Media School

Dhaka    Thursday, 26 December 2024

By রাজীব সরকার

জন্মশতবর্ষে সত্যজিৎ : অনন্য শিল্পীর পাঁচালী

Media School May 24, 2021

সত্যজিৎ রায় ছিলেন একাধারে চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক ও লেখক।

আলোকিত চিন্তাধারা, সময়ের তুলনায় এগিয়ে থাকা সামাজিক চেতনা, কালজয়ী কর্মজীবন এবং ক্ষণজন্মা প্রতিভার সমন্বয়ে গোটা উনিশ শতক ও বিশ শতকজুড়ে বাংলার মননে যে বৈপ্লবিক আলোড়ন ঘটে গিয়েছিল, যাকে ‘বাংলার নবজাগরণ’ বলা হয়, তার অভিমুখ রামমোহনে আরম্ভ হয়ে যদি রবীন্দ্রনাথে উৎকর্ষ লাভ করে, তাহলে সত্যজিৎ রায়ের বহুমুখী প্রতিভা সেই জাগরণের শেষ অধ্যায়। চলচ্চিত্রকার সত্যজিতের মূল্যায়ন করতে গিয়ে জাপানি চিত্রপরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া একবার বলেছিলেন, ‘সত্যজিতের চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্য না দেখা একই কথা।’ শিল্পী হিসাবে সত্যজিৎ রায়ের অনন্যতা এখানে যে, তিনি শুধু চলচ্চিত্রকার ছিলেন না। ৩৬টি বিশ্বমানের চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র ছাড়াও চলচ্চিত্রবিষয়ক তিনটি গ্রন্থ, শঙ্কু ও ফেলুদা কাহিনি, দশটি শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা, চারটি গ্রন্থের অনুবাদ, সন্দেশ ও অন্যান্য পত্রিকা সম্পাদনা, অসংখ্য বইয়ের প্রচ্ছদ অঙ্কন- সত্যজিতের কর্মযজ্ঞ সত্যিই বিস্ময়কর। প্রতিভার এ বহুমুখিনতাই তাকে ব্যতিক্রমী মনীষা সম্পন্ন করে তুলেছে। এ কারণে তিনি শুধু বাংলা চলচ্চিত্রেরই শ্রেষ্ঠ শিল্পী নন, বিশ্বের প্রথম সারির চলচ্চিত্রকারদেরও অন্যতম।

সিনেমা তৈরির আগে সত্যজিৎ কীভাবে গড়ে উঠেছেন, কীভাবে তৈরি করেছেন নিজেকে, সেটাও লক্ষ করার মতো। সংগীতের প্রতি তার আবাল্য আকর্ষণ। কৈশোর থেকে নজর ছিল ফটোগ্রাফির দিকে। প্রথম যৌবনে পাশ্চাত্য সংগীত, পাশ্চাত্য চিত্রকলা ও চলচ্চিত্র তাকে টেনেছে। ভালো স্কুল ও কলেজে পড়াশোনা করে অর্থনীতির স্নাতক হয়েও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তার গড়ে ওঠার পথে তেমনভাবে সহায়ক হয়েছে বলে তিনি কখনো মনে করেননি। শান্তিনিকেতনে কলাভবনের শিক্ষারও আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি তিনি ঘটাননি। তবে সেখানে কয়েকজন শিল্পী-শিক্ষকের সান্নিধ্য এবং দেশি-বিদেশি কয়েকজন বন্ধুর সাহচর্য তার জীবনে মূল্যবান হয়েছিল বলে সত্যজিৎ মনে করতেন। ভারতীয় চিত্রকলা সম্পর্কে আগ্রহের পাশাপাশি সংগীতচর্চার পরিধি-বিস্তার ঘটেছে এ পর্বে।

মধ্য যৌবনে সত্যজিৎ প্রতিষ্ঠিত গ্রাফিক আর্টিস্ট, ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার চলচ্চিত্রচর্চাকে গভীরতর করেছেন। যুবাবয়স থেকে প্রৌঢ়ত্ব- এ পাঁচ দশক সময়ে স্বাধীনতা-আন্দোলন, মন্বন্তর, দেশবিভাগ, শরণার্থী আগমন, বাম আন্দোলন, নকশাল বিক্ষোভ, জরুরি অবস্থা ইত্যাদির মতো অনেক উত্তাল ঘটনার সাক্ষী কলকাতার মানুষ সত্যজিৎ। তার অঙ্গীকার ছিল শিল্পের প্রতি, মানুষের ধর্মের প্রতি। সত্যজিতের মনন, দৃষ্টিভঙ্গি ও শিল্পরুচি আন্তর্জাতিক; কিন্তু ঘরোয়া ও সামাজিক আচরণে ছিল একেবারে নির্ভেজাল বাঙালিয়ানা। তার ছবির প্রধান চরিত্রেরা বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও এবং দুটি বাদে বাদবাকি সব ছবির ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, ঐতিহাসিক আঞ্চলিকতায় সীমাবদ্ধ না থেকে ছবিগুলো বিশ্বজনীনতায় পরিপূর্ণ।

যে অন্যতম বৈশিষ্ট্যটি সত্যজিতের চলচ্চিত্রকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছিলেন তা হলো ডিটেল। ভারতীয় চলচ্চিত্রের যথার্থ ডিটেলের তিনি উদগাতা। তার আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্রে ডিটেলের প্রকৃত চেহারা অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও দেখা যায় না। ভারতীয় চলচ্চিত্রের সব স্তরকে ‘পথের পাঁচালী’র জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ‘পথের পাঁচালী’র যে নববাস্তববোধ দর্শক ও সমালোচককে হতবাক করেছিল তার জন্য সত্যজিৎ রায়ের ডিটেল রচনার অবদান কম নয়। ‘পথের পাঁচালী’র যাত্রা শুরু হয় বিহ্যাভিয়ারিস্টিক ডিটেল দিয়ে। ছোট দুর্গার চুরি করা পেয়ারা নিয়ে ইন্দির ঠাকুরণের সেই অবিস্মরণীয় অভিব্যক্তি এ ব্যাপারে বিশেষভাবে সাহায্য করে। বৃদ্ধার সেই হাস্যোজ্জ্বল চেহারার মধ্য দিয়ে সারা গ্রামবাংলার অতীত যেন তার সারল্য, দারিদ্র্য ও সহজ সুখ নিয়ে ধরা পড়ে। এর পাশাপাশি আসে পরবর্তী ‘অপরাজিত’র কাশি পর্যায়ে হরিহরের বহুদিন পরে দুধ খাওয়ার সেই দৃশ্যের কথা। সেখানে দেখা যায় আনন্দে আবির্র্ভূত হরিহর রান্নাঘরে এসে উবু হয়ে দুধের বাটির সামনে বসে এবং দুধের সরটা দু’আঙুলে তুলে নিয়ে মুখের মধ্যে ফেলে দিয়ে বেশ তারিফ করার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে আরও একটি দৃশ্য স্মরণীয়। দুর্গার মৃত্যুর কয়েকদিন পর বিষণ্ন অপু স্নানের পর ভিজা চুল নিয়েই মাথা আঁচড়ায়। এ কাজটি দিদির অভাবে প্রথম সে করে। এরপর গায়ে আলোয়ান জড়িয়ে সে বাইরে চলে যায়; কিন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিরে আসে ও ছাতাটা সঙ্গে নেয়। একটি অসহায় দরিদ্র পরিবারের একটি মৃত্যু তাকে যেন প্রাপ্তবয়স্ক করে তোলে এবং এক ধরনের স্বনির্ভরতা ও দায়িত্ববোধের জন্ম দেয় তার ভেতর। এ নির্মম বাস্তবের পরিচয় দিতে এখানে বিহ্যাভিয়ারিস্টিক ডিটেলসের সাহায্য নেন পরিচালক।

সত্যজিৎ রায় এটমসফিয়ারিক ডিটেলেরও শ্রেষ্ঠ শিল্পী। এটমসফিয়ারিক ডিটেলের উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ দেখা যায়- ‘অপু ট্রিলজি’, ‘মহানগর’, ‘কাপুরুষ’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ও ‘সীমাবদ্ধ’ চলচ্চিত্রে। তার সব পিরিয়ড চলচ্চিত্রও এই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। কোনো কোনো বিশেষ চরিত্র সৃষ্টির জন্য ডিটেলের বিশেষ মেজাজ সত্যজিৎ রায় তার চলচ্চিত্রে বিভিন্নভাবে সৃষ্টি করেছেন। ‘গুপিগাইন বাঘাবাইন’এ হাল্লা ও শুন্ডির বৈপরীত্য বোঝানোর জন্য স্থাপত্য রীতির ডিটেলের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। ‘মহানগর’এ অবসরপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত স্কুল মাস্টারের বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ঘরের খুঁটিনাটি কিংবা ‘কাপুরুষ’এ হ্যারিসন রোড অঞ্চলের মেস বাড়ির ত্রিকোণ ঘর,‘চারুলতা’য় ভূপতির বাড়িতে ভিক্টোরিয়ান যুগের পরিবেশ সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিচয় দেয়। ‘পথের পাঁচালী’ শেষ হয় একটি মেঘলা দিনে একটি যাত্রার মধ্য দিয়ে। এখানে যাত্রী তিনজন-হরিহর, সর্বজয়া, অপু। ‘অপরাজিত’র শেষে বর্ষণ আসন্ন মেঘের নিচে অপু আবার এগিয়ে যায়। ‘অপুর সংসার’-এর সমাপ্তি ভিন্ন। রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে একটি নতুন যাত্রার মধ্যে। দুই যাত্রী অপু আর কাজল। আরেকটি নতুন পরিবার। আলোক সংস্থানের ডিটেলে প্রথম দুই সমাপ্তি প্রসঙ্গে বিষণ্নতা ও শেষেরটিতে আনন্দের দেখা মেলে। তবুও শেষের সমাপ্তি প্রসঙ্গে অপু ও কাজলের মিলনের সময় বেদনা স্পর্শ করে। নেপথ্যে দুর্গার মৃত্যুর সুর বেজে ওঠে। এভাবে তিনটি সমাপ্তি প্রসঙ্গে ডিটেল বিন্যাসে জন্ম, মৃত্যু ও নবজন্মের আবর্তন চলে। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অনন্য ট্রিলজির স্রষ্টা হিসাবেও সত্যজিৎ রায় চিরস্মরণীয়।

সত্যজিতের চলচ্চিত্রের অন্যতম চরিত্র প্রকৃতি। প্রকৃতিকে নিজস্ব অনুভূতিতে দেখা ও দেখার চোখ তিনি শান্তি নিকেতনে নন্দলাল বসুর ছাত্র থাকাকালে আয়ত্ত করেছিলেন। নন্দলাল তার ছাত্রদের শেখানোর সময় প্রাচ্যরীতির কথা বলেছিলেন গাছের ছবি আঁকা প্রসঙ্গে। তিনি বলেছিলেন গাছ আঁকার সময় তুলির টান ওপর থেকে নিচে নয়, নিচ থেকেই ওপরে যাবে যেমন করে গাছ নিচ থেকে আকাশের দিকে উঠে আসে। বুদ্ধিগ্রাহ্য বাস্তবানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্তির মধ্যেই প্রাচ্যের আধুনিক চিত্রকলার প্রধান লক্ষণ বিদ্যমান। আধুনিকতার মিশেলে প্রকৃতি এভাবেই অন্যতর আবেদন সৃষ্টি করেছে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘অশনি সংকেত’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘পথের পাঁচালী’তে।

মানবতায় আস্থাবান সত্যজিৎ ছিলেন ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত। বিভূতিভূষণের কিছুটা মিস্টিক অপু আখ্যানকে তিনি যেভাবে সেই বিশেষ সময়ের সমাজ বাস্তবতার নিরিখ প্রতিষ্ঠা করেছেন সেটি তার আধুনিক মননেরই প্রকাশ। মায়ের শ্রাদ্ধের প্রশ্নে নির্লিপ্ত কণ্ঠে অপু বলে, ‘সব কালী ঘাটে সেরে নেব।’ ধর্ম সম্পর্কে এমন নির্মোহ সিদ্ধান্তই সত্যজিতের বিশ্বাসের জগৎ। ধর্ম সম্পর্কে একটি উপমহাদেশীয় সংস্কার রয়েছে আমাদের শিল্পীদের। সত্যজিৎ তা অতিক্রম করেছেন ‘দেবী’তে সেই ১৯৬০ সালেই। সত্যজিতের অসামান্য সৃষ্টি ‘দেবী’ ছবির এক দিকে ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার, অন্যদিকে যুক্তিবাদ ও আলোকিত চিন্তাধারা। একটির প্রতীক জমিদার কালীকিঙ্কর, অন্যটির প্রবক্তা পুত্র উমাপ্রসাদ। মাঝে আরোপিত দেবী-মাহাত্ম্যে বিপর্যস্ত পুত্রবধূ দয়াময়ী। তাদেরকে কেন্দ্র করে সুখী একটি পরিবারের ট্র্যাজিক পরিণতিকে সত্যজিৎ সাবলীল দ্যোতনাময়-চিত্রভাষায় উপস্থিত করেছেন। ধর্মীয় অনাচারের বিরুদ্ধে তার দ্রোহী মনের পরিচয় পাওয়া যায় শেষের দিকের ‘গণশত্রু’ ছবিতেও। হিন্দিতে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সদগতি’ ধর্মীয় কুসংস্কার ও জাতিভেদের বিরুদ্ধে সত্যজিতের জোরালো চপেটাঘাত। উনিশ শতকের বাংলার রেনেসাঁস গভীরভাবে ক্রিয়াশীল ছিল সত্যজিতের মননে। ভারতীয় চলচ্চিত্রে একমাত্র তিনিই এর উত্তরসূরি।

সংগীত পরিচালক হিসাবেও সত্যজিৎ রায় অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ‘তিন কন্যা’ থেকে তিনি নিজেই নিজের ছবিগুলোর সুর সৃষ্টি করেছেন। এর আগে তিনি রবিশংকরের সঙ্গে চারবার এবং আলী আকবর ও বিলায়েত খাঁর সঙ্গে একবার করে কাজ করেছেন। তার সাংগীতিক মেধার অনন্যসাধারণ প্রকাশ ঘটেছে ‘চারুলতা’ ছবিতে। ‘চারুলতা’ নির্মাণকালে মোজার্টের সোনাটা এবং সিম্ফনি তাকে অনুপ্রাণিত করে। শুধু চলচ্চিত্র হিসাবেও নয়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গীয় অভিজাত গৃহে গানের পরিবেশ কেমন ছিল তার ইতিহাসরূপেও ‘চারুলতা’ আলাদা ডকুমেন্টারির মর্যাদা পাবে।

‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘হীরক রাজার দেশে’ এবং গোয়েন্দা-ছবি‘ সোনার কেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ছবিগুলো ছোটদের জন্য হলেও বড়দের বিনোদনের খোরাকও কম নেই। ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে সত্যজিৎ ফ্যানটাসির আড়ালে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, জরুরি অবস্থার অবিচার-অত্যাচারকে দৃশ্যগ্রাহ্য করে তুলেছেন। স্বল্প দৈর্ঘ্যরে টিভি ছবি ‘পিকু’ একটি বালকের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি প্রাপ্তবয়স্ক থিমের চর্চা। টিভি চরিত্র ‘টু’-এ ধনী ও দরিদ্র দুটি ছেলের ছবির সংঘাতে ফুটে উঠেছে মানবিক সত্তা।

সত্যজিৎ রায় তার অধিকাংশ চলচ্চিত্রে অতীত চারিতার পরিচয় দিয়েছেন। সমকালের প্রতিও যে তিনি সচেতন সত্তর দশকের কলকাতাকেন্দ্রিক ছবিগুলো তার নিদর্শন। একালের সমাজের নানা ব্যাধি, দুর্নীতি ও ধর্মাচরণের নামে কুসংস্কার ও ব্যবসা তার ক্যামেরার লক্ষ্যবস্তু হলো ‘গণশত্রু’ ও ‘শাখা-প্রশাখা’ ছবিতে। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে তিনি রাজনীতি-সচেতন, ‘গণশত্রু’ ও ‘শাখা-প্রশাখা’য় তিনি ক্রুদ্ধ প্রতিবাদী। শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ নৈতিকতা, মানুষের ধর্ম এবং সুস্থ জীবনধারার মূল্যবোধ নিয়ে চর্চার প্রতীক। এ ছবিতে সত্যজিৎ তার জীবনদর্শনের কথা শোনাতে চেয়েছেন। পরিব্রাজক-আগন্তুক মানুষটি যেন প্রগতিশীল, আধুনিক ও সমাজমনস্ক সত্যজিতের মুখপাত্র।

সত্যজিতের পাঁচটি তথ্যচিত্রের মধ্যে চারটিই ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক। সত্যজিৎপ্রতিভার নির্ভুল স্বাক্ষর রয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ ছবিতে। কবির জন্মশতবার্ষিকীতে নিবেদিত প্রায় ঘণ্টাখানেকের এ ছবি ভারতীয় তথ্যচিত্রের ইতিহাসে একটি দিকনির্দেশক। আরও দুটি অনবদ্য তথ্যচিত্র ‘দ্য ইনার আই’ এবং ‘সুকুমার রায়’। প্রথমটি সত্যজিতের চিত্রকলা-শিক্ষক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের জীবন ও শিল্পকৃতি বিষয়ে। দ্বিতীয়টি অকালপ্রয়াত প্রতিভারধর পিতার নানা দিক নিয়ে পুত্রের আসাধারণ পর্যবেক্ষণ।

বিশ্ব পরিসরে আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতির উচ্চায়ত অবস্থান তৈরিতে রবীন্দ্রনাথের পরই সত্যজিতের অবস্থান। তার বহুমুখী প্রতিভার পরশে প্রতিটি চলচ্চিত্র অর্জন করেছে ধ্রুপদী মান। রুচির দৈন্য ও স্থূলতার বিরুদ্ধে আপসহীন এ মানুষটি ছিলেন অদ্বিতীয়- প্রতিভার বিশালতায় ও একাগ্রতায়। ভারতীয় তথা বাংলা চলচ্চিত্রের মুক্তিদাতা এ শিল্পীর জন্মশতবর্ষে অশেষ শ্রদ্ধা।

*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায়, ৩০ এপ্রিল ২০২১। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনরায় প্রকাশিত।