By সজীব সরকার
মানুষ : একটি দার্শনিক বিচার - ৬
Media School March 14, 2021
লালনের পর এ অঞ্চলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ সাধক মরমি কবি হাছন রাজা (১৮৫৪-১৯২২)। জীবনের নানা পর্যায়ে অহিদুর রেজা, দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরী ও হাছন রাজা - এই তিন নামে অভিহিত হলেও শেষতক তিনি হাছন রাজা নামেই সবচেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেন।
লালনের জীবন-দর্শন নিয়ে অস্পষ্টতা না থাকলেও হাছন রাজার মত ও পথ নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। হাছন কি বাউল না সুফি কিংবা তিনি কি নিরীশ্বরবাদী নাকি সর্বেশ্বরবাদী - এসব প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। তবে হাছন রাজার দর্শন বোঝার জন্যে তাঁর জীবন সম্পর্কে জানা দরকার। প্রথমদিকে হাছন রাজা একজন অসংযত বা ভোগে মত্ত জমিদার ছিলেন। জমিদারির দায়িত্ব পেয়ে বালক হাছন ক্রমেই ভোগ-বিলাস অর্থাৎ অসংযত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ কথা হাছন নিজেই তাঁর গানে স্বীকার করেছেন : ‘সর্বলোকে বলে হাছন লম্পটিয়া’। পরে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পের (সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় ‘ভৈসাল’) ধ্বংসযজ্ঞ দেখার পর হাছনের বোধোদয় ঘটে, সৃষ্টির কাছে মানুষের জীবন কতো তুচ্ছ, কতো ক্ষণস্থায়ী আর এ জগত কতো নশ্বর। মনুষ্যজীবনের নশ্বরতা উপলব্ধি করার পর হাছন নিজেকে বলছেন : ‘একদিন তোর হইবো রে মরণ, রে হাছন রাজা/একদিন তোর হইবো রে মরণ’। এখানে দেখা যায়, পাশ্চাত্য দর্শনের কিংবা এ অঞ্চলের দর্শনের নানা ধারা-উপধারায় ‘মৃত্যু’ যেভাবে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, হাছনের দর্শনে তা উপেক্ষিত হয়নি।
এভাবে যেন ‘বৈষয়িক’ ও ‘ভোগী’ হাছনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে এক ‘দার্শনিক’ বা ‘বাউলা’ হাছন। অর্থাৎ দার্শনিক বিচারে হাছন রাজাকে প্রথম জীবনে ‘ভোগী’ ও পরবর্তী সময়ে ‘যোগী’ হিসেবে চিত্রিত করা যায়।
হাছনের জীবনের এই পরিবর্তন যেন মহামতি বুদ্ধের জীবনের গল্পেরই প্রতিচ্ছবি : কপিলাবস্তুর রাজকুমার সিদ্ধার্থ মানুষের দুর্দশা দেখে দুঃখভারাক্রান্ত হয়েছিলেন এবং জরা, বার্ধক্য, মৃত্যু ও দুঃখকে জয় করতে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন (বৌদ্ধ ধর্মে এই ঘটনাটি ‘মহাভিনিষ্ক্রমণ’ হিসেবে উল্লেখিত)। পরে বহু সাধনায় তিনি ইহজাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করেন এবং বোধিলাভের মাধ্যমে মানুষ সিদ্ধার্থ থেকে ভগবান বুদ্ধে রূপান্তরিত হন।
জীবন-জগত সম্পর্কে হাছন রাজার মধ্যেও বুদ্ধের মতো উপলব্ধি ঘটে তবে সিদ্ধার্থের মতো হাছন ঘর ছাড়েননি। ঘরে থেকেও দার্শনিক ভাবনার মধ্য দিয়েই হাছন রাজা সন্ধান পেয়েছেন তাঁর অন্তর্লোকের বাসনার বস্তু : স্রষ্টার সান্নিধ্য। হাছনের ভাষ্যে : ‘ভৈসালের বৎসরে বন্ধে দরশন দিল রে/দয়া করিয়া আমার সঙ্গে কথাবার্তা কইলো রে/তুমি আমার, আমি তোমার বন্ধে যে বলিল রে/আমার দুঃখের কথা শুনিয়া বন্ধের দয়া হইল রে’। এভাবেই জন্ম হলো এক নতুন হাছর রাজার; জমিদার হাছনের পরিচয় ভুলে জন্ম নিলো এক মরমী কবি যিনি ঈশ্বরের প্রেমে নিজেকে ‘মাতাল’ বলে পরিচয় দিয়ে যেন পুরোনো পরিচয়কে ত্যাগ করলেন আর নতুন হাছনকে স্বীকৃতি দিলেন : ‘নূরের বদন হাছন রাজা দিলের চক্ষে দেখল রে/আমারে করিয়া ফানা অন্তরে ছাপাইল রে/এই দেখিলাম, এই নাই, কি করি উপায় রে/প্রেমের মাতাল হইয়া হাছন রাজা গান গায় রে’।
দার্শনিক বিচারে নিজেকে ‘প্রেমে মাতাল’ হিসেবে ঘোষণা করাই হলো হাছন রাজার আত্মোপলব্ধির এক মরমী পর্যায় যেখানে সন্ধান মেলে দার্শনিক হাছনের। আর কেবল বাউলধারা নয়, হাছন রাজা যখন লিখলেন : ‘মম আঁখি হইতে পয়দা হইলো আসমান জমিন’, তখন তাঁর দর্শনে সুফিবাদের প্রভাবও দৃশ্যমান হলো। হাছনের এই সুফিবাদী ভাবধারার মিল পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও; ‘আমি’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,/চুনি উঠল রাঙা হয়ে।/আমি চোখ মেললুম আকাশে,/জ্বলে উঠল আলো/পুবে পশ্চিমে।/গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’,/সুন্দর হল সে’।
হাছন রাজার চিন্তার জগতে আমূল পরিবর্তন ঘটার সাথে সাথে মানবজীবনের অনিত্যতা ও ভোগে মত্ত মানুষের সাধন-ভজনে অক্ষমতার ব্যাপারে তাঁর মধ্যে বোধোদয় ঘটে। জাগতিক সুখের নিষ্ফলতা উপলব্ধি করে হাছনের স্বীকারোক্তি : ‘ও যৌবন ঘুমেরই স্বপন/সাধন বিনে নারীর সনে হারাইলাম মূলধন’। হাছন এবার নিজেকেই প্রশ্ন করছেন : ‘করবায়নি রে হাছন রাজা দেশে দেশে বিয়া’। হাছনের মতো সাধনবিহীন কালক্ষেপনের এই আক্ষেপ দেখা যায় লোকশিল্পী কাঙ্গালিনী সুফিয়ার (জন্ম : ১৯৬১) গানেও : ‘ঘুমাইয়া ছিলাম, ছিলাম ভালো/... জেগে দেখি বেলা নাই.../কোন বা পথে নিতাইগঞ্জ যাই’। বাউলসম্রাজ্ঞী সুফিয়ার কণ্ঠেও হাছন রাজার মতো ষড়রিপুর কাছে পরাস্ত হওয়ার বেদনার আখ্যান স্পষ্ট হয় : ‘নিতাইগঞ্জ করবো বাসা/মনে ছিল দারুণ আশা গো/... এবার ছয় ডাকাতে যুক্তি করে/... আশার মুখে দিলো ছাই...’।
দার্শনিক, আধ্যাত্মিক লোককবি ও সঙ্গীতসাধক হাছন রাজার গানে বারবারই মানবজীবনের নশ্বরতা স্পষ্ট হয়েছে : ‘ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকব আর/আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার/এই ভাবিয়া হাছন রাজায় ঘরদুয়ার না বান্ধে/কোথায় নিয়া রাখব আল্লায় এর লাগিয়া কান্দে’। লালনসহ অন্য বাউলদের মতো উচ্চতর এক সত্তায় (স্রষ্টা) বিলীন হওয়ার বাসনাও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গানে : ‘আমি যাইমু রে আল্লার সঙ্গে/... হাছন রাজায় আল্লা বিনে কিছু নাহি মাঙ্গে’।
নিজের নশ্বরতা উপলব্ধি করে হাছন রাজা ঈশ্বরের সাথে বিলীন হতে চেয়েছেন। তিনি বলছেন : ‘হাছন রাজায় কয়/আমি কিছু নয়রে, আমি কিছু নয়/অন্তরে বাহিরে দেখি, কেবল দয়াময়’। ঈশ্বরের প্রেমে মজে হাছনের অস্তিত্ব বিলীন হয়; হাছনের উপলব্ধি : ‘প্রেমেরি বাজারে হাছন রাজা হইয়াছে লয়/তুমি বিনে হাছন রাজায় কিছু না দেখয়’। নশ্বর মানবজীবনকে হাছন রাজা বন্দিশালা মনে করেছেন : ‘মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়া রে/কান্দে হাসন রাজার মন মনিয়া রে/মায়ে বাপে বন্দী কইলা, খুশির মাঝারে/লালে ধলায় বন্দী হইলাম, পিঞ্জিরার মাঝারে/উড়িয়া যায় রে ময়না পাখি, পিঞ্জিরায় হইল বন্দি/মায়ে বাপে লাগাইলা, মায়া জালের আন্দি’। কিন্তু দীন-হীন হাছন এ বন্দিদশা কাটিয়ে উঠতে না পেরে ব্যথাতুর হৃদয়ে বলেন : ‘পিঞ্জিরায় সামাইয়া ময়নায় ছটফট করে/মজবুত পিঞ্জিরা ময়নায়, ভাঙ্গিতে না পারে’। আর এজন্যেই মুক্তির অপেক্ষায় স্রষ্টার পদতলে তিনি নিজেকে সমর্পণ করেন : ‘গুরুর উপদেশ শুনিয়া হাছন রাজায় কয় হায়রে হাছন রাজায় কয়/সব তেয়াগিলাম আমি, দেও পদাশ্রয়...’। অন্যত্র হাছন বলছেন : ‘ছাড় ছাড় হাছন রাজা, এ ভবের আশা হায়রে এ ভবের আশা/প্রাণবন্ধের চরণতলে, কর গিয়া বাসা রে হাসন রাজা’।
কিন্তু জীবন-সায়াহ্নে উপনীত হয়ে সাধন-ভজন বিহীন ও অনুতপ্ত হাছনের মনের খেদ : ‘দিন গেলে হেলে-দুলে রাত্রি গেল নিন্দে/ফজরে উঠিয়া হাছন হায় হায় করি কান্দে’। রবীন্দ্রনাথের রচনাতেও পাওয়া যায় সময়ের সংক্ষিপ্ত সীমায় বন্দি মানবজীবনের আকুতি : ‘সকাল আমার গেল মিছে,/বিকেল যে যায় তারি পিছে গো-/রেখো না আর, বেঁধো না আর কূলের কাছাকাছি’। আর লালন-হাছনের মতো কবিগুরুও জীবনতরী পারাপারের জন্যে অপেক্ষমান : ‘মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা’।
একটি বিষয় এখানে লক্ষ্যণীয়- ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে হাছন রাজা স্পষ্টতই অস্বীকার করেছেন। ফলে তথাকথিত কোনো ধর্মগুরুকে তিনি ঈশ্বরলাভের মাধ্যম হিসেবে ধরতে চাননি বরং সরাসরি ‘আল্লাহ’র সাথে সম্পর্ক স্থাপনের সুফিবাদী চিন্তাই তিনি লালন করেছেন। এছাড়া ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি বৈষ্ণব ধর্ম ও সাহিত্য, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রচারিত মানবপ্রেমের বার্তা, রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়োপাখ্যান ও মারফতি ভাবধারাসহ নানা ভাবাদর্শে হাছন প্রভাবিত হয়েছেন। আর এ সবকিছুরই প্রভাব পড়েছে হাছন রাজার সৃষ্টিকর্মের ছত্রে ছত্রে।
বিবেকানন্দের মতো হাছন রাজাও প্রেমকে মানুষের ঈশ্বরলাভের পথ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন; হাছনের মতেও প্রেমের মাধ্যমেই মানবজীবনের চূড়ান্ত গতিপ্রাপ্ত হওয়া যায় : ‘খোদা মিলে প্রেমিক হইলে/... অন্য পন্থে না যাইয়া, প্রেমপন্থে গেলে/পাইবায় পাইবায় খোদা হাছন রাজায় বলে’ কিংবা ‘প্রেমের বাজারে বিকে মানিক ও সোনা রে/... হাছন রাজা প্রেমবাজারে গিয়ে হইলো ফানা’। মহাপ্রকৃতি বা উচ্চতর সত্তার সাথে মিলিত হওয়ার জন্যে তথা হাছনের ভাষায় ঈশ্বরদর্শনের জন্যে মানবজীবনে প্রেমের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলছেন : ‘পিরীত করিয়ে, পিরীত করিয়ে মোর মন উদাসী/পিরীত আজব চিজ্ জগতের প্রধান/পিরীত কর প্রেমিকেরা, ছাড়িয়ে কুল মান/পিরীত রত্ন কর যত্ন, পিরীতি জানিয়া সার/পিরীত ভাবে পাইবায়, বন্ধুয়ার দিদার’।
সৃষ্টি ও স্রষ্টা কিংবা জীবাত্মা ও পরমাত্মাকে একীভূত করার অন্তহীন বাসনা দেখা যায় মরমী কবিদের সৃষ্টিকর্মে। ফলে মরমী সাধক হাছন রাজা স্বভাবতই সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে যেমন ভেবেছেন, তেমনি ভেবেছেন জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলন নিয়েও। সেই মিলনের আকাঙ্ক্ষাই একজন সাধকের মধ্যে একের ভেতরে দুই আবার দুইয়ের ভেতরে একের অস্তিত্ব নিয়ে আসে। এ প্রসঙ্গে হাছনের উপলব্ধি : ‘রূপ দেখিলাম রে নয়নে আপনার রূপ দেখিলাম রে/আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে’।
স্রষ্টার সাথে হাছন রাজার প্রেমের এই গভীরতাকে উপলব্ধি করে হাছন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূল্যায়ন ছিলো : “এই সাধক কবি দেখিতেছেন যে, শাশ্বত পুরুষ তাঁহারই ভিতর হইতে বাহির হইয়া তাঁহার নয়নপথে আবির্ভূত হইলেন। বৈদিক ঋষিও এমনইভাবে বলিয়াছেন যে, যে পুরুষ তাঁহার মধ্যে তিনিই আদিত্যমণ্ডলে অধিষ্ঠিত।” ফকির লালন সাঁইকে রবীন্দ্রনাথ লোকজ দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন; একইভাবে হাছন রাজার দর্শনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশ-বিদেশে নানা বক্তৃতায় নানা প্রসঙ্গে হাছনের মতাদর্শও তুলে ধরেছেন।
চলবে...