By সজীব সরকার
প্রকৃতির আইন অমান্য করে সাধ্য কার!
Media School June 17, 2020
প্রকৃতি। মাত্র তিনটি বর্ণের এই শব্দে নিহিত রয়েছে গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ডের আদ্যন্ত রহস্য। এই প্রকৃতি থেকেই উৎসরিত সব জড় ও জীব; এই প্রকৃতিতেই মিলেমিশে একাকার হতে হয় সবকিছুকে। তাই প্রকৃতিকে অনেকে বলেন ‘মা’ (মাদার নেচার); কারো কারো কাছে এই প্রকৃতিই ঈশ্বর।
প্রকৃতির রয়েছে নিজস্ব নিয়ম, সুনির্দিষ্ট শৃঙ্খলার বিধি। এইসব নিয়ম-শৃঙ্খলা বা আইনের বলেই সৃষ্টি হয় মরু বা জলাধার; সুগভীর খাদ বা সুউচ্চ পর্বত। এই নিয়মের মধ্যেই তৈরি হয় ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস কিংবা ডায়নোসরের মতো অতিকায় প্রাণ। এককোষী ক্ষুদ্রকায় অ্যামিবা থেকে বহুকোষী সুবিশাল ঐরাবতের কেউই এই নিয়মের বাইরে নয়।
মানুষ যখন থেকে অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণকে কাজে লাগিয়ে চিন্তা করতে সক্ষম হয়েছে, তখন থেকে প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছে। তখন থেকেই মানুষ বুঝতে পেরেছে, প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করা অর্থাৎ প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলার মধ্যেই রয়েছে জীবজগতের পরিপূর্ণ বিকাশের সুযোগ আর এর বিপরীতটি ঘটালেই রয়েছে বিনাশের ঝুঁকি।
প্রাচীন শাস্ত্রগুলোতেই মানুষের এমন ভাবনার প্রমাণ রয়েছে। আর বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে যেসব দুর্যোগ দেখা দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে, সেগুলোও এই ধারণারই সত্যতা প্রমাণ করছে বার বার। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ফসল বা পশুপাখির প্রজাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে গবেষণাগারে সৃষ্ট নতুন নতুন প্রজাতি নানা সুবিধার লোভ দেখিয়ে বাজারে প্রচলিত করা হয়েছে; কিন্তু মানুষের জীবন ও প্রকৃতির ভারসাম্যের ওপর এসবের যে অপূরণীয় ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি হচ্ছে, তা এরই মধ্যে দৃশ্যমান। কিন্তু আমাদের ভাবান্তর কই?
প্রকৃতির সহনশীলতার সীমাকে উপেক্ষা করে আমরা প্রাকৃতিক খাদ্যভাণ্ডারকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছি। জীবনের আয়েস বাড়াতে এমন সব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছি, যা জীবনে আয়েসের চেয়ে বরং বেশি দুর্যোগ বাড়িয়েছে। জীবনকে সহজ করতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের আমি বিরুদ্ধে নই, কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের নির্বিচার যথেচ্ছারের আমি বিপক্ষে। জীবনের তাগিদে আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে; কিন্তু কতোটা?
ক্ষুদ্র একটি উদাহরণ দেই : জীবন রক্ষার মৌলিক তাগিদের চেয়ে বেশি বরং একেবারেই অদরকারি মাত্রায় অতি-বিলাসের প্রয়োজনে দরকারের চেয়ে ঢের বেশি গাছপালা কেটে, বাড়ি-গাড়ি তৈরি করে, শিল্প-কারখানা স্থাপন করে এবং আরো নানাভাবে প্রকৃতির শীতল বাতাসকে আমরা গরম ও বিষাক্ত করেছি; আবার সেই গরম বাতাসকে ঠাণ্ডা করার জন্যে অফিসে-বাড়িতে-গাড়িতে লাগিয়েছি বাতাস শীতলীকরণ যন্ত্র (এসি), অনিবার্যভাবে যা আবার বাতাসকে আরো বেশি গরম ও বিষাক্ত করছে। অর্থাৎ প্রকৃতির ক্ষতির কথা জেনেও আমরা যেসব জিনিস উদ্ভাবন ও ব্যবহার করছি বা যে অযৌক্তিক মাত্রায় বিলাসী জীবনাচারে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি, একদিকে আমরা যেমন এর উপকারভোগী, অন্যদিকে আমরা স্পষ্টতই এর ভুক্তভোগীও।
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারে মানুষ বরাবরই এমন স্ববিরোধী। প্রাকৃতিক খাদ্যভাণ্ডারের মধ্যে প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে যা তৈরি করা হচ্ছে, তা মানুষের স্বাস্থ্যকে ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আর এর সমাধান দিতে বিজ্ঞানীরা ওষুধের পর ওষুধ, টিকা বা সহায়ক যন্ত্রপাতি তৈরি করে যাচ্ছেন। এসবের অর্থ কী? ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ বলছে, রাজনৈতিক স্বার্থ ও অর্থলিপ্সাসহ নানা কারণে গবেষণাগারে নতুন নতুন ভাইরাস সৃষ্টির চেষ্টা চলছে, রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু তৈরির চেষ্টা চলছে; আবার সেসবের প্রতিকার বা প্রতিষেধক খুঁজে মরছে বিশ্বের বিজ্ঞানীসমাজ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এমন অনর্থক অপব্যবহারের প্রয়োজন কি অর্থবোধক?
মানুষের জীবনে কিছুটা আয়েস বাড়াতে, জীবনের নিরাপত্তা বাড়াতে এবং সর্বোপরি জীবনের মানোন্নয়নে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার দোষের নয়। কিন্তু যে প্রযুক্তির পরিণতি নিশ্চিতভাবেই নিজের ও অন্যের জন্যে ক্ষতিকর, সে প্রযুক্তি বা এমনতরো উদ্ভাবন কতোটা যুক্তিসিদ্ধ?
যাতায়াতকে সহজ করতে দ্রুতযানের প্রয়োজন অস্বীকার করি না; কিন্তু সেই যান হতে হবে পরিবেশবান্ধব এবং একেবারেই মৌলিক প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংখ্যায়। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্যে আলাদা গাড়ির বিলাসিতা কেবল যে অদরকারি, তা-ই নয়, স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ নানা কারণেই সবার জন্যে তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিকরও বটে। মানুষের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা দিতে উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার প্রয়োজনে নতুন নতুন উদ্ভাবনের প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ জীবনাচারের বদৌলতে নিজেরাই নানাভাবে ‘আধুনিক’ রোগ-ব্যাধির ঝুঁকি তৈরি করে তারপর সেসবের ‘আধুনিক’ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা মোটেই বিজ্ঞানের উৎকর্ষ নয় বরং রীতিমতো মূর্খতার পরিচয়।
আমাদের ব্যক্তিক ও সামষ্টিক জীবনাচার বায়ুমণ্ডলকে দূষিত করছে, নিরাপদ পানির উৎসকে দূষিত করছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। বনাঞ্চল বিনষ্ট হচ্ছে। অনেক ফসল-উদ্ভিদ-প্রাণির প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে; আরো অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। এরই মধ্যে ঘটে যাওয়া ক্ষতি ও অদূর ভবিষ্যতে ঘটতে যাওয়া যাবতীয় বিপদের কথা জেনেও আমরা পরিবেশ ও প্রকৃতির ক্ষতি হয়, এমন জীবনাচার থেকে সরে আসছি না। জলবায়ু সম্মেলনগুলো বিশ্বের বড় বড় দেশের খামখেয়ালিপনায় কেবল পানাহারের উপলক্ষ হয়ে উঠেছে।
প্রকৃতির চিরাচরিত তথা স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হয়, এমন সর্বগ্রাসী জীবনাচার থেকে আমাদের দূরে সরে আসতে হবে। প্রকৃতির আইন মেনে চলতে হবে, প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। নচেৎ কালে কালেই ভূমিকম্প-বন্যা-রোগের প্রাদুর্ভাবের মতো দুর্যোগের মধ্য দিয়ে মানবজাতিকে এর মূল্য দিয়ে যেতে হবে যতোদিন পর্যন্ত গোটা মনুষ্যপ্রজাতি বিলুপ্ত না হয়। পৃথিবীতে একসময় ডায়নোসরের রাজত্ব ছিলো; তা চিরস্থায়ী হয়নি। এখন মানুষের রাজত্ব চলছে; এটিও চিরস্থায়ী হবে না- এ প্রকৃতিরই নিয়ম। তবে মনুষ্য প্রজাতি নিজের ধ্বংস নিজেই যে আরো দ্রুত ডেকে আনছে- এতে সন্দেহ নেই।
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত যতো প্রজাতির প্রাণি বিলুপ্ত হয়েছে, তার বেশিরভাগ হয়েছে প্রকৃতির স্বাভাবিক গতিপরিবর্তনের কারণে; আরো স্পষ্ট করে বললে, প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার কারণে। কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে আর কিছু প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে মানুষের হাতে। তবে মানুষই হয়তো এখন পর্যন্ত প্রথম ও একমাত্র প্রজাতি, যে নিছক কিছু ‘বদভ্যাসের’ কারণে নিজেই নিজের বিলুপ্তির কারণ হতে যাচ্ছে এবং তা সবকিছু জেনে-বুঝেও।
তাই এখনো সতর্ক না হলে পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে যাচ্ছে- এ সত্য আমরা আর কতোদিন অস্বীকার করবো? মরুতে ঝড় শুরু হলে বালিতে মুখ গুঁজে রেখে উট নিজেকে প্রবোধ দেয়, ঝড় হচ্ছে না। তবে উট অস্বীকার করলেই ঝড় মিথ্যে হয়ে যায় না। উটের এ প্রবণতা ‘নির্বোধ’ অনেক পাখির মধ্যেও রয়েছে; আমরাও কি সেই নির্বোধদের গোত্রভুক্ত হতে চাই?
মহৎ উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ গৌরবের, কিন্তু অহেতুক নিজেই নিজেকে ধ্বংসের মধ্যে গৌরব নেই। আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিকসহ সব ধরনের জীবন-বিধি তৈরি করতে হবে প্রকৃতির সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে; সব আবিষ্কার-উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে প্রকৃতির সুরক্ষা অক্ষত রাখতে হবে।
যখন বলছি ‘প্রকৃতির আইন’, তখন সেখানে ‘সেকেলে’ ধ্যান-ধারণা, কুসংস্কার বা ক্ষুদ্র অর্থে প্রচলিত অবাস্তব বা অলৌকিক আধ্যাত্মিকতার ভ্রান্তি নেই। প্রকৃতির এই নিয়ম বিজ্ঞানসিদ্ধ; আধুনিক বিজ্ঞান দিয়েই এই ধারণার সত্যতা প্রমাণ করা যায়। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সময়ের প্রয়োজনে তৈরি হয়েছে; মানুষের প্রয়োজনে একে কাজে লাগাতে হবে- এতে দ্বিমত নেই। কিন্তু এই জ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগ তখনই সঠিক হবে, যখন তা হবে জীবজগত তথা প্রকৃতির বিচারে পরীক্ষিত ও কল্যাণকর। কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে অর্জিত এই জ্ঞানের অহেতুক-অবিবেচক-অপব্যবহার মোটেই কাণ্ডজ্ঞানের পরিচায়ক নয়।
প্রকৃতির সঙ্গে বিজ্ঞানের বিরোধ নেই; যাবতীয় বিজ্ঞান প্রকৃতির জ্ঞান থেকেই আহরিত। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আবিষ্কার বা উদ্ভাবন শেষ পর্যন্ত টিকবে না; মানবজাতিকে নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে এর মূল্য দিতে হবে। আর কেবল মানবজাতির প্রকৃতিবিরোধী জীবনাচারের কারণে যুগে যুগে সৃষ্ট নানা দুর্যোগে হাজারো-লাখো-কোটি মানুষের প্রাণহানিই এর প্রমাণ।
তাই আমাদের এই বোধোদয় আশু প্রয়োজন : প্রকৃতির অনুগ্রহে এবং সব প্রজাতির প্রাণের সাহচর্যে শান্তির পথ অন্বেষণই মানবজাতির জ্ঞানের চরম উৎকর্ষের প্রধান লক্ষ্য -প্রকৃতির শৃঙ্খলাকে বিনষ্ট করা নয়।
[লেখাটি চ্যানেল আই অনলাইন-এ ৯ মে ২০২০ প্রকাশিত হয়।]