Media School

Dhaka    Thursday, 21 November 2024

By সজীব সরকার

ভাষায় জেন্ডার পলিটিকস

Media School May 17, 2024

প্রতীকী ছবি।

মানুষ তার ভাবনা-চিন্তাকে প্রকাশ করে নানা রকমের শব্দ কিংবা শব্দবন্ধ দিয়ে, বাক্য দিয়ে। এই বিষয়টিই যদি একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবা যায়, তাহলে এর অর্থ দাড়ায়- একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা বিশ্লেষণ করলে ওই গোষ্ঠীর মানুষদের চিন্তা-চেতনা অর্থাৎ মনের গড়ন-গঠনের খবর মিলবে।

পৃথিবীর সব মানুষকে বোঝাতে বাংলায় ‘মানবজাতি’ বা ইংরেজিতে ‘ম্যানকাইন্ড’ শব্দটি যখন তৈরি হলো, তখন ‘মানবী’ অথবা ‘উইমেন’ কিংবা সমাজের অন্য সদস্যদের প্রতিনিধিত্বের কথা কি ভাবা হয়েছে? হয়নি। ভাবা হতো যদি, তাহলে এ ধরনের কালেক্টিভ বা সামষ্টিক শব্দে তাদেরও উল্লেখ করা হতো অথবা বিশেষ কাউকে উল্লেখ না করে একেবারেই নিরপেক্ষ একটি শব্দ নির্মাণের কথা ভাবা হতো। সমাজে সব মানুষের মিলেমিশে থাকা বোঝাতে ‘ভ্রাতৃত্ব’ কিংবা ‘ভাই-ভাই’ বললে পুরুষ ছাড়া অন্য সবাই বাদ পড়ে যায় না কি?

বাংলায় রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, সভাপতি, দলপতি, দলনেতা বা পূর্বপুরুষ কিংবা ইংরেজি ভাষার শব্দ ফোরফাদার, চেয়ারম্যান, স্পোর্টসম্যান, অ্যাংকরম্যান, বিজনেসম্যান, ব্যাটসম্যান, পোস্টম্যান, মেইলম্যান, ক্লার্জিম্যান, কংগ্রেসম্যান, স্পোকসম্যান - এখানে শব্দনির্মাতাদের মনোজগতে পুরুষের প্রতি পক্ষপাত প্রবলভাবে দৃশ্যমান। অন্যদিকে আয়া, বুয়া, রাঁধুনি, নার্স, মেইড - এসব শব্দ নারীর কাছে সমাজের প্রত্যাশা এবং সমাজের (পুরুষের) কাছে নারীর মূল্য ও মূল্যায়নের ধারণাটিও স্পষ্টভাবেই তুলে ধরছে। তাহলে, ভাষা নিছক মনের ভাব কিংবা সংস্কৃতির অনুষঙ্গই নয়; ভাষা একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারও বটে! এ রাজনীতি মানুষের সঙ্গে মানুষের; এ রাজনীতি ঘরেরও, বাইরেরও।

প্রতিনিধিত্বশীল এসব শব্দে পুরুষের অন্তর্ভুক্তি আর নারীর বিযুক্তি নিছক দৈব (র্যান্ডম) বা নিরীহ ভুল নয়; নারীর এ বিযুক্তি অত্যন্ত সচেতন ও উদ্দেশ্যমূলক। সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যে মূলত ক্ষমতার সম্পর্ক, এই চর্চারই ফল ও বহিঃপ্রকাশ ভাষার মধ্যে এমন রাজনীতি। এজন্যে ভাষা তথা দৈনন্দিন যোগাযোগে ব্যবহৃত প্রতিটি শব্দের ব্যক্তার্থ (ডিনোটেশন) ও গূঢ়ার্থ (কনোটেশন) বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

যে কথা দিয়ে বর্তমান লেখাটির শুরু : ভাষার সঙ্গে মানুষের মনের যোগসাজশ। একটি জনগোষ্ঠীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক চর্চার প্রতিফলন ঘটে ভাষার মধ্যে। অর্থাৎ, কথা বলার সময় আমরা কেমন শব্দ-বাক্য ব্যবহার করি, তাতে সমাজে বিদ্যমান সামষ্টিক চিন্তা-চেতনা বা সমাজের মানুষের ভাবনাগুলো ফুটে ওঠে। অন্যদিকে আবার, প্রচলিত শব্দ-বাক্য-ভাষা মানুষের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াতেও সরাসরি প্রভাব ফেলে; প্রচলিত শব্দ-বাক্য-ভাষা থেকেও মানুষ অনেককিছু শেখে। এ কারণে, জেন্ডার সংবেদনশীল সমাজ নির্মাণের কথা যখন বলা হচ্ছে, তখন সর্বক্ষণের সঙ্গী ভাষার ব্যাপারেও সতর্ক হওয়া দরকার।

বাংলা ভাষায় জেন্ডার অসংবেদনশীল শব্দের প্রাচুর্য রীতিমতো আশঙ্কাজনক। এ ভাষার মধ্যে বিশেষ করে নারীবিরোধী বা নারী-বিদ্বেষী অনেক শব্দ ও প্রবাদ-প্রবচন রয়েছে। আমাদের লোকজ সাহিত্য বা সংস্কৃতির অন্য অনুষঙ্গগুলোও একই দোষে দুষ্ট। লোকজ সাহিত্যের বলয়ের বাইরে ‘শিক্ষিত সমাজের’ জন্যে যে তথাকথিত ‘উঁচু মানের’ সাহিত্য কিংবা আধুনিক সাহিত্য, সেগুলোও এ দোষ থেকে মুক্ত নয়। বিশেষ করে রম্যসাহিত্যে নারীর অবমাননা রীতিমতো সীমা ছাড়িয়েছে; ব্যাপারখানা এমন, যেন নারীকে হেনস্তা করাই সাহিত্যে রস যোগ করার একমাত্র উপায় (না কি উদ্দেশ্য!)। নারীর নিন্দা ছাড়া তাই সাহিত্যে রম্য তথা রস জমে না!

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির এসব উপকরণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নারীকে মূলত দুর্বল, কল্পনাবিলাসী, আবেগপ্রবণ ও যুক্তিহীন, বুদ্ধিহীন, পুরুষের ওপর নির্ভরশীল এবং অনিষ্টকারী সত্তা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এসব উপাদানে নারীর গতিবিধি বা চলাফেরাকে (মোবিলিটি) নিয়ন্ত্রণ বা সীমিতও করা হয়েছে।

প্রাসঙ্গিক কিছু উদাহরণ বিশ্লেষণ করে আলোচনা করা যাক। বাংলা ভাষায় ‘নারী’ শব্দের অনেকগুলো প্রতিশব্দ রয়েছে; এর মধ্যে একটি হলো ‘মহিলা’। অভিযোগ রয়েছে, ‘মহল’ থেকে মহিলা শব্দটির উৎপত্তি। অর্থাৎ মহলে (ঘরে) থাকে বা থাকবে যারা, তারা হলো মহিলা। একই ধরনের আরেকটি শব্দ হলো ‘অসূর্যস্পশ্যা’ বা ‘অসূর্যস্পর্শা’; এর অর্থ হলো, যে নারীকে সূর্যের আলোও কখনো স্পর্শ করেনি। অর্থাৎ, ‘মহিলা’ ও ‘অসূর্যস্পর্শা’ - এই দুটি শব্দ দিয়েই বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে নারীরা ঘরেই (বন্দি) থাকবেন- তারা বাইরে বোরোবেন না। এই দুটি শব্দের কোনো পুরুষবাচকতা বাংলা ভাষায় পাওয়া যায় না।

নারীর আরেকটি প্রতিশব্দ হলো ‘রমণী’। যার সঙ্গে ‘রমণ’ (যৌনক্রিয়া বা সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স) করা হয় বা করা যায়, সে হলো রমণী। অর্থাৎ নারীর পরিচয় আমরা গড়ে তুলছি যৌনতার বিচারে, যেখানে নারীকে স্পষ্টত ও মূলত ‘যৌনবস্তু’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। নারী শব্দের আরেকটি প্রতিশব্দ হলো ‘অবলা’; যার (গায়ে) ‘বল’ তথা শক্তি নেই। সন্তানদের নামকরণের বেলায়ও এমন পক্ষপাত : ছেলেদের নাম সাগর, অর্ণব, সূর্য, অর্ক আর মেয়েদের নাম নদী, ঝরনা, চন্দ্রা, শশী বা পূর্ণিমা।

বিবাহিত পুরুষকে তার স্ত্রীর ‘স্বামী’ বলা হয়। স্বামী শব্দের অর্থ হলো মালিক, প্রভু বা অধিকর্তা। অর্থাৎ, সমাজের প্রচলিত রীতি-আচার অনুযায়ী একজন পুরুষ বিয়ের মাধ্যমে একরকমের ‘বৈধভাবেই’ তার স্ত্রীর ‘মালিক’ বা ‘প্রভু’ হয়ে ওঠেন। এর বিপরীতে নারী তাহলে পুরুষের ‘দাস’ হয়ে উঠছে; দুজনের মধ্যে একজন প্রভু হলে অন্যজন তো দাস-ই হয়! আবার, ‘প্রভু’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ হলো ‘প্রভুপত্নী’; অর্থাৎ, প্রভু সবসময়ই কেবল একজন পুরুষ হবে আর নারী বড়জোর প্রভুর পত্নী।

অন্যদিকে, স্বামীর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা-ভক্তিশীল একজন নারীকে ‘পতিপ্রাণা’, ‘পতিগতপ্রাণ’ বা ‘পতিব্রতা’ বলে সম্বোধন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে আসলে নারীকে শেখানো হচ্ছে, তাকে স্বামীর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কিন্তু এর বিপরীতে স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াও একজন পুরুষের পক্ষে জরুরি নয় কি? অথচ এমন নির্দেশনামূলক শব্দ বাংলা ভাষায় নেই। বরং কোনো পুরুষ স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসলে বা স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করলে সমাজ ওই পুরুষটিকে নিন্দা করে ‘স্ত্রৈণ’ বলে; অর্থাৎ, স্ত্রীর (পড়তে হবে : ‘স্ত্রীলোকের’) সঙ্গে বুদ্ধি-পরামর্শ করা, তাদের মতামত নেওয়া বা তাদের বেশি গুরুত্ব দেওয়াটা সমাজের চোখে খারাপ কাজ।

পতি বা স্বামী শব্দের একটি বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘ভাতার’। ভর্ত বা ভাত অর্থাৎ ভরণ-পোষণ দেয় যে (এখানে পুরুষ), সে হলো ভাতার। একইরকম আরেকটি শব্দ হলো ‘প্রোষিতভর্তৃকা’; অভিধানে এর অর্থ : যে নারীর স্বামী প্রবাসে বা বিদেশে থাকে। এর অর্থ তাহলে দাড়াচ্ছে- পুরুষরা দেশে বা বিদেশে থেকে যাদের ভাত যোগায়, তারা হলো নারী। অর্থাৎ, নারীরা ভাত-কাপড়ের জন্যে পুরুষের মুখাপেক্ষী।

এ প্রসঙ্গেই বলতে হয়, ‘গৃহবধূ’ বা ‘গৃহিণী’ শব্দ দিয়ে নারীদের নিষ্ক্রিয়, অন্যের ওপর নির্ভরশীল ও নড়বড়ে একটি পরিচয় দাড় করানো হয়েছে। আর, সারাজীবন একজন পুরুষের সঙ্গে ‘ঘর করার’ পরও সেই ঘরটি কোনোদিন নারীর নিজের (নারীর একার বলছি না) হয় না; একই বাড়িতে বাবা ও মা দুজনের সঙ্গে থেকে এলেও সেটি কেবলই ‘বাপের বাড়ি’ হয়ে থেকে যায়- ওই ঘরে নারীর কোনো অধিকার বা ‘মালিকানা’ জন্মায় না।

এখানে প্রশ্ন করতে হবে : নারীর কি নিজের বা পরিবারের ভাত যোগানোর তথা ভরণ-পোষণের ক্ষমতা নেই? প্রয়োজন নেই? আছে বৈকি; কিন্তু সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নারীকে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে গড়ে তোলার পাকাপোক্ত যে ব্যবস্থা সমাজ তৈরি করতে চায়, এমন শব্দ সেই রাজনীতির নীলনকশারই সহায়ক শক্তি। আর এভাবেই নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্যকে খুব কৌশলে ভাষার মাধ্যমে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই আধিপত্য পুরুষের মধ্যে নারীকে (বা স্ত্রীকে) নিয়ন্ত্রণ এমনকি নির্যাতনেরও অধিকারবোধের জন্ম দেয় আর নারীর মনের মধ্যে গেঁথে দেয় তা মেনে নেওয়ার ‘কর্তব্যবোধ’ ও ‘নিয়তি’।

যৌনতাকে যে নারী তার পেশা অর্থাৎ জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন, তাকে বাংলা ভাষায় আমাদের সমাজে বলা হয় ‘পতিতা’। পতিতা শব্দটির অর্থ হলো যার ‘পতন’ ঘটেছে। সমাজের দৃষ্টিতে এই পতন নৈতিক, চারিত্রিক, ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক... সব দিক থেকেই। শব্দটি আমাদের সমাজে কোনো পেশা হিসেবে নয় বরং ‘গালি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পতিতা তো তবুও বলা যায় বেশ ‘ভদ্রস্থ’ শব্দ; সহজেই ভদ্রসমাজের আলোচনায় এ শব্দটি উচ্চারণ করা যায়। কিন্তু বাংলা ভাষায় এই শব্দের অন্য যেসব প্রতিশব্দ রয়েছে, সেগুলো রীতিমতো অশ্রাব্য ও অরুচিকর এবং ‘ভদ্রসমাজে’ আলোচনা বা এ লেখায় উল্লেখের অযোগ্য। মজার ব্যাপার হলো, যে নারীরা এই সেবাটি প্রদানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন, ‘যৌনকর্মী’ না বলে তাদের আমরা পতিতা বলে গাল-মন্দ করছি; অথচ যে পুরুষরা তাদের কাছে গিয়ে পয়সার বিনিময়ে সেবাটি গ্রহণ করছেন, তাদের ‘পতিত’ না বলে বরং পরিচয় দেওয়া হয় খুব ভদ্র ও নিরীহ শব্দ দিয়ে : বাংলায় ‘খদ্দের’; ইংরেজিতে ক্লায়েন্ট বা কাস্টমার। একই প্রশ্ন ‘রক্ষিতা’ বা ‘বাইজি’ শব্দের ক্ষেত্রেও। সর্বোপরি, নারীকে খারাপ কোনো অর্থে সম্বোধনের জন্যে অভিধানে শব্দের ভাণ্ডার বেশ সমৃদ্ধ হলেও এসবের পুরুষবাচক শব্দ একেবারেই বিরল।

বাংলা ভাষার আরেকটি শব্দ ‘কুলটা’; যে কুল অর্থাৎ বংশের সম্মান নষ্ট করে, সে হলো কুলটা। এই শব্দের আভিধানিক ও প্রায়োগিক অর্থ অনেকগুলো, তবে সবগুলোর সার কথা একই। কুলটার এমন অনেকগুলো অর্থের মধ্যে রয়েছে : ভ্রষ্টা, যে নারী পরকীয়া করে, যে নারী কুল ছেড়ে চলে গেছে, যে নারী স্বামীর সংসার ছেড়ে চলে গেছে এবং অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে - ইত্যাদি। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে খুব কম মেয়েই স্বামীর ঘর ছেড়ে পালায় বা পরকীয়া করে; এর বিপরীতে বরং স্ত্রীকে রেখে স্বামীর পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা বা পরকীয়ার প্রবণতা অনেক বেশি হলেও এমন বিশ্বাসঘাতক স্বামীটির জন্যে ‘কুলটা’র মতো যুৎসই কোনো শব্দ বাংলা অভিধানে পাওয়া যাবে না।

বাবার দ্বিতীয় স্ত্রীকে ‘সৎমা’ বলা হয়। শব্দটি যে ‘মা’ শব্দের সঙ্গে একটি বিশেষ দূরত্ব তৈরি করে, শুধু তা-ই নয়; সমাজে শব্দটি নেতিবাচক একটি ধারণাকে স্থায়ী করেছে। বাংলা ভাষার সাহিত্য-নাটক-চলচ্চিত্র এবং প্রবাদ-প্রবচনে ‘সৎমা’-কে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, তাতে সৎমা আর ‘অত্যাচারি’র মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এর বিপরীতে মায়ের দ্বিতীয় স্বামী কিন্তু সমাজে ‘সৎ বাবা’ নয় বরং ‘বাবা’ হিসেবেই বেশি উচ্চারিত হয়। এ ছাড়া, ‘সৎমা’ আর ‘সৎ বাবা’ - এ শব্দদ্বয়ের গূঢ়ার্থও (কনোটেশন) একরকম দ্যোতনা বা ব্যঞ্জনা তৈরি করে না। সৎমা শব্দটি শুনলেই একজন খারাপ বা খল নারীর ধারণা তৈরি হয়; সৎ বাবা শুনলে শুরুতেই এমনটি হয় না।

প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের পরস্পরের ‘সতিন’ বলা হয়; সতিনের কোনো পুরুষবাচক শব্দ আমাদের ভাষায় নেই। এর কারণ হলো, পুরুষের একাধিক বা বহুবিবাহকে আমাদের সমাজ জায়েজ করেছে, কিন্তু নারীর ব্যাপারে এমনটি আমাদের ভাবনার জগতেই নেই বলে আমাদের ভাষাতেও নেই। ‘দোজবর’ বা ‘দোজবেরে’ (দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে - এমন পুরুষ) শব্দটিও এমন ভাবনাকে সমর্থন করে। আবার, কোনো নারীকে গ্রহণ (বিয়ে) করেছে যে পুরুষ, তাকে ‘কৃতদার’ বলা হয়; কিন্তু বিবাহিত নারীর জন্যে এমন অর্থবোধক কোনো শব্দ নির্ধারণ করা হয়নি। এখানে বোঝাই যাচ্ছে, ‘পুরুষ নারীকে গ্রহণ করেছে’ - এই ভাবনাটিই সমাজের কাছে মুখ্য; সমাজের চোখে নারী কোনো পুরুষকে গ্রহণের যোগ্যতা বা অধিকার রাখে না। পুরুষ এখানে সক্রিয় ও মুখ্য; এর বিপরীতে নারী এখানে নিষ্ক্রিয় ও গৌণ।

যে নারী একবার সন্তান প্রসব করে, তাকে বলে ‘কাকবন্ধ্যা’; অথচ যে পুরুষের একটি সন্তান, তাকে কী বলা হবে- এমন কোনো শব্দ অভিধানে নেই। যে নারী পূর্বে অন্যের স্ত্রী ছিলো, সে ‘অন্যপূর্বা’; কিন্তু যে পুরুষ পূর্বে অন্যের স্বামী ছিলো, তাকে এভাবে চিহ্নিত করার মতো কোনো শব্দ বাংলা ভাষায় রাখা হয়নি। যে নারী একাধিক বা বহু পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়, তাকে বলা হয় ‘বারাঙ্গনা’; তাহলে, যে পুরুষ বহু নারীর সঙ্গে মিলিত হয়, তাকে ডাকার মতো শব্দ বাংলা ভাষায় কোথায়?

‘শিশুসন্তানসহ বিধবা’ হলে তাকে ‘বালপুত্রিকা’ বলে; কিন্তু যে পুরুষ ‘শিশুসন্তানসহ বিপত্নীক’, তাকে সম্বোধনের জন্যে আলাদা কোনো শব্দ নেই। অবিবাহিত কোনো নারীর পুত্রকে চিহ্নিত করতে ‘কানীন’ শব্দটি ব্যবহার করা হলেও অবিবাহিত পুরুষের পুত্রকে কী বলা হবে, এমন নির্দেশনাও বাংলা ভাষায় অনুপস্থিত। ইতিহাসের কালপর্বে বহু ‘ক্রীতদাসী’র গর্ভে রাজা বা সামন্ত প্রভুদের সন্তান জন্মেছে; ওই সন্তানদের বলা হয় ‘দাসীপুত্র’। এখানেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, ‘দাসীপুত্র’ বলার মধ্য দিয়ে ওই সন্তানের জন্মের দায় কেবল নারীর ওপর চাপিয়ে ওই ঘটনায় পুরুষের দায়কে আড়াল করা হচ্ছে। এ কারণেই আমরা দেখি, এমন কোনো ঘটনা ঘটলে সমাজ এটিকে ‘নারীঘটিত কেলেঙ্কারি’ বলে চালিয়ে দেয়; আর আমরাও প্রশ্ন করি না : ‘কেলেঙ্কারি’ কি নারী একাই ঘটায়?

‘বাদশা’ যে অর্থ বা ক্ষমতার ধারণা বহন করে, ‘বেগম’ এর থেকে যোজন যোজন দূর। ‘রানি’ হতে গেলে নারীকে কোনো ‘রাজার স্ত্রী’ হতে হয়; অথচ একজন পুরুষ কোনো বৈবাহিক সম্পর্কের শর্ত ছাড়াই ‘রাজা’ হতে পারে। স্বামী (রাজা) জীবিত থাকাকালে তার নিয়ন্ত্রণে থাকা নারীর পরিচয় রানি বা রাজমহিষী; স্বামীর (রাজার) মৃত্যু হলে পুত্রের অধীনে ওই নারীর পরিচয় হয় ‘রাজমাতা’ হিসেবে। অর্থাৎ, এখানেও নারীর স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব, পরিচয় বা ক্ষমতা নেই; তার পরিচয় নির্ধারিত হচ্ছে অন্যের (পুরুষের) সঙ্গে তার সম্পর্কের ভিত্তিতে।

বাংলা ব্যাকরণমতে ডাকিনি বা ডাইনি, শাঁখিনি বা শাঁখচুন্নি, বাইজি, সতিন বা কুলটা - এসব শব্দ নিত্যস্ত্রীবাচক অর্থাৎ এসব শব্দের পুংলিঙ্গ হয় না। আর যোদ্ধা, সেনাপতি, বাহাদুর, রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি শব্দ হলো নিত্যপুরুষবাচক যাদের স্ত্রীলিঙ্গ হয় না। অর্থাৎ, সমাজ আগে থেকেই নির্ধারণ করে দিচ্ছে, নারী ও পুরুষের কার ভূমিকা, অবস্থান বা মর্যাদা কেমন হবে। আবার, নারীর চরিত্র চিত্রায়ণে যেভাবে সতী, অসতী, সতীত্ব, নষ্ট বা নষ্টা ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করা হয়, পুরুষের ব্যাপারে এমনটা আছে কি? ভাষার মারপ্যাঁচ দিয়ে কতো সহজেই নারীকে ‘নষ্ট’ বা ‘অনিষ্টকারী’ আর পুরুষকে বীর-বাহাদুর বানিয়ে ফেলা হচ্ছে!

আগেই বলা হয়েছে, বাংলা ভাষার প্রবাদ-প্রবচনগুলোও পুরুষের প্রতি এমন পক্ষপাত থেকে মুক্ত নয়। এই ভাষায় লোকসংস্কৃতির অংশ হিসেবে গড়ে ওঠা অনেক ‘নীতিবাক্যের’ একটি হলো, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। এ প্রবাদে আপাতদৃষ্টিতে নারীর গুণকীর্তন চোখে পড়বে; কিন্তু এর মধ্য দিয়ে আসলে নারীকে প্রকৃত অর্থে বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে সংসারে সুখ নিশ্চিত করার দায়িত্ব এককভাবে নারীকেই নিতে হবে। সংসারে সুখের জন্য পুরুষের তাহলে কোনো দায়িত্বই নেই আর সংসারে অশান্তি হলে তাই অনিবার্যভাবে এর যাবতীয় দোষ এককভাবে নারীর ওপরই গিয়ে পড়ছে।

এমন আরেকটি প্রবাদ হলো, ‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন/যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ’। অর্থাৎ সংসার সুখের না হওয়া এবং ভাইদের মধ্যে ঝগড়ার দোষ অনিবার্যভাবেই নারীকে নিতে হচ্ছে! ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’ - এই আপ্তবাক্যে মায়ের কোনো স্থানই নেই। ‘রাগলে পুরুষ হয় বাদশা, আর নারী হয় বেশ্যা’ - প্রবাদে এমন অযৌক্তিক দাবির মর্মার্থ (কনোটেশন) হলো, (পুরুষতান্ত্রিক) সমাজ চায় পুরুষ তার রাগ-জেদ বিনা দ্বিধায় প্রকাশ করবে, আগ্রাসী বা অ্যাগ্রেসিভ হবে; কিন্তু নারীকে নিষ্ক্রিয় বা প্যাসিভ ও সাবমিসিভ হতে হবে। আর, ‘অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের বউ মরে’ - এই প্রবচনে নারীকে যেভাবে অপদস্থ করা হয়েছে, তা সত্যিই নির্মম।

তাহলে বলতে হচ্ছে, পুরুষ যখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যাটায়ার করে, ‘নারী এমন এক জিনিস যে তাকে ছাড়া থাকা সমস্যা, আবার তার সাথে থাকা আরো বড় সমস্যা’, তখন এটি কতোটা ‘সত্য’ আর কতোটা পুরুষতান্ত্রিক ডিসকোর্স বা আলাপ, বিলাপ না কি প্রলাপ - সে নিরীক্ষা জরুরি।

লালচাঁদ বড়ালের গানে আমরা দেখি, বাড়ির বউ জল আনতে কলসি নিয়ে যখন নদীতে যাচ্ছে, সমাজ তখন তাকে প্রশ্ন করছে : ‘কাদের কুলের বউ গো/তুমি কাদের কুলের বউ/যমুনায় জল আনতে যাচ্ছো-/সঙ্গে নেই তো কেউ’। এই প্রশ্নে নারীর প্রতি সন্দেহ আর অবিশ্বাসের পাশাপাশি রয়েছে তার (একা) চলাফেরার স্বাধীনতাকে সীমিত করারও গল্প। একা চলা নারীর বিড়ম্বনার শেষ নেই; পুরুষ তার পিছু নেবে ইচ্ছেমতোন। এই যেমন : ‘চুমকি চলেছে একা পথে/সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে’। এ গানের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাকে অস্বীকার বা আড়াল করছে; ‘চুমকি’ (পড়ুন : নারী) কি চেয়েছে কেউ (পুরুষ) তার সঙ্গী হোক? নারীটি যদি অনুমতি বা সম্মতি না দিয়ে থাকে, তাহলে গায়ে পড়ে সঙ্গী হওয়াটা দোষেরই বৈকি! কিন্তু, রোম্যান্সের আড়ালে এখানে আসলে পুরুষকে নারীর সম্মতি ছাড়া তার পিছু নেওয়া বা তাকে উত্যক্ত করার লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।

‘ভদ্রলোকের’ বা ‘উঁচু মানের’ সাহিত্যও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। প্রাচীন শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘নারীনাং চরিত্রঃ দেবা ন জানন্তি কুতঃ মনুষ্যা’ (নারীদের চরিত্র দেবতারাও বুঝতে পারে না, মানুষ কোন ছার!)। কাজী নজরুল ইসলাম এক কবিতায় লিখেছেন : ‘নারী নাহি হতে চায় শুধু একা কারো/এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো।/ইহাদের অতিলোভী মন/একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়/যাচে বহুজন।’ দ্বন্দ্বের কারণে নারী যখন সঙ্গী বদল করে, তখন তাকে ‘বারোভাতারি’ যে বলা হয়, সেটিও একই ধারণা থেকে উৎসারিত। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, ‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী-/পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি’ - এখানে তিনি ঠিক কোন মানসীর চিত্র আঁকেন? এই মানসী কি পূর্ণাঙ্গ? পরিপূর্ণ? সবল? নারীর পরিপূর্ণ নারী হয়ে ওঠা বা তার সৌন্দর্যের কৃতিত্বের পুষ্পমাল্য পুরুষের গলায় পরিয়ে তাকেই গ্লোরিফাই করা হচ্ছে না কি?

সংস্কৃতি, জীবন ও সাহিত্যের নানা অনুষঙ্গে এভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নারীদের দুর্বল, পুরুষের তুলনায় মূল্যহীন, পুরুষের ওপর নির্ভরশীল, পুরুষের পক্ষে অনিষ্টকর, পুরুষের ভোগের বস্তু, গৃহসজ্জার সামগ্রী, দুর্বল এবং খারাপ চরিত্রের মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব কারণে সমাজে নারী হয়ে উঠেছে মূলত দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় (প্যাসিভ) এবং এর বিপরীতে পুরুষ হয়ে উঠেছে সবল ও সক্রিয় (অ্যাকটিভ)। এই সামাজিকীকরণের পেছনে ভাষার ভূমিকা নিতান্ত কম নয়।

সামাজিকীকরণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ট যে গণমাধ্যম, সেটিও এই দোষের বাইরে নয়। প্রতিদিনের খবরে কিংবা বিনোদনমূলক আধেয়তে (যেমন : নাটক, সিনেমা বা বিজ্ঞাপন) নারীকে শক্তিশালী বা ইতিবাচকভাবে উপস্থাপনের নজির একেবারে হাতে-গোণা; কিন্তু, এর বিপরীতে দুর্বল, অন্যের (পুরুষের) ওপর নির্ভরশীল, অযৌক্তিক মাত্রায় মনোযোগ ও প্রশয় প্রত্যাশী, পুরুষের কাম্য ও ভোগের বস্তু, ঝগড়াটে বা বুদ্ধিহীন - এমন নেতিবাচক উপস্থাপনের উদাহরণ অসংখ্য। মানুষের জীবনে গণমাধ্যমের ব্যবহার ও প্রভাব - দুটোই বেড়েছে। তাই, গণমাধ্যমগুলোকেও নানা আধেয়র ভাষা ও চিত্র - দুটোর ক্ষেত্রেই দায়িত্বশীল ও সচেতন হতে হবে।

আমরা মনের মধ্যে যে চিন্তা-ভাবনা লালন করি, সেটিই আমাদের ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আবার একটি শিশু ওই ভাষা শিখতে শিখতে যখন বড় হয়, তখন অসংবেদনশীল সেসব শব্দ-বাক্য-ভাষার মাধ্যমে নেতিবাচক এমনসব ভাবনাই সে তার মনের মধ্যে ধারণ করতে থাকে। এসব ধারণা আবার বিভিন্ন সময়ে তার আচরণের মধ্যে প্রভাব ফেলে। এজন্যে ভাষার ব্যাপারে আমাদের সতর্ক থাকা দরকার।

জেন্ডার অসংবেদনশীল এবং বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা, বিদ্বেষ বা অবমাননা প্রকাশ পায় - এমন শব্দ এবং সাহিত্যের এমন অনুষঙ্গগুলো সচেতনভাবে বর্জন করা দরকার। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে এসব শব্দ বাদ দিয়ে জেন্ডার-নিরপেক্ষ বা সংবেদনশীল শব্দ খুঁজে বের করতে হবে। চেয়ারম্যানের বদলে চেয়ারপার্সন, সভাপতির বদলে সভাপ্রধান, বিজনেসম্যানের পরিবর্তে বিজনেস এক্সিকিউটিভ, কংগ্রেসম্যানের পরিবর্তে মেম্বার অব কংগ্রেস বা লেজিসলেটর, হাউসওয়াইফের পরিবর্তে হোমমেকার, স্বামীর বদলে জীবনসঙ্গী, ফোরফাদারের পরিবর্তে এনসেস্টর - চাইলেই এমন নিরপেক্ষ বা ইতিবাচক বিকল্প নির্মাণ ও ব্যবহার করা যায়। ব্যাপারটি কেবল সচেতনতা ও সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।

জেন্ডার পলিটিকসের এ দোষ বাংলা ভাষা কিংবা বাংলা সাহিত্য বা সংস্কৃতির একার নয়; ইংরেজিসহ সব ভাষাতেই পুরুষের প্রতি এমন পক্ষপাত ও নারীর প্রতি বিদ্বেষের উদাহরণ ঢের রয়েছে। মাতৃভাষা বাংলার পাশাপাশি দৈনন্দিন যোগাযোগে ইংরেজি, হিন্দি, আরবি, উর্দু, ফারসি, পর্তুগিজ, ফরাসি, জার্মান, ল্যাটিন প্রভৃতি বহু ভাষার শব্দ আমরা ব্যবহার করি। নানা দেশের নানা ভাষার সাহিত্য বা সিনেমার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে; তাই, সংস্কৃতির অন্য অনুষঙ্গগুলোর পাশাপাশি বিশেষ করে ভাষার মাধ্যমে কী ধরনের সামাজিকীকরণ ঘটছে, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হওয়া জরুরি।

ভাষা জেন্ডার পলিটিকস থেকে মুক্ত হওয়া মানে বাসা (পরিবার) এমন রাজনীতি থেকে মুক্ত হওয়া। আর, এর ইতিবাচক প্রভাব ক্রমেই সমাজকে আলোকিত করবে।

*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক আমাদের সময়-এর ঈদ সংখ্যায় (২০২৪)।