By সজীব সরকার
মানুষ : একটি দার্শনিক বিচার - ৫
Media School March 11, 2021

ব্রিটিশ দার্শনিক ও ইতিহাসবেত্তা বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০) মানবস্বভাবকে বিজ্ঞান দিয়ে মাপতে চেয়েছেন। তাঁর মতে, বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ এখন জগতের অনেক বিষয় সম্বন্ধে অনেককিছুই জানতে পেরেছে, তবে নিজের প্রকৃতি সম্পর্কেই মানুষ এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম জানে। রাসেল বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান যদি মানবপ্রকৃতিকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়, তাহলে সে মানুষের জীবনে সুখ এনে দিতে পারবে। তিনি মনে করেছেন, মানবপ্রকৃতির স্বরূপ উপলব্ধিকে মানুষের জীবনের প্রকৃত পরিবর্ধনের মূল বা ভিত্তি হিসেবে দেখা জরুরি।
বাংলার লোকায়ত দর্শনে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের অনেক দর্শনেরই মেলবন্ধন ঘটেছে। এখানে অস্তিত্ববাদ, বিনির্মাণবাদ, সংশয়বাদ, ধর্মীয় দর্শন বা ঈশ্বরবিশ্বাসের পাশাপাশি সুফিবাদ বা অধ্যাত্মবাদের মতো অনেক দর্শনেরই নির্যাস রয়েছে। তবে এ দর্শনে শেষ পর্যন্ত মানুষ এবং মানবজীবনের গতিপ্রকৃতিই মুখ্য হয়ে উঠেছে।
বাউল দর্শনে আত্মার মতোই ‘দেহতত্ত্ব’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাউল দর্শন একেবারেই আচরিক ধর্মে বিশ্বাসী নয়; বাউলরা স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি প্রেমকে ধর্ম মনে করে এই প্রেমের বদৌলতেই ‘ভবপার’ হতে চান। শ্রীচৈতন্যদেব প্রচারিত উদার বৈষ্ণবধর্মে মানবতাবাদের যে দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে, তার সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে বাউলধর্মে।
আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক লালন সাঁই (১৭৭৪-১৮৯০) ছিলেন একজন মানবতাবাদী সাধক। প্রচলিত ধর্ম-বর্ণ-গোত্রসহ সব সব ধরনের জাতিগত বিভেদ থেকে তিনি দূরে থেকেছেন এবং মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। লালন নিজে হিন্দু ছিলেন নাকি মুসলমান, এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। লালনের জীবনীকার বসন্তকুমার পাল লালনকে হিন্দু বলে উল্লেখ করেছেন। একই মত দিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গবেষক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও অন্নদাশঙ্কর রায়সহ অনেকে। অবশ্য কবি জসীমউদ্দীন এবং লোকসঙ্গীত, লোকসাহিত্য সংগ্রাহক ও লোকসাহিত্যবিশারদ মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনসহ অন্য অনেকে লালনকে ‘ধর্মান্তরিত মুসলমান’ বলে মতামত দিয়েছেন।
লালন নিজে অবশ্য তাঁর জাত-পাতকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি; তিনি নিজের গানে লিখেছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/লালন কয় জাতের কি রূপ/দেখলাম না এই নজরে।’ ফকির লালনের মৃত্যুর পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক হিতকরী পত্রিকার ১৮৯০ সালের ৩১ অক্টোবর সংখ্যায় লেখা হয়, ‘লালন নিজে কোনো সাম্প্রদায়িক ধর্মাবলম্বী ছিলেন না; অথচ সকল ধর্মের লোকেই তাঁহাকে আপন বলিয়া জানিত।’ লালন গবেষক ড. আবদুল ওয়াহাবের মতে, হিতকরীর ওই সংখ্যায় লালন সম্পর্কে এক লেখায় তাঁকে ‘মহাত্মা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ বিচারে উপমহাদেশে গান্ধী নন বরং লালনই প্রথম ‘মহাত্মা’ উপাধি পান।
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী লালনের উদার মানবতাবাদী দর্শন তাঁর রচনার ছত্রে ছত্রে প্রকাশিত হয়েছে। ফকির লালনের দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও অ্যালেন গিন্সবার্গসহ খ্যাতনামা অসংখ্য কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিল্পীসহ আরো অনেকে।
লালন সাঁইয়ের দর্শনে মানুষ গুরুত্বপূর্ণ; সেই সঙ্গে সাধন-ভজনকে মানুষের পক্ষে সর্বোচ্চ পথ হিসেবে দেখা হয়েছে। লালন ফকির একাধারে জাত-পাতের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং ‘মানুষ’ পরিচয়কে সত্য হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে প্রথাগত ধর্ম ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। যেমন তিনি লিখেছেন : ‘জাত গেল জাত গেল বলে/একি আজব কারখানা/সত্য কাজে কেউ নয় রাজি/... যখন তুমি ভবে এলে/তখন তুমি কী জাত ছিলে/যাবার বেলায় কী জাত নিলে/... ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল চামার-মুচি/একই জলে সব হয় শুচি/... লালন বলে জাত কারে কয়/এই ভ্রমও তো গেল না’। সিসেরো, মেনসিয়াস বা বুদ্ধের মতো লালনও বিশ্বাস করেছেন, মানুষই উৎকৃষ্ট সত্তা; তাই লালন গেয়েছেন : ‘এমন মানব জনম আর কি হবে/...অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই,/শুনি মানব রূপের উত্তম কিছুই নাই/দেব-দেবতাগণ,/করে আরাধন/জনম নিতে মানবে...’)। সম্ভবত এজন্যেই লালন আস্থার সাথে বলতে পেরেছেন, ‘এই মানুষে হবে মাধুর্য্য ভজন’।
তবে মানবজীবন যে নশ্বর, এই উপলব্ধি বুদ্ধ কিংবা অন্য চিন্তকদের মতো লালনকেও ভাবিয়েছে। এজন্যে তাঁর মনের শঙ্কা : ‘পাখি কখন জানি উড়ে যায়/একটা বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়’। জীবনের নশ্বরতাকে তিনি ব্যাখ্যা করছেন : ‘খাঁচার আড়া পড়লো ধসে/পাখি আর দাঁড়াবে কিসে/ঐ ভাবনা ভাবছি বসে/চমক জ্বরা বইছে গায়’। অন্যত্র বলছেন : ‘মন, তুই রইলি খাঁচার আশে/খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে/কোনদিন খাঁচা পড়বে খসে/লালন কেঁদে কয়’।
নশ্বর এই জীবনের প্রতি ঝোঁক বা জাগতিক সুখভোগের মোহ লালনকে ভাবিয়েছে। জাগতিক মোহমায়ার ভ্রম ভাঙ্গার পর লালন বলছেন : ‘কার বা খাঁচায় কেবা পাখি/কার জন্য মোর ঝরে আঁখি/আমার এই আঙ্গিনায় থাকি/আমারে মজাইতে চায়’। একসময় তিনি উপলব্ধি করেছেন, জড়-জাগতিক সুখভোগ নশ্বর জীবনের পথ নয় : ‘আগে যদি যেত জানা/জংলা কভু পোষ মানে না/তবে উহার প্রেম করতাম না/লালন ফকির কেঁদে কয়’। আর লালন নশ্বর এই মানবজীবনের পরমগতি হিসেবে লক্ষ্যস্থির করেছেন ঈশ্বরদর্শনকে যা ভাষান্তরে আসলে পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার মেলবন্ধন। ফলে লালনের গানেও উৎকৃষ্ট সত্তার সাথে সম্মিলনের এই আকুলতা বা বাসনা সুস্পষ্ট হয়েছে। লালন সেই মিলনের বাসনায় বলছেন : ‘মিলন হবে কত দিনে/আমার মনের মানুষের সনে’। লালনের ‘মনের মানুষ’ এখানে সেই উৎকৃষ্ট সত্তা, নানা বিচারে যে পরমাত্মা কিংবা ঈশ্বর। এজন্যে লালন ফকির ভবতরী (নশ্বর জীবন) পার হওয়ার জন্যে সেই ‘ঈশ্বরের’ প্রতি নিষ্ঠাকেই পাথেয় মনে করেছেন : ‘পারে কে যাবি নবির নৌকাতে আয়/রূপকাষ্ঠের নৌকাখানি নাই ডুবার ভয়’। অন্যত্র তিনি বলছেন : ‘কবে সাধুর চরণধুলি, মোর লাগবে গায়’।
তবে এই মিলন বা ঈশ্বরদর্শন যে কঠিন ব্যাপার, তা লালনের বোধের বাইরে নয়; তাই তিনি আক্ষেপ করেছেন : ‘পাবে সামান্যে কি তার দেখা/বেদে নাই যার রূপরেখা/... নিরাকার ব্রহ্ম হয় সে/সদাই ফেরে অচিন দেশে’। ঈশ্বর সম্বন্ধে এমন মূল্যায়নে এক অতীন্দ্রিয়বাদী লালনের সন্ধান মেলে। আর সাধনা ছাড়া যে এই মিলন সম্ভব হবে না, তা তিনি ঠিক বুঝেছিলেন। তাই লালনের স্বীকারোক্তি : ‘ভজন সাধন আমাতে নাই/কেবল মহৎ নামের দেই গো দোহাই’। লালনের আশঙ্কা : ‘শুনেছি সাধুর করুণায়/সাধুর চরণ পরশিলে হয় গো সোনা/বুঝি আমার ভাগ্যে তাও হলনা/ফকির লালন কেঁদে কয়’। এই উপলব্ধি পরবর্তী সময়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ মরমী সাধক হাছন রাজার (১৮৫৪-১৯২২) মধ্যেও দেখা যায়।
অন্য অনেক দার্শনিক-চিন্তকের মতো লালন নিজেও মানুষের চেয়ে উচ্চতর বা পরম এক সত্তার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। প্রথমত : তিনি বিশ্বাস করেছেন, এক পরম সত্তার হাতেই মানুষের সৃষ্টি (‘অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই’ কিংবা ‘... মানব রূপ গঠলেন নিরঞ্জন’) এবং দ্বিতীয়ত : তিনি ওই পরম সত্তার কাছে বার বার আত্মসমর্পণ করেছেন এবং তাতে বিলীন হতে চেয়েছেন (‘আমি অপার হয়ে বসে আছি/ওহে দয়াময়/পারে লয়ে যাও আমায়’)।
তবে এখানে লক্ষ্যণীয় হলো, বিভিন্ন মতবাদের মিশ্রণে গড়ে ওঠা বাউল মতের ভাবাদর্শের অনুসারীরা নিরাকার ও আসমানি কোনো সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী নন। বাউলদের বিশ্বাস, মানুষের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তা আসীন; তাই মানুষ ভজলেই ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করা সম্ভব। ফলে স্বাভাবিকভাবেই লালনের মধ্যে সুফিবাদের প্রভাব রয়েছে; তিনিও মানুষের বোধের বাইরে আসমানি কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস না করে আস্থা স্থাপন করেছেন মানুষের ভেতরে বাস করা ঈশ্বরেই। লালন উপলব্ধি করেছেন : ‘যেই মুর্শিদ সেইতো রাসুল/ইহাতে নাই কোন ভুল/খোদাও সে হয়/লালন কয় না এমন কথা কোরানে কয়’। উল্লেখ্য, একইভাবে আরেক বাউল শাহ আব্দুল করিম (১৯১৬-২০০৯) স্পষ্টভাবে বলেছেন, তিনি কখনোই আসমানি খোদাকে মান্য করেন না; মানুষের মধ্যে যে খোদা বিরাজ করে, তিনি তারই পূজারি।
অর্থাৎ দেহের (বডি) আধারে যে চেতনা (মাইন্ড) বিরাজ করছে, বাউলধর্মে সেটিই আত্মা (সোল)। এই আত্মার সন্ধানই হচ্ছে বাউল মতবাদের প্রধান লক্ষ্য। আর এই আত্মার সন্ধানই লালনের সকল সাধন-ভজনের মূল লক্ষ্য। নিজের মধ্যেই তিনি ঈশ্বরকে খুঁজেছেন : ‘বাড়ির কাছে আরশী নগর/সেথা পড়শী বসত করে/আমি একদিনও না দেখিলাম তারে/... বাঞ্ছা করি দেখব তারে/কেমনে সেথা যাই রে’। এই ঈশ্বরদর্শন তথা পরমাত্মার সাথে মিলনেই লালন সুখ খুঁজেছেন : ‘পড়শী যদি আমায় ছুঁতো/যম-যাতনা সকল যেতো দূরে’। কিন্তু নিজের মধ্যেই বিরাজমান ঈশ্বরের সন্ধান লাভ যে কঠিন আর এ দুইয়ের মধ্যে দূরত্ব পার করা যে কঠিন, তা লালনের আকুলতা থেকেই স্পষ্ট হয় : ‘সে আর লালন একখানে রয়/(তবু) লক্ষ যোজন ফাঁক রে’। অর্ধাৎ দেহের সাথে আত্মার এই মিলন কাঙ্ক্ষিত ও অপরিহার্য হলেও এর সাফল্য নিয়ে লালনের মনের সংশয় সবসময় তাঁকে আন্দোলিত করেছে যা বারবারই তাঁর গানে স্পষ্ট হয়েছে।
চলবে...