By মিডিয়াস্কুল ডেস্ক
বইমেলায় রাজীব সরকারের ‘উগ্রবাদবিরোধী রবীন্দ্রনাথ’
Media School June 22, 2020
উগ্রবাদ মোকাবিলায় রবীন্দ্রনাথের রচনা শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
বাংলা সাহিত্যের সৃজনশীল ধারা যেভাবে বিকশিত হয়েছে, মননশীল ধারার সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ মননশীল সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে যে মেধা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম প্রয়োজন তার সমন্বয় স্বল্প সংখ্যক লেখকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তরুণদের মধ্যেও মননশীল লেখকের সংখ্যা কম। যারা আছে তাদের মধ্যে অন্যতম রাজীব সরকার। এবারের বইমেলায় তার লেখা ‘উগ্রবাদ ফ্যাসিবাদ ও রবীন্দ্রনাথ’ বইটি ইতিমধ্যেই অগ্রসর পাঠকের মনোযোগ কেড়েছে।
ধর্মীয় উগ্রবাদ একইসঙ্গে বৈশ্বিক ও জাতীয় সমস্যা। ধর্মীয় উগ্রবাদ তথা জঙ্গিবাদ দমনে পৃথিবীর নানা রাষ্ট্র কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু শুধু আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করে উগ্রবাদ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। উগ্রবাদ একটি মতাদর্শ। এটি মোকাবিলায় প্রয়োজন পাল্টা মতাদর্শ। পাল্টা মতাদর্শ নির্মাণে রবীন্দ্রনাথ হতে পারেন আমাদের প্রধান অবলম্বন। ধর্মীয় উগ্রবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা যে একবিংশ শতাব্দীতেও প্রাসঙ্গিক এই জরুরি তথ্যটি আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন রাজীব সরকার।
মোট দশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বইটি। রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনী, কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, ভাষণ-বিবৃতি, ভ্রমণকাহিনি বিশ্লেষণ করে ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের বলিষ্ঠ অবস্থানকে তুলে ধরেছেন লেখক। ধর্ম নিয়ে হানাহানি দেখে ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ ‘ধর্মমোহ’ কবিতায় লিখেছিলেন-“ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো/এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক জ্বালো”।
‘মুসলমানীর গল্প’, ‘কাবুলিওয়ালা’ ও ‘রবিবার’ গল্পে রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ঘরে বাইরে’ ‘গোরা’ ও ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস বিশ্লেষণ করে লেখক দেখিয়েছেন গোরা, নিখিলেশ ও জ্যাঠামশায়ের মতো চরিত্র যুক্তিবাদ ও মানবধর্মের আলোয় দীপ্তিমান। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ নাটকগুলোর মধ্যে ‘বিসর্জন’, ‘অচলায়তন’ ও ‘মালিনী’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তিনটি নাটক পর্যালোচনা করে রাজীব সরকার যথার্থই বলেছেন-“আচারধর্মের যান্ত্রিকতা, প্রথাবদ্ধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দ্রোহ উচ্চারিত হয়েছে উল্লিখিত তিনটি নাটকে। ধর্মীয় চরমপন্থীদের উগ্রবাদের সঙ্গে যে প্রকৃত ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই এই সত্যে ভাস্বর হয়ে উঠছে রবীন্দ্র নাটকের আখ্যান।”
ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের অবস্থান একজন সমাজবিজ্ঞানীর মতো। ‘কালান্তর’ বইটি এক্ষেত্রে আলোকবর্তিকা। রবীন্দ্রনাথের আলোচিত প্রবন্ধগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে লেখক বলেছেন, ধর্মান্ধতা, সহিংস উগ্রবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে তাঁর ধর্মসাধনা আমাদের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে।
‘ছড়া ও কবিতায় ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা’ প্রবন্ধে লেখক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের নৈতিক অবস্থানকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের আন্তর্জাতিকতাবাদেরও পরিচয় পাওয়া যায়। হিটলার, মুসোলিনীর মতো একনায়কের বিরুদ্ধে যেমন তাঁর কলম ঝলসে উঠেছিল, তেমনি ফরাসী মানবতাবাদী মনীষী রোমারোল্যার সঙ্গে তার মতৈক্য প্রকাশেও তিনি দ্বিধা করেননি।
মনুষ্যত্বের জয়ের মধ্যেই নিহিত রয়েছে উগ্রবাদের ক্ষয়ের বীজ। উগ্রবাদ মোকাবিলায় রবীন্দ্রনাথের রচনা যে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে তা এই প্রথম জোরালো যুক্তি দিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে ‘উগ্রবাদ ফ্যাসিবাদ ও রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে। তাঁর সাহিত্যকর্মের এমন প্রায়োগিক মূল্য নিরূপণের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্য সমালোচনায় এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হলো। এমন সময়োপযোগী ও মূল্যবান গবেষণার জন্য রাজীব সরকার পাঠকের প্রিয় লেখক হয়ে উঠবেন।
বইটি প্রকাশ করেছে- কথাপ্রকাশ। মেলায় পাওয়া যাবে কথাপ্রকাশের ৯ নং প্যাভিলিয়নে।
[দৈনিক যুগান্তর, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০]