By সজীব সরকার
করোনায় শিক্ষার ক্ষতি সামলাতে হবে এখন থেকেই
Media School July 4, 2020
নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বর্তমান দুর্যোগ সামাল দিতে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বন্ধ রয়েছে প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান। সীমিত আকারে চালু রয়েছে অপরিহার্য জনসেবামূলক কিছু প্রতিষ্ঠান বা প্রাসঙ্গিক কার্যক্রম। শুরু থেকেই নানা দেশের বিশেষজ্ঞরা এ কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও এর অপূরণীয় ক্ষতির কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। অনেকে বলছেন, অর্থনীতির আগে জনস্বাস্থ্য নিয়েই ভাবা বেশি জরুরি। এ কথার সঙ্গে দ্বিমতের কোনো সুযোগ নেই। তবে শিক্ষক হিসেবে আমি শিক্ষাব্যবস্থার ‘ক্ষতিপূরণ’ কী উপায়ে হবে, এ নিয়ে এখন থেকেই ভাবা জরুরি বলে মনে করি।
এ বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রমাণ মেলে। ঝুঁকি বাড়তে শুরু করলে সরকারি প্রজ্ঞাপনে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ রাখতে বলা হয়। এরপর একাধিক প্রজ্ঞাপনে এ সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী ৩০ মে পর্যন্ত এ ছুটি বাড়ানোর কথা জানানো হয়েছে। প্রায় দুই মাসে দেশে করোনা সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার; মৃত্যু প্রায় দুই শ। এখনো প্রতিদিনের পরীক্ষায় শনাক্তের এ সংখ্যা বাড়ছে। করোনা পরিস্থিতির এখনো কোনো উন্নতি হয়নি। ফলে প্রায় দেড় মাস ধরে বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অবধারিতভাবেই সামনের দিনগুলোতে আরও অনেক দিন বন্ধ থাকবে। সরকারি আভাস অনুযায়ী, অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ ছুটি চলমান থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
অনির্দিষ্টকালের এই দীর্ঘ ‘বিরতি’ নানা কারণেই দুশ্চিন্তার উদ্রেক করছে। স্কুলশিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারি নির্দেশে টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সম্মতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে অনলাইন ক্লাস বা দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করছে। আর কলেজগুলো কী করছে বা কী করবে, এ বিষয়ে কোনো পক্ষ থেকেই স্পষ্ট কোনো তথ্য জানানো হয়েছে, এমনটি অন্তত আমার জানা নেই।
বিকল্প উপায়ে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার এসব উদ্যোগ নিঃসন্দেহে খুব প্রাসঙ্গিক ও প্রশংসার দাবিদার। তবে বিকল্প এই পাঠদানপ্রক্রিয়া শ্রেণিকক্ষের সক্রিয় পাঠদানের সমান কার্যকর নয়। এ ছাড়া গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা গেছে, দেশের কিছু স্থানে কেব্ল নেটওয়ার্কের সংযোগ না থাকায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা সংসদ টেলিভিশনে তাদের জন্য প্রচারিত পাঠদানের অনুষ্ঠান দেখতে পারছে না। আবার আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি, দেশে ইন্টারনেট প্যাকেজের মূল্য বেশি হওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষকেরা অনলাইনে যেসব ক্লাস নিচ্ছেন, সেগুলোতে সব সময় অংশ নিতে পারছেন না।
এসব সীমাবদ্ধতার ফলে শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ক্ষতি কিছু যে হবেই, এ সত্য মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। আর শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সময় হাতে পাওয়া যাবে, এমন নিশ্চয়তাও নেই। তাই এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অন্তত দুই ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে করতে হতে পারে:
এক.
শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ পাঠদান ও সঠিক মূল্যায়ন ছাড়াই পরবর্তী ক্লাসে/সেমিস্টারে উতরে দেওয়া অথবা
দুই.
বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে একটি সেমিস্টার বাতিল ঘোষণা করে দ্বিতীয়বার তা শুরু করা। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অন্তত একটি সেমিস্টার তথা ক্ষেত্রবিশেষে চার বা ছয় মাস সময় নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি তারা আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ক্ষেত্রে আগেই পরিশোধ করা ফি যেন তাদের দ্বিতীয়বার দিতে বাধ্য করা না হয়, সেদিকে ইউজিসিসহ সরকারের বিশেষ নজর রাখা উচিত।
আরেকটি বাস্তবতা হলো, অবকাঠামোগত কারণেই আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাস বা দূরশিক্ষণে অভ্যস্ত নয়। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াত বন্ধ থাকায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাঠদান ও গ্রহণ প্রক্রিয়ার যে নানা রকম ইতিবাচক দিক বা সুফল রয়েছে, সেগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। আর দীর্ঘ সময় ধরে শ্রেণিকক্ষে শারীরিক অনুপস্থিতি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মধ্যে থাকার স্বাভাবিক প্রবণতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার প্রতি দীর্ঘমেয়াদি বৈরাগ্য বা অনীহা সৃষ্টি হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এই দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট মন্দার কারণে অভিভাবকদের আর্থিক সংকটের দরুন অনেক পরিবারের ছেলেমেয়ের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এসব কারণে স্কুল-কলেজ এবং বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ড্রপ-আউট বা ঝরে পড়া বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা কেবল পড়াশোনা করে না; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত যাতায়াত, শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহণ, বন্ধুদের আড্ডা ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়াও চলমান থাকে, যা অনাকাক্ষিত ও অপরিকল্পিত এই দীর্ঘ বিরতিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই ঘরে স্বেচ্ছাবন্দিত্বের এই সময়ে শিক্ষার্থীদের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও অভিভাবক ও শিক্ষকদের যত্নশীল হওয়া দরকার।
একাডেমিক ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ নানা কারণেই এখন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মধ্যে রাখা দরকার। তবে খেয়াল রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা এখন নানাবিধ উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। এ সময় তাদের ওপর পড়াশোনার বাড়তি চাপ তৈরি করা যাবে না। এই সময়ে পড়াশোনার মাত্রা হতে হবে সহনীয় পর্যায়ের। মনে রাখতে হবে, অনলাইন বা দূরশিক্ষণ কিংবা এ ধরনের বিকল্প পাঠদান কখনোই শ্রেণিকক্ষের সক্রিয় পাঠদানের সুযোগ্য বিকল্প নয়। জরুরি প্রয়োজনে সাময়িক বিকল্প বা স্বাভাবিক সময়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সহায়ক মাত্র। তাই চলমান অবস্থায় সব চেষ্টার পরও স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমের কিছু ক্ষতি যে হবেই, তা মেনে নিতেই হবে। ক্রমান্বয়ে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
এ জন্য এখন কেবল ‘সিলেবাস শেষ করার প্রয়োজনে’ শিক্ষার্থীদের মাথায় পড়াশোনার বোঝা চাপিয়ে দিলে চলবে না; এই সময়টিতে আমাদের উচিত হবে একাডেমিক কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থীদের সার্বিক খোঁজখবর নেওয়া। একাডেমিক চাপ যতটা সম্ভব কম দিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল নানা কাজে ব্যস্ত রাখা দরকার। এ জন্য প্রয়োজনে পাঠ্য বা রেফারেন্স বইয়ের পড়াশোনা সীমিত রেখে সিলেবাসের বিষয়গুলোর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ কিন্তু বিকল্প ও বিনোদনমূলক উপায়ের সঙ্গে তাদের যুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সিলেবাস বা পাঠের বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নাটক বা চলচ্চিত্র দেখা, গান শোনা ও বই পড়াকে উৎসাহিত করা দরকার। এর বাইরেও সহজ-সরল ও সুস্থ বিনোদন দেয়, এমন অন্য নাটক, সিনেমা, গান, বই ইত্যাদি নিয়ে সময় কাটাতে তাদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কাজকর্মে যুক্ত থাকতে বলা ও নিজের বাড়তি যত্ন নেওয়ার বিষয়টিকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।
সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষকেরা যদি একাডেমিক প্রয়োজনের বাইরেও নিয়মিতভাবে শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা সব সময় উৎসাহিত ও উজ্জীবিত বোধ করবে। তাই এমন দুর্দিনে, আসুন আমরা শিক্ষকেরা আমাদের শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াই তাদের পরম বন্ধুর মতো; হয়ে উঠি তাদের সত্যিকার শুভাকাঙ্ক্ষী, কল্যাণকামী ও প্রকৃত মঙ্গলসাধক।
[লেখাটি প্রথম আলো-তে ৮ মে ২০২০ প্রকাশিত হয়।]