By সজীব সরকার
মানুষ : একটি দার্শনিক বিচার - ১
Media School February 28, 2021
‘আমি কে? আমি কোথা থেকে এসেছি? কেন এসেছি? মৃত্যুর পর আমি কোথায় যাবো?’
বিবর্তনের ধারায় বন্য পশু থেকে মানুষ যখন থেকে চিন্তাশীল প্রাণী হয়ে উঠতে শুরু করলো, তখন থেকেই সে এই প্রশ্নগুলো নিজেকে করতে শিখেছে। একসময় অনুমান ও অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে। একসময় তা দর্শনশাস্ত্রের আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। পরে যখন একেকটা করে ধর্মের উৎপত্তি হলো, তখন ওইসব ধর্মের বিশ্বাস থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞান এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের চেষ্টা করছে যুক্তি ও প্রমাণের আলোকে। তবে, কোনো উত্তরই আজ অবধি সব মানুষের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সম্ভবত একরৈখিক এসব উত্তরকে প্রত্যাখ্যান করতে পারার এই সক্ষমতা তথা এই সংশয়বাদই (স্কেপটিসিজম) মানুষকে অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা করেছে!
দর্শনের মানুষ, মানুষের দর্শন
রাশান সাহিত্যিক লেভ তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০) সবসময় জীবনের সত্যসন্ধান করেছেন। মানুষ-জীবন-মৃত্যু-ঈশ্বর ইত্যাদি প্রসঙ্গে সবসময় প্রশ্নাকুল থেকেছেন তিনি। ছোটবেলায় তাঁর এক নোটবুকের এক পাতায় তিনি লিখেছিলেন ৬টি প্রশ্ন : এক. আমি কেন বেঁচে আছি? দুই. আমার অস্তিত্বের কারণ কী? অন্যেরই বা বেঁচে থাকার কী কারণ? তিন. আমার বা আরো অনেকের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য কী? চার. আমার ভেতরকার শুভ-অশুভ শক্তির তাৎপর্য বা উদ্দেশ্য কী? পাঁচ. আমাকে কীভাবে বেঁচে থাকতে হবে? ছয়. মৃত্যু কী? কেমন করে তার হাত থেকে বাঁচা যায়?
একসময় তলস্তয় উপলব্ধি করেন, মৃত্যুই হলো জীবনের একমাত্র সত্য। তিনি এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, শিল্প-বিজ্ঞান-দর্শন কোনোটিই জীবনের অর্থ তৈরি করতে পারে না; যুক্তির বিপরীতে স্থির বিশ্বাসের মাধ্যমেই জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, তলস্তয়ের এই শেষ প্রশ্নটির (কেমন করে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচা যায়) সমাধান মেলে মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবন থেকে; জন্ম ও মৃত্যুর চক্র থেকে নিজেকে মুক্ত করার মাধ্যমেই ভগবান বুদ্ধের নির্বাণলাভ ঘটে।
শুধু তলস্তয় নন, যুগে যুগেই এ নিয়ে ভেবেছেন নানা মত-পথের মানুষ। চার্লস ডারউইন, রিচার্ড ডকিন্স, স্টিভেন পিনকার বা প্যাট্রিক ফ্রিয়ারসনসহ অনেক মনীষী মানুষের প্রকৃতি নিয়ে ভেবেছেন। আচরণ বিশ্লেষণ করে মানুষকে বোঝার চেষ্টা করেছেন কার্ল মার্ক্স, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ বা রুথ বেনেডিক্টের মতো চিন্তকেরা। মানুষকে দার্শনিক প্রেক্ষাপটে বিচার করেছেন ফ্রেডরিখ নীৎশে, মার্টিন হাইডেগার, জ্যঁ-পল সার্ত্র, মিশেল ফুকো, জর্জ এডওয়ার্ড মুর, থমাস কুন, ক্রিস্টিন কর্সগার্দ এবং অ্যালাসদেয়ার ম্যাকইনটায়ারের মতো দার্শনিকেরা।
প্রাচীন রোমান দার্শনিক সিসেরো (১০৬-৪৩ বিসি) মনে করতেন, প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষ একটি বিশেষ অবস্থানে রয়েছে কেননা মানুষ হলো মহাবিশ্বের দিব্য শৃঙ্খলার আশীর্বাদপুষ্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মধ্যে যুক্তি ও বাকশক্তির যৌথ উপস্থিতি আসলে এই দিব্য শক্তিরই প্রতিফলন। সিসেরোর মতে, মানুষ এ থেকে মৌলিক তিনটি ক্ষমতা পেয়েছে : এক. মানুষ স্মরণশক্তির অধিকারী হয়েছে যার প্রয়োগ ঘটিয়ে সে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে প্রভাবিত বা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে; দুই. যুক্তিবোধের অধিকারী হওয়ায় মানুষ নিজের ব্যবহার বা আচরণকে সংযত বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে; এবং তিন. মানুষের মধ্যে রয়েছে সত্যের সন্ধান করার এক অমিত তাড়না। মানুষের এই তিন ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সিসেরো শেষটিকেই (সত্য সন্ধানের তাড়না) সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন।
সিসেরোর মতোই চীনা দার্শনিক কনফুশাস (৫৫১-৪৭৯ বিসি)-এর ভাবনাতেও আধ্যাত্মিকতার প্রভাব লক্ষ করা যায়। কনফুশাস ‘স্বর্গের’ ধারণায় বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর মতে মানুষের জীবনে স্বর্গের তথা ঐশী প্রভাব রয়েছে। তবে কনফুশাসের স্বর্গের ধারণা আর প্রচলিত ধর্মগুলোতে উল্লেখ করা স্বর্গ ঠিক এক নয়; কনফুশাসের স্বর্গ মূলত ‘নিয়তি’। কনফুশাসের কাছে নিয়তি হলো এমনসব বিষয় বা ঘটনা যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। তাঁর মতে, নিয়তি এমন একটি দৈব বিষয় যা মানুষের প্রতীতির বাইরে। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের জীবন নিয়তির ছকে বাঁধা বটে কিন্তু দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে এই ‘দৈব শক্তি’ কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করে না। সম্ভবত এজন্যেই কনফুশাস স্থির বিশ্বাসের সাথে বলতেন, ‘আমার কাজগুলো শেষ হওয়ার আগে আমার মৃত্যু হবে না’।
কনফুশাসের দর্শনে মানুষকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই দর্শনের বিশ্বাস হলো, মানুষ একা বাস করতে পারে না; তাকে অন্যদের সাথে মিলে-মিশে বাঁচতে হয়। আর মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ব্যক্তির সুখের সন্ধান। আর এই সুখলাভের উপায় হলো শান্তি তথা পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।
কনফুশাস মানুষকে নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেই নৈতিকতা ও সদাশয়তা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তিনি মনে করতেন, মানুষের উচিত চর্চার মাধ্যমে ওই সদগুণগুলোকে নিজের ভেতর প্রতিষ্ঠা করা। আর তিনি মনে করতেন, উপচিকীর্ষা বা পরহিতৈষণার মাধ্যমে এই কাজটি করা সম্ভব। এই পরহিতৈষণা কনফুশাসের কাছে নৈতিকতারই নামান্তর যার ফল হলো নির্মল আনন্দ।
অনেক দার্শনিক মানুষের জীবনকে নৈতিকতার (মোরালিটি) সমষ্টি হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। কেউ কেউ আবার নৈতিকতাকে মানুষের জীবনের লক্ষ্য বা জীবনধারণের উপায় হিসেবে দেখিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে নৈতিকতার এ ব্যাখ্যা শেষ পর্যন্ত কেবল ভালো আর মন্দের গণ্ডিতে সীমিত হয়ে পড়ে। তবে কনফুশাসের দর্শনে কেবল ভালো আর মন্দের বোধ স্বপ্রতিষ্ঠিত বা পর্যাপ্ত নয়; এখানে নৈতিকতা বা নৈতিক বোধের অনুগামিতাও সমান্তরালভাবে উপস্থিত। কেননা কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ - এর চূড়ান্ত বিচার বা উত্তর খোঁজা এখনো দর্শনশাস্ত্রের একটি বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
প্রাচ্য ও প্রতীচ্য - উভয় প্রেক্ষাপটেই চিন্তাবিদদের মধ্যে ভালো-মন্দের একরৈখিক বা সরলরৈখিক বিচারপ্রক্রিয়ায় অনাস্থা দেখা যায়। এই যেমন এ বিষয়ে শেক্সপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬) মনে করেছেন, ভালো আর মন্দ বলে কিছু নেই; সবই হচ্ছে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। লেবানিজ কবি কাহলিল জিবরান (১৮৮৩-১৯৩১) এবং পারস্যের সুফি কবি মাওলানা জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি (১২০৭-১২৭৩) একই মত ব্যক্ত করেছেন। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৪) বরাবরই ঠিক-ভুল কিংবা স্বাভাবিকতার মতো প্রত্যয়ের সংজ্ঞা নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় অনাস্থা প্রকাশ করেছেন।
কনফুশাসের দর্শনে বলা হয়েছে, মানুষ চারটি মৌল বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায় : এক. অন্যের মঙ্গলচিন্তা, দুই. মর্যাদার বোধ, তিন. বিনয়ের বোধ এবং চার. ভালো ও মন্দের বোধ। এই চারটি বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে যথাক্রমে এই চারটি সুকৃতি বা সদগুণের জন্ম দেয় : পরার্থবাদিতা, ন্যায়পরায়নতা, স্বাতন্ত্র্য ও প্রজ্ঞা। কনফুশাসের দর্শনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো এসব গুণ অর্জন এবং এদের চর্চার মাধ্যমে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আত্মোন্নয়ন ও সামষ্টিক উন্নয়ন। কনফুশাস মানুষের জীবনে শিক্ষার ভূমিকাকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন; তিনি মনে করতেন, একজন শিক্ষকের মূল দায়িত্ব হলো মানুষকে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠতার সাথে জীবনযাপন করতে শেখানো।
এভাবে কনফুশাসের অনুসারীদের কাছে তাঁর দর্শন একটি শান্তিকামী ধর্ম হয়ে উঠেছে। তবে এই ধর্ম প্রচলিত অন্য ধর্মগুলোর মতো কোনো অতিপ্রাকৃত (সুপারন্যাচারাল) শক্তি কিংবা ঈশ্বর বা দেবতাকেন্দ্রিক নয়। কনফুশাসের নির্দেশনা হলো- মানুষ নিয়ে ভাবতে হবে, মানুষের অবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে; ঈশ্বর বা দেবতা নিয়ে ভেবে বিচলিত হওয়ার কোনো দরকার নেই। তিনি জীবন নিয়ে ভাবতে বলেছেন, মৃত্যু নিয়ে নয়। তাঁর দর্শন হলো, সমাজের সব মানুষ একে অন্যের জন্যে মঙ্গলজনক হবে; সবাই সবার কাছ থেকে উপকারভোগী হবে। নৈতিকতার মধ্যে থেকে জ্ঞান, পরোপকার, বিশ্বস্ততা আর সদগুণের সমন্বয়ে জীবনধারণকেই কনফুশাস মানবজীবনের পথ বলে ভেবেছেন। তাঁর এই দর্শন থেকে প্লেটো (৪২৮/৪২৭-৩৪৮-৩৪৭ খ্রিস্টপূর্ব), অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্ব), লক (১৬৩২-১৭০৪) বা হবস (১৫৮৮-১৬৭৯) - এঁদের ধারণা মোটেও দূরবর্তী নয়।
চলবে...