By অনুপম অরণ্য
ভারতীয়ের বিলেত ভ্রমণ
Media School August 22, 2021
রামমোহন রায়ের বিলেত যাত্রার আরো বত্রিশ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিলেতে যান মির্জা আবু তালিব। তিনি মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন ১৭৫২ সালে এবং ১৭৭৫ সালে অযোধ্যায় গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে আবার ১৭৯৯ সালে কলকাতায় আসেন। এরপর লন্ডন যাত্রা। বিলেত, ফ্রান্সসহ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ভ্রমণ করে ১৮০৩ সালে ভারতে ফিরে এসে তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্ত নিয়ে ফার্সি ভাষায় আত্মজীবনীমূলক তিন খণ্ডের বই লেখেন। বইয়ের নাম 'মাসির-ই-তালিফী বিলাদী ইন্ফ্রাঞ্জি'। এই বই ১৮১৩ সালে প্রথমে ইংরেজিতে এবং পরে ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয়।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রয়াত অধ্যাপক তপন রায়চৌধুরী লিখেছেন যে সেই বইয়ে তিনি (মির্জা আবু তালিব) জানাচ্ছেন ইউরোপে গিয়ে সেখানকার নারীকুলের প্রতি তিনি খুবই আকৃষ্ট হয়েছিলেন। আবার এটিও বলেছেন যে, বিলেতের নারীদের স্বাধীনতা তাঁর ভালো লাগেনি। তবে "জ্ঞানী ইংরেজরা যে বুদ্ধি করে বউ পেটানোর সুপ্রথাটা ছাড়েনি এই জন্যই নাকি জাতটা টিকে আছে!" এই উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে লেখা বাক্যটা বরিশাইল্যা রসরাজ তপন রায়চৌধুরী মির্জা আবু তালিবকে সরাসরি উদ্ধৃত করেছেন নাকি আবু তালিবের বক্তব্যকে রিফ্রেজ করেছেন, চৌধুরী মহাশয়ের বই পড়ে সেটা ঠিক বোঝা গেল না।
একটা বিষয়ে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলছেন, আবু তালিব সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ব্রিটিশরা অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করতে পেরেছে দুটি প্রধান কারণে : একটি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রতি ব্রিটিশদের অনুরাগ, অন্য কারণ হচ্ছে নারীর স্বাধীনতা।
আবু তালিব অক্সফোর্ড ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সাথে মত বিনিময় করেন। রয়েল সোসাইটিতে বক্তৃতাও দেন প্রাচ্যের নারীদের অধিকার বিষয়ে। তাঁর জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। রামমোহন রায়ের আগেই ইউরোপ এই বাঙালিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বা তিনি স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিলেন।
অবশ্য আবু তালিবেরও আগে মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন ইউরোপ যান; ১৭৩০ থেকে ১৭৩২ সালের মধ্যে নদীয়া জেলায় তাঁর জন্ম। ১৭৬৫ সালে মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ আলমের একখানা অনুরোধপত্র নিয়ে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জ-এর দরবারে একজন দূত পাঠানো হবে। দূত হিসেবে নির্বাচিত হলেন ঢাকার ইংরেজ প্রশাসক ক্যাপ্টেন সুইন্টন। তার সহযোগী হিসেবে মনোনীত হন মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন। ফারসি ভাষায় লেখা অনুরোধপত্রটি পড়ে শোনানোসহ আরো কিছু কাজ দিয়ে তাঁকে পাঠানো হয় সুইন্টন-এর সঙ্গী হিসেবে। ছয় মাস জাহাজ যাত্রার পর তাঁরা ইংল্যান্ডে পৌঁছেন। রাজ দরবারের কাজ শেষ করার পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয় পরবর্তীকালে কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি উইলিয়াম জোন্স-এর সাথে। বিলেতের অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৭৮৪ সালে তিনি ফারসি ভাষায় লেখেন 'শিফার্গে-নামা-এ-বেলায়েত' নামে বই। এটা ভ্রমণ বৃত্তান্ত ও আত্মজীবনী।
রামমোহন রায়ও ১৮৩১ সালে মুঘল বাদশাহের প্রতিনিধি হয়ে বিলেত গিয়েছিলেন। সে যুগে সাগর পাড়ি (কালাপানি) দিলে হিন্দুদের জাত ও ধর্ম নষ্ট হতো। রামমোহনের পক্ষে সেটা একটা বিপ্লবী কাজ বটে। রামমোহন রায় বিলেতে থাকাকালীন ১৮৩২ সালে প্রথম ভারত উপমহাদেশীয় হিসেবে ট্রেন ভ্রমণ করেন ম্যানচেস্টার থেকে লিভারপুল পর্যন্ত।
তবে মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন প্রথম বিলাত যাত্রী, এ কথাটাও পুরোপুরি ঠিক নয়। ষোল শতক থেকেই ভারতের সাথে ইউরোপের নৌ-যোগাযোগ শুরু হয়েছে। ভারতের অনেকেই তখন ইউরোপীয় জাহাজে নাবিকের কাজ নিয়ে ইউরোপে যাওয়া-আসা করেছে। ইতিসামুদ্দীন হচ্ছেন নাবিক শ্রেণির বাইরে প্রথম সম্ভ্রান্ত কোনো ব্যক্তি যিনি বিলেতে গিয়েছেন।