By সজীব সরকার
গ্যাসলাইটিং (gaslighting)
Media School May 9, 2024
প্রতীকী ছবি।
বিভিন্ন অভিধানে উল্লেখ করা অর্থ অনুযায়ী গ্যাসলাইটিং (gaslighting) শব্দের অর্থ হলো, কোনো ব্যক্তিকে ছল-চাতুরির মাধ্যমে বিশ্বাস করানো যে, বিশেষ কোনো ঘটনা বা বিষয় নিয়ে তার অভিজ্ঞতা বা স্মৃতির পুরোটাই ভ্রান্ত। এমনকি, গ্যাসলাইটিংয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিকে ভ্রান্ত প্রমাণের পাশাপাশি তার মানসিক স্থিতিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।
শব্দটির প্রচলন হলো যেভাবে
ব্রিটিশ নাট্যকার প্যাট্রিক হ্যামিলটনের লেখা নাটক গ্যাসলাইট (১৯৩৮) থেকে গ্যাসলাইটিং শব্দের এমন অর্থ প্রথম প্রচলন হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ওই নাটকের মূল গল্পে দেখা যায়, এক স্বামী নানা কৌশলে তার স্ত্রীকেই বোঝাতে চান, তিনি (স্ত্রী) উন্মাদ। অর্থাৎ, স্বামী চরিত্রটি এখানে গ্যাসলাইটিং করছেন।
হ্যামিলটনের ওই নাটক অবলম্বনে ১৯৪০ ও ১৯৪৪ সালে দুটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়। পরে এ ধারণাটি নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা ও লেখালেখিও শুরু হয়। এভাবে গ্যাসলাইটিং শব্দটির এমন ব্যবহার পৃথিবীর নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের এক অভিধান প্রকাশক গ্যাসলাইটিংকে 'ওয়ার্ড অব দি ইয়ার' নির্বাচিত করে।
২০১৮ সালে বলিউডে মুক্তি পাওয়া হিন্দি ভাষার একটি চলচ্চিত্রেও গ্যাসলাইটিংয়ের এমন ব্যবহার দেখা গেছে। চলচ্চিত্রটির গল্প এমন যে, এক ব্যক্তি বিয়ের পর জানতে পারে, শারীরিক ত্রুটির কারণে তার পক্ষে সন্তানের বাবা হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু, তার স্ত্রী তখন গর্ভধারণ করেছে। স্বামী খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, গর্ভস্থ সন্তানটি তার স্ত্রীর সাবেক প্রেমিকের ঔরসজাত। লোকটি এ ঘটনা মেনে নিতে পারে না এবং স্ত্রীর ওপর প্রতিশোধের পরিকল্পনা করে। একসময় তার স্ত্রী এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। এর কয়েক বছর পর স্বামীটি একদিন ভাড়াটে লোক দিয়ে স্কুল থেকে শিশুটিকে অপহরণ করায়। স্ত্রী যখন সন্তানকে না পেয়ে বিচলিত, স্বামীটি তখন তাকে বলে যে তাদের কখনোই কোনো সন্তান ছিলো না। স্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে স্বামীটি বলে, সবই তার কল্পনা (হ্যালুসিনেশন)। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ এবং সন্তানের অস্তিত্ব প্রমাণের সব ধরনের চিহ্নও ঘর থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। অন্যদিকে, স্বামীটি তাদের পাড়া-প্রতিবেশী ও স্কুলের শিক্ষকদের বোঝায় যে, একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে স্ত্রী শোকে ট্রমায় আক্রান্ত হয়েছে এবং চিকিৎসকরা বলেছেন, তার কোনো সন্তান ছিলো না- এটা বোঝানোই তার শোকস্তব্ধ স্ত্রীকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায়। ফলে, স্বামী কিংবা পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা অন্য আত্মীয়-স্বজন - কাউকেই সে বিশ্বাস করাতে পারছিলো না যে তার সত্যিই একটি কন্যাসন্তান ছিলো। এই মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে একসময় স্ত্রী আত্মহত্যা করেন।
ছল-চাতুরি বা মিথ্যাচারের মাধ্যমে ভুলকে সঠিক বা সঠিককে ভুল প্রমাণের নাম গ্যাসলাইটিং - তা জানা না থাকলেও এমন আচরণ একেবারে বিরল নয়। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও বিশেষত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে গ্যাসলাইটিংয়ের ব্যবহার অনেক পুরনো। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও দেখা যাবে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন কিংবা চীন-তাইওয়ান সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশ বা নানা পক্ষ একই বিষয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য-ব্যাখ্যা-যুক্তি উপস্থাপন করছে। এভাবে আসলে নিজ দেশের জনগণের পাশাপাশি বিশ্ববাসীকে এসব দেশ নিজেদের মতো করে প্রভাবিত করতে চাইছে।
তথ্যঋণ : দেশ, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ সংখ্যার সম্পাদকীয়।