলাদেশে পাকিস্তানবাদী ভাবধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলছেশুধু তাই নয়, প্রবন্ধটির লেখক অমুসলিম যতীন সরকারসবাইকে বিস্মিত করে তিনি লিখলেন পাকিস্তানের সৃষ্ট 'মানস-প্রতিবন্ধ' থেকে মুক্ত হয়ে 'সুষ্ঠু' 'সংস্কারবর্জিত' ইকবালচর্চা 'আমাদের নিজের গরজেই আবশ্যক'। তাঁর পর্যবেক্ষণ-

"সমস্যা মোকাবেলার একটি কার্যকর পথ হিসেবে ইকবালের দ্বারা যেমন ইসলামী ঐতিহ্য নির্বাচিত, অন্য কোনো কবির দ্বারা তেমনি নির্বাচিত হতে পারে অন্য কোনো ঐতিহ্য বা দর্শন; যেমন রবীন্দ্রনাথের অবলম্বন সাধারণভাবে 'হিন্দু দর্শন' 'হিন্দু ঐতিহ্য' নামে যা পরিচিত, সেই ঔপনিষদিক তথা প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যতাই বলে, রবীন্দ্রনাথের জন্যে 'হিন্দুর কবি' আখ্যা যে রূপ বিচার্য নয়, সে রূপই নয় ইকবালের প্রতি প্রদত্ত 'মুসলমানের কবি' অভিধাঐতিহ্যের পুনরাবর্তনে নয়, নবায়নের মধ্যেই একজন কবির সৃষ্টিকর্মের সার্থকতা …।"

কোনো সন্দেহ নেই, এই প্রবন্ধটি যতীন সরকারের মৌলিক সাহসী প্রয়াসযে ইকবালের নামের সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীলতা ধর্মীয় আবহ একাকার হয়ে মিশে গেছে, সেই ইকবালের অসামান্য বৈপ্লবিক পঙ্ক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন লেখক-

'ওঠো, দুনিয়ার গরিব ভুখারিদের জাগিয়ে দাও

ধনীর প্রাসাদ প্রাকারের ভিত্তিকে পর্যন্ত কাঁপিয়ে দাও

যে-ক্ষিত থেকে কিষানের রুটি জোটে না

পুড়িয়ে দাও প্রতিটি গমের দানাকে।'

ধর্মাশ্রয়ী হওয়া মানেই মুক্তবুদ্ধির বিপরীতে অবস্থান নেওয়া - এমন একটি ধারণা আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রচলিতঅথচ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, পৃথিবীর প্রত্যেক জনগোষ্ঠীই ধর্মীয় চেতনার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অগ্রসর হয়েছে, সেই পথের শেষ এখনো হয়নিবিশেষ করে কৃষিভিত্তিক উৎপাদনব্যবস্থার অধীন যে সমাজ, সে সমাজের মানুষ বুদ্ধির চর্চা করে থাকেসে চর্চার মধ্য দিয়েই তার বুদ্ধি চিন্তা মুক্তির স্বাদ পায়ধর্মকেন্দ্রিক সমাজকাঠামোতে মানুষের মুক্তবুদ্ধির চর্চা তাই ধর্মাশ্রিত হওয়ার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা নেই, এমনকি প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রগতির সংগ্রামেও অনেক সময় ধর্ম হয়ে ওঠে সহযাত্রীকারণ প্রকৃত ধর্মচর্চার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ কিংবা প্রতিক্রিয়াশীলতার কোনো সম্পর্ক নেই

যতীন সরকারের আক্ষেপ- ধর্মীয় গোঁড়ামি ধর্মান্ধতার বিরোধী যাঁরা, তাঁরাও ধর্মশাস্ত্রের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মুক্তমতি হয়ে উঠতে পারেন নাতাঁরা রক্ষণশীল প্রচারক প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মব্যবসায়ীদের হাত থেকে ধর্মশাস্ত্রকে উদ্ধার করে আনার গরজবোধ করেন না, নিজেরাই যে ধর্মশাস্ত্রের সঠিক ব্যাখ্যাতা হয়ে উঠবেন - এমন সাহস পান নাতিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ধর্মপ্রাণ জনগণকে ধর্মধ্বজী ধর্মব্যবসায়ী ধর্মতন্ত্রের উগ্রবাদী ব্যাখ্যাকারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রথমে তো বুদ্ধিজীবীদেরই ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠনে প্রবৃত্ত হওয়া প্রয়োজনধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা যে মানবকেন্দ্রিক এবং বাঙালির লৌকিক ধর্ম যে মুক্তবুদ্ধির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত - অকাট্য যুক্তিসহকারে তা তিনি প্রমাণ করেছেন। 'বাঙালির লৌকিক ধর্মের মর্মান্বেষণ' নামক অসামান্য প্রবন্ধে তিনি উচ্চারণ করেছেন - '… কোন শাস্ত্রীয় ধর্মের আশ্রয়ে আদি বাঙালি জনগোষ্ঠীর যাত্রা শুরু হয়নিতারা তখন হিন্দুও ছিল না, বৌদ্ধও ছিল নাক্রমে বাইরে থেকে তাদের ভিতর হিন্দু ধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম অনুপ্রবিষ্ট হয়েছেএরপর এসেছে ইসলাম ধর্মঅর্থাৎ লৌকিক ধর্মই ছিল বাঙালির স্বাভাবিক ধর্ম, পরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে শাস্ত্রীয় ধর্ম তার উপর আরোপিত হয়েছেএরপরও বাঙালি তার স্বাভাবিক লৌকিক ধর্মকে ত্যাগ করেনিশাস্ত্রীয় ধর্মের সমস্ত বিশ্বাস অনুশাসনকে হুবহু গ্রহণ করেনি, লৌকিক ধর্মের জারক রসে শাস্ত্রীয় ধর্মকেও রীতিমত লৌকিক করে নিয়েছেএভাবেই বাংলার মাটিতে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে লৌকিক হিন্দু, লৌকিক বৌদ্ধ লৌকিক ইসলামের প্রসার ঘটেছে।'

প্রাবন্ধিক-বুদ্ধিজীবী যতীন সরকারের অন্যতম অবদান সংস্কৃতির প্রকৃত রূপের সঙ্গে পাঠক সাধারণকে সংযুক্ত করা। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের যুগে সংস্কৃতি যখন পণ্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং পণ্য ভোগবাদের (commodity fetishism) রমরমা যুগে যখন সংস্কৃতি বিনোদন সমার্থক প্রপঞ্চকে পরিণত হয়েছে তখন তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সংস্কৃতি বিনোদনের পার্থক্য চিনিয়ে দেনদেশসেরা সংস্কৃতিতাত্ত্বিক তিনিহাঙ্গেরির দার্শনিক লুকাচ সংস্কৃতিকে সকল মানবিক কর্মকাণ্ডের লক্ষ্যবিন্দু এবং রাজনীতিকে সে লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছার পথ হিসেবে দেখেছিলেনলুকাচের অনুসারী যতীন সরকার সংস্কৃতিকে রাজনীতির চূড়ায় বসিয়ে সংস্কৃতির মধ্যে যে অনুশীলনজাত মননগত উৎকর্ষ মূল্যবোধ রয়েছে তা দিয়ে রাজনীতিকে পরিশ্রুত করার কথা বলেছেনতিনি মনে করেন, এদেশে সংস্কৃতির মহৎ মানবিক লক্ষ্যকে ছাপিয়ে উঠেছে রাজনীতির সংকীর্ণ কৌশলতাই রাজনীতিকে পরিশোধিত করতে হলে, মুক্তিযুদ্ধের অপহৃত মূল্যবোধকে পুনরুদ্ধার করতে হলে, ধর্মাশ্রিত জঙ্গিবাদকে রুখে দাঁড়াতে হলে যথার্থ সাংস্কৃতিক জাগরণের কোনো বিকল্প নেইএই জাগরণ শুধু শহুরে শ্রেণির মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর নয়, গ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরওএই সম্মিলিত জাগরণই পারে আমাদের চেতনাগত পশ্চাৎপদতার মূল উপড়ে ফেলতে

যতীন সরকারের সংস্কৃতিভাবনা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আদলে সংগঠিতকিন্তু উদার মানবতাবাদীদের যে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রয়েছে, সেটি তিনি অস্বীকার করেন নাবামপন্থী সংস্কৃতিতাত্ত্বিক গোপাল হালদার, রণেশ দাশগুপ্তের চিন্তাধারাকে যেমন তিনি ধারণ করেন, তেমনি উদার মানবতাবাদী বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, মোতাহের হোসেন চৌধুরীর সংস্কৃতিভাবনাও তাঁকে প্রাণিত করেলোকসংস্কৃতির প্রতি তাঁর নিষ্ঠা সর্বজনবিদিত বোধ থেকেই তিনি বিশ্বাস করেন জনগণের সংস্কৃতিতেকবিগান, পালা, লোকসংস্কৃতির নায়কদের জীবনী রচনা - নানাভাবে তিনি গবেষণা করে দেখিয়েছেন, লোকসংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে সংস্কৃতির মূলধারা নির্মাণ সম্ভব নয়নাগরিক গ্রামীণ সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতা দূর করে একটি অখণ্ড, মননদীপ্ত, আনন্দময় সংস্কৃতির ধারা গড়ে তোলার পক্ষপাতী তিনিতিনি যথার্থই বলেছেন-

"আমাদের দেশে নাট্যকলার মুক্তিপ্রয়াসে যারা ব্রেখট সম্পর্কে উৎসাহী, তাদের উচিত সর্বাগ্রে আমাদের আপন দেশের ঐতিহ্য সম্পদ মুকুন্দ দাসের প্রতি মনোযোগী হওয়াতাহলেই বোধহয় দৈশিক প্রেক্ষাপটে ব্রেখটীয় পদ্ধতির সুসঙ্গত প্রয়োগ সম্ভব হতে পারে, থিয়েটার আর যাত্রা তথা লোকনাট্য অভিজাত নাট্যের কৃত্রিম ব্যবধান ঘুচিয়ে একটা অখণ্ড গণনাট্য গণসংস্কৃতি সৃষ্টি হতে পারে।"

এমন ভাবনা থেকেই তিনি বাংলা কবিতার মূলধারা অন্বেষণে অসামান্য নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেনমুকুন্দ দাস, রমেশ শীল, হাছন রাজা, জালাল উদ্দীন খাঁ, শাহ আবদুল করিমের মতো স্মরণীয় স্রষ্টাদের 'লোককবি' বৃত্ত থেকে মুক্ত করে মূলধারার কবির শিরোপায় ভূষিত করেছেনআধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সাহিত্য-সমালোচক ঐতিহাসিকদের বক্তব্যকে খণ্ডন করে বলেছেন-

"আমরা 'শিক্ষিত' মানুষজন, আসলে কতকগুলো দুর্মর কুসংস্কারে আচ্ছন্নএগুলো 'আধুনিকতা' কুসংস্কারতথাকথিত আধুনিক শিক্ষাই আমাদের মস্তিষ্ককোষে সেইসব কুসংস্কার ঢুকিয়ে দিয়ে নিদারুণ মানস-প্রতিবন্ধের সৃষ্টি করেছেসেরকম মানস-প্রতিবন্ধের দরুনই আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসকেও আমরা খণ্ডিত করে ফেলেছি, একটা খণ্ড অংশকেই সমগ্রের মর্যাদা দিয়েছিবাংলা সাহিত্যের মূলধারা বলে আমরা ধরে নিয়েছি ইংরেজি-শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের সৃষ্ট সাহিত্যকেএর বাইরে বিশাল বাংলায় গ্রামীণ কৃষিজীবী বা অন্যান্য বৃত্তিজীবীদের মধ্য থেকে উঠে এসেছেন যেসব কবি, শতকরা নববইজন মানুষ যাঁদের কবিতা বা গান তথা সাহিত্যের উপভোক্তা - তাঁদের তো আমরা গণনায়ই বিবেচনা করিনিঅথচ এঁরাই আবহমান বাংলার গণকবিতার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন।"

মূলধারার এই কবিদের পথরেখা অনুসরণ করেই বাংলা সাহিত্যমঞ্চে আবির্ভাব ঘটে কাজী নজরুল ইসলামেরনজরুলের সমকালে পরবর্তী সময়ে তাঁর অবদানকে যেভাবে খণ্ডিত দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে নজরুলের অখণ্ড সত্তাকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন যতীন সরকার

আবহমান বাঙালির সামগ্রিক সমন্বয়ী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে আবির্ভূত নজরুল খণ্ডিত হয়েছেন হিন্দু, মুসলমান এমনকি বামপন্থী মহল দ্বারাওনজরুল-সাহিত্যে যেখানে নিজেদের আদর্শ-চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে, সেখানে তাদের কাছে নজরুল আদৃত হয়েছেন; অন্য ক্ষেত্রে হয়েছেন বর্জিতএই প্রবণতার বিরোধিতা করে অখণ্ড নজরুল অনুসন্ধানে প্রয়াসী হতে আহবান জানিয়েছেন তিনিদৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করেছেন-

"নজরুল ইসলাম সাধারণ মাপের খাঁটি বাঙালি কবি নন, লোকসাহিত্যের পরিমণ্ডলের বাইরে নাগরিক সমাজের কবিদের মধ্যে 'খাঁটি সোনার চাইতে খাঁটি' বাঙালি কবি তিনিলোককবিদের খাঁটি বাঙালিত্বকে তাঁর সমগ্র সত্তায় ধারণ করেই তিনি গ্রাম থেকে নগরে উঠে এসেছিলেন।"

বক্তৃতায়, সাক্ষাৎকারে, সাহিত্যচর্চায় যতীন সরকার যাঁকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করেন তিনি বাঙালি সংস্কৃতির মহত্তম পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরতাঁর অনন্যসাধারণ প্রবন্ধ সংকলন 'আমার রবীন্দ্র অবলোকন'। প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অবলোকন করেছেন 'দুই বিঘা জমি'তে দাঁড়িয়েসমাজতন্ত্রী ছিলেন না রবীন্দ্রনাথকিন্তু তাঁর বিশ্ব-মানবতাবোধের মধ্যেই যে সাম্যচেতনা প্রবলভাবে জড়িয়ে আছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যতীন সরকাররবীন্দ্রনাথের মধ্যে তিনি আবিষ্কার করেছেন 'সামাজিক বাস্তবতার একান্ত মূর্ত স্পষ্ট প্রকাশ এবং একই সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের আর্তি আকুলতার সুনিপুণ উদ্ঘাটন'। ইতিহাসগুরু হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে বিবেচনা করেছেন লেখকতিনি যথার্থই বলেছেন-

"… তাঁর মনীষার দীপ্তি ইতিহাসের অনেক আঁধার কক্ষকেও আলোকিত করে তুলেছেকবিতা-উপন্যাস-নাটকের মতো সৃষ্টিশীল সাহিত্যে যেমন তিনি তীব্র ইতিহাসবোধের পরিচয় রেখেছেন, তেমনি নিছক তত্ত্ব আলোচনাতেও ইতিহাস-ব্যাখ্যার অনেক মৌলিক সূত্রের সংযোজন ঘটিয়েছেনতাই ইতিহাসের পাঠ নিতেও যদি আমরা রবীন্দ্রনাথের শিষ্যত্বকে অঙ্গীকার করে নিই, তাহলেও ঠকবার আশঙ্কা তো নেই-, বরং লাভের সম্ভাবনা প্রচুর।"

গভীর অন্তর্দৃষ্টি দূরদর্শিতার কারণে দেশের অতীত বর্তমান বাস্তবকে স্পষ্টভাবে দেখতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথতৎকালীন রাজনীতিবিদগণ বিদেশি রাজ তাড়িয়ে স্বরাজ তথা নিজেদের রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিলেন, জনগণের রাজত্ব নয়রবীন্দ্রনাথ এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করেছিলেনলেখকের পর্যবেক্ষণ-

"রবীন্দ্রনাথ যাকে 'সমাজতন্ত্র' বলেছিলেন, সেটি ইংরেজি 'সোশ্যালিজম'-এর বাংলা অনুবাদ মাত্র নয়এই সমাজতন্ত্রে সোশ্যালিজম অবশ্যই অঙ্গীকৃত, সোশ্যালিজমের চেয়ে অনেক বড়সেই সোশ্যালিজমেই ছিল আসল 'গণতন্ত্র' যে গণতন্ত্রের অবস্থান বিলিতি 'ডেমোক্রেসি' অনেক অনেক উপরেসে গণতন্ত্রে কালীন রাষ্ট্রতন্ত্রের ভোটাভুটি ছিল না, কিন্তু গণমানুষের প্রকৃত অংশীদারিত্ব ছিল।"

ভাববাদী কবি রবীন্দ্রনাথকে বস্তুবাদী যতীন সরকার মূল্যায়ন করেছেন প্রবল কাণ্ডজ্ঞান থেকেতাই রবীন্দ্রনাথের ভাববাদী দর্শনের মধ্যেও তিনি খুঁজে পেয়েছেন বস্তুবাদের নির্যাসরবীন্দ্রনাথ কল্পজগতের স্রষ্টা হয়েও রেনেসাঁসজাত মানবতন্ত্রের প্রেরণাতেই হতে পেরেছিলেন বাস্তববাদী শিল্পীএই বাস্তবতাবোধ তিনি আহরণ করেছিলেন বাংলার লোকায়তিক জীবনোপলব্ধি থেকেলেখকের পর্যবেক্ষণ-

"… ভাববাদী কবি হয়েও রবীন্দ্রনাথ 'ভাবোন্মাদ' ছিলেন না, বরং ছিলেন অনেক বস্তুবাদীর চেয়েও অনেক বেশি বাস্তব দৃষ্টির অধিকারী। … ভাববাদী পরিপার্শ্ব থেকে যাত্রা শুরু করলেও রবীন্দ্রনাথ হাঁটতে হাঁটতে যে-পথে চলে গিয়েছেন সে-পথ মোটেই ভাববাদের নয়, শেষ পর্যন্ত বস্তুবাদের সৈদ্ধান্তিক ভূমিতেই নিজেকে তিনি উপনীত করেছেন।"

বাস্তবতাবোধের কারণেই যৌবনে 'ক্ষণিকা' কাব্যে রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছিলেন, 'ভালোমন্দ যাহাই আসুক/সত্যেরে লও সহজে'। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উপলব্ধি করেছেন, 'সত্য যে কঠিন,/কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,/সে কখনো করে না বঞ্চনা'। রাবীন্দ্রিক সত্যনিষ্ঠাকে যতীন সরকার তাঁর জীবনদর্শনে ঐকান্তিকভাবে ধারণ করেছেন

ময়মনসিংহ চরিতাভিধানে যতীন সরকার সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'শিক্ষাবিদ, সাম্যবাদী রাজনীতিক, সংস্কৃতি সংগঠক লেখকসমাজতত্ত্বের সত্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণে তিনি পারদর্শীসমাজ, সংস্কৃতি দেশের মৌলিক ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ গভীরসত্য-ভাষণ বাগ্মিতার জন্য তিনি প্রসিদ্ধ।' এই বর্ণনাটুকু লেখকের যে-বইটিতে সবচেয়ে যৌক্তিকভাবে প্রযুক্ত হয়েছে সেটি হচ্ছে 'পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন'।

নিম্নবর্গের ইতিহাস নিয়ে আমাদের দেশে উল্লেখযোগ্য চর্চা নেইমুক্তিযুদ্ধের যে প্রথাবদ্ধ ইতিহাস সেটিও খণ্ডিত, নাগরিক জীবনের দ্বন্দ্ব-সংকটের বৃত্তে আবদ্ধ, গ্রামীণ মনোলোক এখানে অনুপস্থিতপাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন এক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রমব্রিটিশ শাসনামলের শেষ পর্ব, দেশবিভাগ এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় - এই সময়সীমার মধ্যে লোকজ ইতিহাস লোকজ দর্শনের সমন্বয়ে এক অনবদ্য স্মৃতিকথা আলোচ্য বইটিযতীন সরকার ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু, রাজনৈতিক পরিচয়ে বামপন্থী এবং কর্মসূত্রে শিক্ষকসব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে নির্মোহ বিশ্লেষণে তিনি জীবন্ত করে তুলেছেন পাকিস্তানের উদ্ভব বিলুপ্তির অসামান্য চিত্রবইটি পাকিস্তান-পূর্ব সময়ের পাকিস্তান-পর্বের সিকি শতাব্দীর মফস্বলবাসী হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত সমাজের স্বচ্ছ ছবিতে পূর্ণ এক চিত্রশালাএই চিত্রশালায় ঠাঁই পেয়েছেন সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ বহু ব্যক্তিসাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির উত্থান কীভাবে একটি কালকে, ভূখণ্ডকে আলোড়িত করেছে এর স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে বইয়েহিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে উদারতা-সাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা-অমানবিকতার সত্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করেছেন প্রাঞ্জল ভাষায়এক সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে কীভাবে আরেক সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হয় এর বস্তুনিষ্ঠ উদাহরণ দিয়েছেন লেখক-

"মুসলমানদের ভেতর থেকে যখন একটি শিক্ষিত আত্মসচেতন মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে, তখন সেই মধ্যবিত্ত তরুণরা হিন্দুদের সকল আচরণের মধ্যেই মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা অবজ্ঞার প্রকাশ দেখতে পায়তারাও মুসলিম রক্ষণশীলতার দুর্গটিকে আরো পোক্ত করে নিয়ে সেখানে বসেই হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘৃণার তীর ছুঁড়তে শুরু করেহিন্দু রক্ষণশীলতাই আরো যুক্তিহীন হয়ে, কিংবা অভিনব সব কুযুক্তির আশ্রয় নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু রিভাইভ্যালিজমের সৃষ্টি করেছিলমুসলিম মধ্যবিত্ত তার উদ্ভবলগ্নেই এই হিন্দু রিভাইভ্যালিজমের মুখোমুখি হয়ে পড়েতারাও এখন এর মোকাবেলা করতে চায় মুসলিম রিভাইভ্যালিজম দিয়ে ধরনের সব রিভাইভ্যালিজমই অতীতের এক কল্পলোক সৃষ্টি করে তাতে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখেমুসলিম রিভাইভ্যালিজমও তাই করেছিল।"

উপন্যাসের স্বাদে তৈরি এই অপূর্ব স্মৃতিকথায় চিত্রিত হয়েছে বেশকিছু অনক্ষর পার্শ্বচরিত্র যাঁদের অসাধারণ কাণ্ডজ্ঞান প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের লজ্জা দেবে। '৪৭-এর দেশবিভাগ, প্রান্তবর্তী জনপদে ভাষা-আন্দোলনের ঢেউ, '৫৪-এর নির্বাচন, '৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে '৭১-এর রক্তসরোবর পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত ঘটনা পরম্পরার স্বাদু বর্ণনা এবং এর নায়ক, প্রতিনায়ক পার্শ্বনায়কদের নির্মোহ বিশ্লেষণ এই বইয়ের অবিস্মরণীয় সম্পদমুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চায় তাই 'পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন' অতুলনীয় সংযোজন

যতীন সরকার জাতশিক্ষকশুধু শ্রেণিকক্ষই নয়, শ্রেণিকক্ষর বাইরেও অন্তত তিনটি প্রজন্মের শিক্ষাগুরু এই বরেণ্য বুদ্ধিজীবীবামপন্থী তাত্ত্বিক সংস্কৃতি-সংগঠক হওয়ার সূত্রে দেশজুড়ে নিজের বাগ্মিতাগুণে তিনি জয় করেছেন অগণিত দর্শক-শ্রোতার মানসভুবনপ্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি স্টুপিড তৈরির শিক্ষা মনে করেনএর বিকল্প হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন পাঠচক্রের সুবিশাল পরিসরকেতিনি বিশ্বাস করেন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ যে-কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা পাঠশালার রচনশীল ভ্রান্তিবহুল শিক্ষার খোলনলচে পালটে প্রকৃত শিক্ষার অধিকারী হওয়ার জন্য পাঠচক্র প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেইউনিশ শতকের বাঙালি সমাজে নবজাগরণের অন্যতম অনুঘটক ছিল কিংবদন্তি শিক্ষক ডিরোজিওর হাতে গড়া ইয়াং বেঙ্গলকলেজের নানা প্রতিবন্ধকতা নিষেধের কারণে কলেজ প্রাঙ্গণের বাইরে 'অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন' স্থাপন করে তিনি মুক্তবুদ্ধিচর্চার সূচনা করেছিলেনএই 'অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন' ছিল একটি পাঠচক্র এবং এখান থেকেই বাংলায় আধুনিক ধারার পাঠচক্রের সূত্রপাতযতীন সরকারের পর্যবেক্ষণ-

"পৃথিবীতে কোনো র‌্যাডিক্যাল চিন্তার উদ্ভব বা বিস্তারই পাঠশালা থেকে হয়নি, হয়েছে পাঠচক্র থেকেপাঠচক্রের আওতায় লালিত পালিত হয়েই ক্রমে সকল বিপ্লবী চিন্তা জনসাধারণের বিপ্লবী কর্মপ্রয়াসে পরিণত হয়েছে এবং সমাজের বাঞ্ছিত রূপান্তর ঘটিয়েছেএভাবেই মার্কস-এঙ্গেলসের বিপ্লবী চিন্তা উনিশ শতকের শেষ পর্বে রুশ দেশে মনীষী প্লেখানভের প্রবর্তনায় ছোট ছোট পাঠচক্রের মধ্য দিয়ে বিস্তার লাভ করতে থাকেএরপর বিশ শতকের গোড়াতেই পাঠচক্রের সীমানা উল্লংঘন করে বিপ্লবী ভাবনার সেই স্ফুলিঙ্গগুলি লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকদের হাতে বিপ্লবের অগ্নিমশাল হয়ে জ্বলে ওঠেএবং ক্রমে সে আগুন ছড়িয়ে যায় সবখানে।"

পাঠচক্র সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখে তিনি দায়িত্ব শেষ করেননিময়মনসিংহের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী মহানগরে দীর্ঘ চার দশক পাঠচক্র-আন্দোলনে অভিভাবকসুলভ দায়িত্ব পালন করেছেন

যতীন সরকারের সাম্প্রতিক প্রবন্ধ সংকলন 'সাঁকো বাঁধার প্রত্যয়'। সূচনা প্রবন্ধটি তিনি লিখেছেন শামসুর রাহমানের একটি বিখ্যাত কবিতাকে অবলম্বন করে। 'বাঁধতে পারিনি কোনো সাঁকো' নামক এই কবিতায় কবি আক্ষেপ করে বলেছেন, একাকিত্বের যন্ত্রণায় তিনি রক্তাক্ত হচ্ছেনশুধু নিজের সঙ্গে কথোপকথনে মেতে থাকা যায় নাঅন্য কারো হাত, অন্য কারো স্বরের জন্য ব্যাকুল কবি কারো সঙ্গেই সাঁকো বাঁধতে পারেননিবিচ্ছিন্ন কবির স্বীকারোক্তি - 'নিপুণ বাঁধতে গিয়ে সাঁকো তবু আমি/ব্যর্থ হয়ে যাই/বারবার ব্যর্থ হয়ে যাই …।'

এই কবিতার নির্যাসকে কেন্দ্র করে যতীন সরকার অত্যন্ত চিন্তা-উদ্দীপক প্রবন্ধটি লিখেছেনকবি, শিল্পী তথা সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁদের সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে জনসাধারণের কাঙ্ক্ষিত সংযোগ-সেতু রচনা করতে কেন ব্যর্থ হলেন - এর চুলচেরা বিশ্লেষণ রয়েছে এই প্রবন্ধেবাংলা কবিতার যুগপরিক্রমা করে তিনি দেখিয়েছেন, আমাদের সাহিত্যের মহৎ শিল্পীদের একটি বড় অংশ সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাঁকো বাঁধতে ব্যর্থ হয়েছেনশুধু ব্যর্থ হননি, অনেকে সাঁকো বাঁধার অঙ্গীকারকেই অস্বীকার করেছেন। 'শিল্পের জন্য শিল্প' অর্থাৎ কলাকৈবল্যবাদী জীবনদর্শনের কারণে তাঁরা গণচেতনাকে ধারণ করতে পারেননিএমনকি বাংলার সাম্যবাদী কবিগণও বহুকাঙ্ক্ষিত সাঁকোটি বাঁধতে পারেননিকবিতার মধ্য দিয়ে তাঁরা বড়জোর মধ্যবিত্তের এক অংশের বিবেককে জাগ্রত করতে পারলেনশ্রমঘনিষ্ঠ জনগণের মনের অন্দরমহলে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হলেন

এই ব্যর্থতা শুধু কবিদের নয়, সামগ্রিকভাবে আমাদের সাহিত্যের অধিকাংশ স্রষ্টাদেরওসেই ব্যর্থতার দায় মোচনে যে বিরলসংখ্যক সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে যতীন সরকার অন্যতমপ্রাকৃতজন তথা সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সপক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর তিনিশুধু সাহিত্যচর্চায় নয়, নিজের জীবনাচরণেও শ্রেণিবৈষম্যের বিলোপ তথা নিম্নবর্গের মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন তিনিগণচেতনাকে ধারণ করতে পেরেছেন বলেই 'প্রাকৃতজনের জীবনদর্শন' নামক অসাধারণ বইটিতে তিনি উচ্চারণ করেছেন-

'যুক্তি দ্বারা কারণ থেকে কার্যে এবং কার্য থেকে কারণে পৌঁছবার নামই দর্শন', কিংবা 'দর্শন হলো কার্যকারণ সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান' - দর্শনের পণ্ডিতজন-সমর্থিত এরকম বিশেষ অর্থগুলো লক্ষ করলেও প্রতীতী জন্মে যে কোনো বিষয়কে ভালো করে দেখা বা দেখতে চাওয়াই আসলে দর্শনগ্রিক ভাষা থেকে গৃহীত ইংরেজি Philosophy কথাটার যে আক্ষরিক অর্থ 'জ্ঞানানুসন্ধান', তাতেও এই 'ভালো করে দেখা' ব্যঞ্জনাটাই উপস্থিতপ্রাকৃতজনও অবশ্যই তাদের নিজেদের সাধ্যমতো পরিপার্শ্বের বা জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়কে ভালো করে দেখতে চায়, সেসব বিষয়ের কার্যকারণ সম্পর্ককে খুঁজে বার করতে চায়এই চাওয়ার আর্তি থেকেই গড়ে ওঠে প্রাকৃতজনের দর্শন, বিদগ্ধ পণ্ডিতজনের নিকট তা যতই হোক না কেন অবজ্ঞার বিষয়এই হিসেবে বাংলার প্রাকৃতজনেরও নিশ্চয়ই দর্শন আছেতবে সেটি বিদগ্ধজনের দর্শনের মতো নিছক বিশুদ্ধ জ্ঞানানুসন্ধান নয়, যে কঠোর শ্রম দিয়ে প্রাকৃতজন জীবিকা অর্জন করে সেই শ্রম প্রক্রিয়ার সঙ্গে একান্তভাবে যুক্ত তার দর্শন

নিজের অর্ধশতাব্দীর সাহিত্যসাধনার সঙ্গে যতীন সরকার যুক্ত করতে চেয়েছেন প্রাকৃতজন তথা গণমানুষের চৈতন্যকেশিল্পের সঙ্গে জীবনের সাঁকো বাঁধার প্রত্যয়ে অদম্য ক্রিয়াশীল তিনিশ্রমঘনিষ্ঠ জনগণের সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটানোর ক্ষেত্রে দৃঢ়প্রত্যয়ী তাঁর বিবেকসাঁকো বাঁধার নিপুণ কারিগর তিনি

[লেখাটি 'কালি ও কলম' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়; লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।]