By সজীব সরকার
মানুষ : একটি দার্শনিক বিচার - ৭
Media School March 19, 2021
এ অঞ্চলের আরেক বাউল গগন হরকরা (আনুমানিক ১৮৪৫-১৯১০) লালনের মতো সেই ‘মনের মানুষ’-কেই খুঁজেছেন; সবসময় তাঁর অনুসন্ধান ছিলো : ‘আমি কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যে রে’। আর লালনের মতো গগনও নিজের ভেতরকার ঈশ্বরের সন্ধানে দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন : ‘হারায়ে সেই মানুষে, তার উদ্দেশে দেশ-বিদেশে/আমি দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে’। গগন বাউল সেই আত্মার সাথে সম্মিলনেই জীবনের প্রকৃত সুখ খুঁজেছেন : ‘লাগি সেই হৃদয় শশী, সদা প্রাণ হয় উদাসী/পেলে মন হতো খুশি, দিবা-নিশি দেখিতাম নয়ন ভরে/... দিবো তার তুলনা কি, যার প্রেমে জগত সুখী/হেরিলে জুড়ায় আঁখি, সামান্যে কি দেখিতে পারে তারে/তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে’। এর মাধ্যমে লালন বা হাছনসহ অন্য বাউল-সাধকদের মতো এখানে গগনের উপলব্ধিতেও জড়-জাগতিক বা বৈষয়িক জীবনের বিপরীতে আধ্যাত্মিক সাধনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ কারণে লালনের সেই ‘পড়শী’র মতো গগনও তাঁর ‘মনের মানুষকে’ না পাওয়ার বেদনায় ছটফট করেছেন : ‘আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে, নিভাই কেমন করে/মরি হায়, হায় রে/ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে/(ওরে) দেখনা তোরা হৃদয় চিরে’।
লালন বা হাছনের মতো গগন হরকরাও রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বাউল ছিলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গগনের গানের কেবল সমঝদার-ভক্তই ছিলেন না, গগনের দুটো গানের সুর ভেঙ্গে তিনি নিজের দুটো গানের সুরও করেন। গগন বাউলের ‘ও মন অসাড় মায়ায় ভুলে রবে’-এর সুরে ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’ এবং ‘আমি কোথায় পাব তারে’-এর সুরে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সুর করেন রবীন্দ্রনাথ।
সনাতন ধর্মের বৈষ্ণব ধারা ও বাউল দর্শনে প্রেমভাব বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বাউল সাহিত্যে বারবারই আধ্যাত্মিক ভজন-সাধন ও প্রেম গুরুত্ব পেয়েছে। হাছন বা গগনের মতো এ অঞ্চলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ বাউল সাধক জালাল উদ্দিন খাঁ (১৮৯৪-১৯৭২)-এর গানেও মেলে বৃহত্তর সত্তার সাথে সম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা, মিলনের ব্যাপারে সংশয় ও এর সমান্তরালে প্রেমের অতুল মর্যাদার বয়ান : ‘আমি কি সুখে জীবন কাটাবো/যাবো বলো কোনখানে/পিরিতি জান্নাতের ফল/ধরলো না মোর বাগানে!’ প্রেমভাবকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে জালাল খাঁ বলছেন : ‘আছমানে জমিনে পিরিত অনন্তকাল ধরিয়া/সময় হলে রোদ বাদলে শান্ত করিয়া/তা না হলে ফুলে ফলে শোভিত না এই ভুববন/প্রেমেতে হইল জঙ্গলবাসী মুনি ঋষি আউলিয়া’।
লালন যেমন বলেছেন ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, জালালও তেমনি সতর্ক করেছেন : ‘থাকতে ক্ষুধা প্রেম সুধা পান করে যা ওরে মন/দিন গেলে সে হবে না আর ভাটা যদি লয় যৌবন’। বাউল জালাল খাঁর মধ্যেও তাই জড়-জাগতিক মোহমায়া কাটিয়ে স্রষ্টার প্রেমে মশগুল হওয়ার বাসনা : ‘মায়ামোহ ছাড়াইয়া বন্ধন মুক্ত হইলে/গানের ছন্দে প্রেমানন্দে/প্রেমিক নাচে তালে’।
জালাল উদ্দিন খাঁর সঙ্গীতচর্চায় বৈষ্ণবপদাবলি, শাক্তপদাবলি, সহজিয়া পদাবলি এবং বাউল সুরের ধারার প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। বহুমুখী দর্শন-তত্ত্বের প্রভাবে তাঁর সাহিত্য ও দর্শনে আত্মতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব, লোকতত্ত্ব ও দেশতত্ত্বসহ নানা ধারা-উপধারার গভীর ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে। তবে নিজের কিছু গানকে জালাল খাঁ কোনো তত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করেননি; সেগুলো মূলত ভাটিয়ালি, মুর্শিদি ও মারফতি গান।
ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেত্রকোনার জালাল খাঁ তাঁর সমসাময়িক এবং পূর্বসূরি অনেক বাউল ও লোকায়ত দার্শনিকের ভাবনা দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সিলেটের হাছন রাজা, আব্দুল করিম ও রাধারমণ, নরসিংদীর দ্বিজদাস ও হরিচরণ আচার্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনোমোহন দত্ত, নেত্রকোনার লাল মাসুদ, সুলা গাইন, বিজয় নারায়ণ আচার্য, দীন শরৎ (শরৎ চন্দ্র নাথ), কিশোরগঞ্জের রামু মালি, রামগতি শীল ও রামকানাই নাথ। জালাল খাঁকে এঁদেরই যোগ্য উত্তরসাধক মনে করা হয়। সাহিত্যানুরাগীদের মতে, দোহাকোষ ও চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য, সহজিয়া সাহিত্য, গাথা ও গীতির পরম্পরায় বাংলা সাহিত্যের যে ধারা গতি পেয়েছে, জালাল উদ্দিন খাঁ ওই ধারার অন্যতম প্রতিনিধি।
বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের (১৯১৬-২০০৯) গানে লালন আর হাছনসহ অন্য বাউল দার্শনিকদের মতোই পরম সত্তায় নির্ভরতা দেখা যায়। তবে এই সত্তার ধরন বা পরিচয় সম্পর্কে শাহ আব্দুল করিম যেন সংশয়বাদী থেকেছেন : ‘কোন মিস্তরি নাও বানাইলো এমন দেখা যায়/ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূূরপঙ্খী নায়’। তিনি স্পষ্টই বলছেন : ‘বাউল আব্দুল করিম বলে বুঝে উঠা দায়/কোথা হতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়/ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়’। এখানে জীবনের উৎস, পরিণতি ও এর গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে এক সংশয়বাদী বাউলের সন্ধান মেলে।
সনাতন ধর্মে মানুষ হচ্ছে ‘দেহ’ ও ‘আত্মা’ - এই দুয়ের সম্মিলন। অপার্থিব শক্তিধর ঈশ্বরে বিশ্বাসী এই ধর্মে মানুষের চূড়ান্ত গন্তব্য হলো জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন : ভাষান্তরে ঈশ্বরের সাথে মানুষের বিলীন হয়ে যাওয়া। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীমতী রাধার প্রেম প্রকৃত অর্থে নারী-পুরুষের জৈবিক প্রেম নয় বরং প্রকারান্তরে এই জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনেরই প্রতিরূপ। রাধারমণের (১৮৩৩-১৯১৫) গানে ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া’ তাই যতো না কৃষ্ণের বিরহে রাধার আকুলতা, তার চেয়ে বেশি বরং পরমাত্মার সাথে মিলনে বিলীন হতে জীবাত্মার বাসনার বয়ান। সহজিয়া কথার সাধক কবি, বৈষ্ণব বাউল ও লোককবি রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ গেয়েছেন : ‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া/শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে/ভ্রমর কইয়ো গিয়া/... কইয়ো কইয়ো কইয়োরে রে ভ্রমর কৃষ্ণরে বুঝাইয়া/মুই রাধা মইরা যাইমু কৃষ্ণহারা হইয়া...’। এই গানের মাধ্যমে আবারো সেই পরম এক সত্তায় বিলীন হতে মানুষের বাসনাই স্পষ্ট হয়।
চলবে...