Media School

Dhaka    Saturday, 23 November 2024

By সজীব সরকার

গণমাধ্যম সাক্ষরতার গুরুত্ব

Media School July 31, 2024

শুরুতেই ‌‘গণমাধ্যম সাক্ষরতা’ অভিধার অর্থ স্পষ্ট করে নেওয়া যাক।

গণমাধ্যম সাক্ষরতার (মিডিয়া লিটারেসি) মধ্যে অনেকগুলো উপাদান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো : গণমাধ্যমে যেসব আধেয় (কনটেন্টস) প্রচার বা প্রকাশ করা হয়, এতে প্রবেশগম্যতা (অ্যাকসেসিবিলিটি) থাকা; আধেয়গুলো পড়তে পারার পাশাপাশি সমালোচনাত্মকভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে এগুলোর সঠিক অর্থ বা অন্তর্নিহিত বার্তা বুঝতে পারা; এসব বার্তা কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে পারা; এর মধ্যে কোনো পক্ষপাত বা ভুল থাকলে তা উপলব্ধি করতে পারা; সামাজিক ও জাতীয় পরিসরে কল্যাণকর কাজে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতে পারা এবং প্রয়োজনে গণমাধ্যমের সার্বিক কর্মপ্রক্রিয়ায় প্রভাব তৈরি করতে পারার মতো সক্ষমতা থাকা।

গণমাধ্যম সাক্ষরতার গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি শর্ত হলো গণমাধ্যমের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তথা জনজীবনে ও রাষ্ট্রে সার্বিক ভূমিকাকে তুলনা ও বিশ্লেষণ করতে পারা।

গণমাধ্যম সাক্ষরতা কথাটির আরো অনেক ব্যাপকতা বা প্রায়োগিক দিক অবশ্যই রয়েছে; তবে, তা বর্তমান লেখাটির ফোকাস নয়। তাই, এ লেখার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক।

বিগত কয়েক দশকে গণমাধ্যম আকারে-প্রকারে যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে এর অডিয়েন্সের সংখ্যা ও বৈচিত্র্য। এমন বিকাশ ভালো, তবে কিছু শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষে।

কোনো বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে তথ্য ও বিশ্লেষণ পাওয়ার জন্য মানুষ গণমাধ্যম ব্যবহার করে। এসব তথ্য অবশ্যই সঠিক বা নির্ভুল ও নিরপেক্ষ তথা বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে। কিন্তু, গণমাধ্যমে প্রায়ই ভুল, আংশিক ও পক্ষপাতদুষ্ট তথ্য প্রচার বা প্রকাশ করা হয়। সাংবাদিকদের দক্ষতা, সততা বা আন্তরিকতার অভাব এর জন্য অনেকাংশে দায়ী।

এ ছাড়া গণমাধ্যমগুলোতে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা সবসময় চলছে- কার আগে কে খবর দেবে, কার চেয়ে কে বেশি খবর দেবে। এমন প্রতিযোগিতায় নিজেকে নির্বিচারভাবে নিমজ্জিত করার কারণে বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রায়ই ভুল বা আংশিক কিংবা পক্ষপাতমূলক খবর প্রচার করছে। একই ঘটনার খবরে টিভি চ্যানেলগুলোর স্ক্রলে প্রচারিত তথ্যে অনেক গরমিল থাকে; অনেক ক্ষেত্রেই এসব তথ্য পূর্ণাঙ্গ ও পরীক্ষিত নয়। অথচ, কোনো একটি ঘটনা যখন ঘটে, তখন সে ব্যাপারে যথেষ্ট খোঁজখবর নিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে ওই খবর প্রচার করতে হয়।

সঠিক তথ্য বস্তুনিষ্ঠভাবে বলা হচ্ছে- এটি নিশ্চিত করা সাংবাদিকতার অন্যতম শর্ত। কিন্তু, নির্বিচার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকায় প্রায়ই এ শর্ত ভঙ্গ হচ্ছে। অনলাইন পত্রিকাগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কাগজে ছাপা পত্রিকার ক্ষেত্রেও তথ্যবিভ্রাট বা একপেশে খবরের উপস্থিতি বিরল নয়।

এ ধরনের প্রতিযোগিতা, তথাকথিত জনপ্রিয়তার পেছনে ছোটা এবং আর্থিক, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো ধরনের সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা - এসব কারণে সাংবাদিকতার মৌলিক ও নৈতিক বিধিমালাকে প্রায়ই উপেক্ষা করা হচ্ছে। আবার, কিছু সংবাদমাধ্যম রয়েছে যেখানে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ সাংবাদিক নেই। এসব বিষয় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার পথে বাধা তৈরি করে।

বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মানুষের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এখান থেকেই মানুষ প্রতিদিনের খবরগুলো জানার চেষ্টা করে। ফলে, এ মাধ্যমে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত বা প্রকাশিত খবরগুলো শেয়ার করা হচ্ছে। যখন বিশ্বস্ত কোনো গণমাধ্যমের খবর শেয়ার করা হচ্ছে, তখন তা নিরাপদ; কিন্তু, অনেক সময় ভুয়া খবর বা গুজবকে ‘সংবাদ’ তথা ‘সত্য বা সঠিক তথ্য’ বলেও প্রচার করা হচ্ছে। এ কারণে খবরের উৎস হিসেবে শুধুই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরতার প্রবণতা বিপজ্জনক।

তথ্য, অপতথ্য, মিথ্যা তথ্য, গুজব - এমন কয়েকটি অভিধা বেশকিছুদিন ধরেই আলোচিত হচ্ছে। কোনটি সঠিক তথ্য, কোনটি আংশিক তথ্য, কোন তথ্যে পক্ষপাত রয়েছে আর কোনটি পুরোপুরি গুজব - তা চিহ্নিত করতে পারার সক্ষমতা সবার সমান নয়। কিন্তু, এ সক্ষমতা থাকা সবার জন্যই খুব জরুরি।

বাংলাদেশেই বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, ফেসবুকের মতো মাধ্যমে কারো ব্যক্তিগত স্ট্যাটাস থেকেই শেষ পর্যন্ত ভাঙচুর, আগুন দেওয়া এমনকি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটে গেছে। অনেকে ব্যক্তিগত পক্ষপাত থেকে কোনো খবর বা ঘটনাকে বিচার করে নানাকিছু লিখে থাকেন। অনেকে ভুয়া কোনো ‘পত্রিকা’র খবর বুঝে বা না বুঝে শেয়ার করেন। কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে সত্য-মিথ্যা নানা তথ্য প্রচার করে। অনেকে পুরনো বা ভিন্ন প্রেক্ষাপটের কোনো তথ্য বা ছবিকে চলমান কোনো ঘটনার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে গুজব ছড়িয়ে দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকে তা যৌক্তিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ না করেই বিশ্বাস করেন।

প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলোও অনেক সময় নিজেদের কোনো স্বার্থ বা এজেন্ডা রক্ষা করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট একটি ঘটনার পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেয়। দেখা যায়, ওই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে তারা একটি ঘটনাকে আংশিকভাবে প্রচার করে অথবা ভুল বা পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানোর চেষ্টা করে। কিছু গণমাধ্যম বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের চাটুকারিতা অথবা বিরোধিতা করতে গিয়ে কিংবা ব্যবসায়িক কোনো গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টায় অনেক সময় পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে।

এসব কারণে গণমাধ্যম সাক্ষরতাকে এখন একটি অপরিহার্য দক্ষতা হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। নানা ঘটনায় বারবারই প্রমাণিত হচ্ছে, সাধারণ অর্থে সাক্ষরতার (তথাকথিত শিক্ষা বা ডিগ্রি) সঙ্গে গণমাধ্যম সাক্ষরতার অপরিহার্য বা সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত, স্বল্পশিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত যে-ই হোক- সব শ্রেণির মধ্যেই গণমাধ্যম সাক্ষরতার অভাব দৃশ্যমান। অর্থাৎ, প্রচলিত অর্থে ‘শিক্ষিত’ হলেই যে কারো মধ্যে গণমাধ্যম সাক্ষরতা থাকবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এমনকি গণমাধ্যমের নিয়মিত অডিয়েন্স হলেই ব্যক্তির মধ্যে নিশ্চিতভাবে গণমাধ্যম সাক্ষরতা থাকবে- এমনও নয়। বরং, এটি এমন বিশেষ এক দক্ষতা যা আলাদা করে সচেতন চর্চার মাধ্যমে নিজের মধ্যে গড়ে তুলতে হয়।

শিশু-কিশোররাও এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানা গণমাধ্যম ব্যবহার করে। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এবং দরিদ্র পরিবারগুলোতেও এখন প্রথাগত গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের হার ও মাত্রা - দুটোই বেড়েছে। শ্রেণি-পেশা-বয়স-লিঙ্গ নির্বিশেষে অনেকের মধ্যেই গণমাধ্যম সাক্ষরতার অভাব রয়েছে। তাই, সবার মধ্যেই গণমাধ্যম সাক্ষরতা তৈরি বা বাড়ানো প্রয়োজন।

অস্থিতিশীল বা সঙ্কটময় কোনো পরিস্থিতিতে গণমাধ্যম সাক্ষরতার অভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান হয়। প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগকালে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ বা অডিয়েন্সের অনেকেই যার কাছে যা শোনে, তা-ই বিশ্বাস করে। কোন তথ্য কোথা থেকে এলো, সেই তথ্য বা তথ্যের উৎস বিশ্বাসযোগ্য কি না- তা যে বিবেচনায় রাখা জরুরি, এ ভাবনাই হয়তো অনেকের নেই। দুর্বল বা ভুয়া সংবাদমাধ্যম, বিশ্বস্ত গণমাধ্যম, ফেইক নিউজ, গুজব আর বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ - এসবের মধ্যে অনেকেই পার্থক্য করতে পারেন না। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা-ই ভেসে বেড়ায়, অনেকে সেটিই নিজে বিশ্বাস করেন এবং অন্যের কাছেও তা প্রচার করেন।

এমন হলে চলমান সঙ্কটময় পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। ‘কোটা সংস্কার’ ইস্যুতে বর্তমানে সারা দেশে যে পরিস্থিতি চলছে, এ সময়ও দেখা গেছে, ফেসবুক বা ইউটিউবসহ নানা মাধ্যমে অনেকের প্রচার করা ভুল তথ্য, গুজব অথবা খবরের আংশিক বা খণ্ডিত ও পক্ষপাতমূলক উপস্থাপন অনেকে বিশ্বাস করেছেন। এমন প্রবণতার কারণে সঙ্কট আরও বাড়ে এবং সহিংসতা আরও উসকানি পায়।

সাধারণ মানুষ তথা খবরের পাঠক-দর্শক-শ্রোতার মধ্যে তাই গণমাধ্যম সাক্ষরতা থাকা খুব জরুরি। এ সাক্ষরতা থাকলে গণমাধ্যম ব্যবহারের সময় এতে থাকা আধেয়ের সত্য-মিথ্যা, বস্তুনিষ্ঠতা, মান ও এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে অডিয়েন্সের স্পষ্ট ধারণা থাকবে। ফলে, মিথ্যা তথ্য বা গুজবে বিশ্বাস করার প্রবণতা কমবে।

মোদ্দা কথা হলো, গণমাধ্যমগুলোকে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে। কোনো ঘটনা ঘটার পর পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে এ বিষয়ে নানারকম তথ্য দিতে শুরু করা যাবে না। একই ঘটনার একই খবর দিনভর বা দিনের পর দিন প্রচার থেকে বিরত থেকে নতুন তথ্যের সন্ধান করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের আরও সচেতন হতে হবে; সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো তথ্য পাওয়ামাত্রই তা বিশ্বাস ও প্রচার (শেয়ার) না করে বিশ্বস্ত সূত্র থেকে এর সত্যতা যাচাই করে নিতে হবে।

অভিভাবকদের উচিত দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে শিশুদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনা করা। এসব মাধ্যমের ব্যবহার, গুরুত্ব, ভালো-মন্দ দিক ও বয়স অনুপাতে নিরাপদ ব্যবহারের ধারণা শিশুদের মধ্যে তৈরি করা জরুরি। ব্যক্তিগত পর্যায়েও এসব মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজের জানাশোনার পরিধি বাড়ানো এবং এসবের নৈতিক ব্যবহারের প্রতি দায়বদ্ধতার বোধ জাগ্রত করা দরকার।

রাষ্ট্রের নানা পর্যায়েও যথেষ্ট দায়িত্বশীলতা, উদারতা ও স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে ওঠার মধ্য দিয়েই প্রকৃত কল্যাণকর সমাজব্যবস্থা নিশ্চিত হতে পারে।

*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক বাংলা-তে, ২৮ জুলাই ২০২৪। সম্পাদকীয় বিভাগের মৌখিক অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।