By সজীব সরকার
‘করোনা’ আমাদের কী শেখালো?
Media School July 4, 2020
নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকে সারা বিশ্বে নানা রকমের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। শুধু জনস্বাস্থ্য নয়—সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, পরিষেবা, অর্থনীতি, রাজনীতি বা পররাষ্ট্রনীতি—সব ব্যবস্থায় আঘাত হেনেছে এ ভাইরাস।
করোনার প্রভাবে চিরাচরিত বিশ্বব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এবং প্রকাশ্যে ও আড়ালে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এই বৈশ্বিক দুর্যোগের মধ্যেও কেউ কেউ ‘রাজনীতি’ করার চেষ্টা করছেন; যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বোধ হয় এদের মধ্যে কুলশিরোমণি! দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা সম্প্রতি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলেছে, এ ভাইরাস মানুষ সৃষ্টি করেনি; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্যও অনুরূপ। কিন্তু ট্রাম্প নিরলসভাবে এখনো দাবি করে যাচ্ছেন, এ ভাইরাস চীন সরকার উহানের ল্যাবেই তৈরি করেছে যার জন্যে ট্রাম্প চীনকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। চীন সরকার সত্যিই যদি ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে’ এ ভাইরাস তৈরি করে থাকে, তাহলে তার ‘উচিত শিক্ষা’ নিঃসন্দেহে প্রাপ্য; তবে এ ভাইরাসকে উপলক্ষ করে চীনকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে ট্রাম্পের অতি-উৎসাহ সন্দেহজনকই বটে!
যে ভাইরাস ‘সৃষ্টির’ দোষে ট্রাম্প চীনকে একহাত দেখে নিতে উঠে-পড়ে লেগেছেন, শুরুতে ট্রাম্প সেই ভাইরাসকেই ‘চীনের তৈরি’ বলে তাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন, ‘এশীয়’ এ ভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রের মতো (উন্নত) দেশের কিছুই হবে না। চীনের প্রতি তাচ্ছিল্য দেখানোর এই সুযোগ নিতে ট্রাম্প অর্বাচীনের মতো যে পঙ্কিল রাজনীতির খেলায় মেতেছিলেন, তার নির্মম পরিণতি ভোগ করছে আজ সারা দেশ; বার বার সতর্ক করার পরও দীর্ঘদিন তিনি কোনো ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় এ ভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত দেশে পরিণত হয়েছে।
ভারতে অন্য রোগের একটি ওষুধ করোনার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হচ্ছিল; ট্রাম্প সেই ওষুধ দাবি করলে প্রথমে ভারত সরকার তা দিতে রাজি হয়নি। পরে ট্রাম্পের ‘হুমকির’ মুখে সেই ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো শুরু হয়। এখানেও চলেছে রাজনীতির খেলা!
চীনের উহানে এ ভাইরাস সংক্রমণের খবর আনুষ্ঠানিকভাবে জানা যায় গত বছরের ডিসেম্বরে। নানা দেশের গণমাধ্যমসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, নভেম্বর বা এর আরো অনেক আগেই উহানে এ ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়; তবে চীন সরকার অনেকদিন পর্যন্ত এ খবর চেপে রেখেছিল। ডিসেম্বরের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তখনই শুধু এ খবর সরকারিভাবে জানানো হয়।
উহানে এ ভাইরাসের কারণে মৃত্যুর তথ্য নিয়েও প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে চীন সরকারের বিরুদ্ধে।
প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, যখন পুরো চীনে মোট হাজার চারেকের মতো মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে, সে সময় অবধি কেবল উহানেই অন্তত ৪০ হাজারের বেশি মৃতদেহ গোপনে পোড়ানো হয়েছে যাদের সবাই করোনাভাইরাসের কারণে মারা গেছে।
সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বলছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে তথাকথিত উন্নত দেশগুলোও করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে পারেনি। উন্নত চিকিৎসার জন্যে খ্যাতিমান দেশগুলোও করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে; বিশ্বে এ পর্যন্ত মোট মৃত্যু প্রায় আড়াই লাখ। কল্পনাতীত রকমের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ এখন মহাকাশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে; অথচ এ ভাইরাসের খবর জানবার পর এখন পর্যন্ত প্রায় ছয় মাসেও নিতান্ত ‘ফ্লু’ গোত্রের এই রোগের নিশ্চিতভাবে কার্যকর একটি ওষুধ বা টিকার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। জ্ঞান-বিজ্ঞানে চূড়ান্ত উৎকর্ষের দম্ভ তাহলে নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কিছু নয়!
৫০০ বা এক হাজার বছর আগে এমন সংক্রামক রোগ দেখা দিলে রোগ সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান ও ওষুধ বা চিকিৎসার অভাবে তা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ত। ২০২০ সালে এসে এই ‘ফ্লু’ ছড়িয়ে পড়ল একটি দেশ থেকে সারা পৃথিবীর মোট ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে; বিগত এক হাজার বছরে তাহলে আমাদের অগ্রগতি বা অর্জন কী?
একসময় মানুষ যাযাবর জীবন যাপন করত। খনিজ সম্পদের সন্ধান জানা না থাকায় এবং জীবিকা নির্বাহের জ্ঞান ও সুযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে পৃথিবীর নানা প্রান্তে সগোত্র ঘুরে বেড়ানো ছাড়া তাদের অন্য উপায় ছিল না। ওই সময়ে সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে একটি জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিবাদে ও সংঘর্ষে লিপ্ত হতো; একে অন্যের সম্পদ কেড়ে নিতো। ওই সময়ে মানুষের মধ্যে সার্বভৌমত্ব বা মানবাধিকারের চেতনা ছিল না; মানুষ জীবনধারণ করতো মূলত বাঁচার তাগিদে, জীবনের নিয়মে।
সময়ের পরিক্রমায় ও অভিজ্ঞতার বদৌলতে মানুষ জ্ঞানে-গরিমায় উন্নত হয়েছে; মূল্যবোধ ও আইন-কানুন প্রণয়ন করেছে। সম্পদের সন্ধান করতে শিখেছে, এমনকি নতুন সম্পদ উৎপাদন করতে শিখেছে। জীবিকার নানা কৌশল আয়ত্ত করেছে। জীবনধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় সম্পদ সহজলভ্য হতে শুরু করলে কালক্রমে মানবতা ও মানবাধিকারের বোধ জন্মেছে মানুষের মধ্যে। আর নতুন এ মানবগোষ্ঠী নিজেদের সভ্য ও শিক্ষিত এবং আইন-মানবাধিকার-রাজনৈতিক কাঠামোর জ্ঞান বা ধারণা না থাকা আগেরদিনের মানুষকে আদিম-অসভ্য-বর্বর বলে আখ্যা দিয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা কী বলে?
মানবেতিহাসের এতটা সময় পেরিয়ে এলেও আমরা সত্যিকার অর্থে ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে পেরেছি কতখানি? উত্তরটি খুব আশাব্যঞ্জক নয়; আমাদের পরিচয় আমরা হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ বা অন্যকিছু। এখনো আমাদের পরিচয় আমরা নারী বা পুরুষ। নারী আর পুরুষের বাইরে থাকা বৈচিত্র্যপূর্ণ (তৃতীয়) লিঙ্গের মানুষদের তো অস্তিত্বই অস্বীকার করতে পারলে আমরা বেঁচে যাই যেন! আমাদের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা নেই, ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই। কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলে তাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে মারতে উদ্যত হয় আততায়ীর হাত। ফরাসি ঐতিহাসিক ও দার্শনিক ভলতেয়ারকে (১৬৯৪-১৭৭৮) উদ্ধৃত করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে বক্তৃতা করেন দেশ-বিদেশের গুণীজনেরা; কিন্তু ভলতেয়ারের মৃত্যুর প্রায় আড়াইশো বছর পরেও নিজের জীবনে সেই আদর্শ কতজন যে মেনে চলেন, সে সত্য আমরা আমাদের দৈনন্দিন ইতিহাস থেকেই জানি।
আমরা ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ পেরিয়ে এসেছি বলে দাবি করি, কিন্তু শিল্পকলা-সঙ্গীত-নববর্ষ নিয়ে কুসংস্কার আর ভ্রান্ত ধারণা থেকে আজ অবধি বেরিয়ে আসতে পারিনি। যে যুগে মানুষ গ্রহ-নক্ষত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, অন্য গ্রহে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করছে, সেই যুগেই কিছু মানুষ এখনো বিশ্বাস করে, চাঁদে ‘বিশেষ একজনের’ মুখচ্ছবি অলৌকিকভাবে দৃশ্যমান হওয়া সম্ভব; এখনো কিছু মানুষ ধর্মের অজুহাতে নির্বিচার মানুষ হত্যাকে ‘ধর্মযুদ্ধ’ মনে করে। যে যুগে প্রাথমিক শ্রেণিতে পড়ুয়া শিশুরা ঘরে বসে সফটওয়্যার বানাচ্ছে, সেই যুগে আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত মানুষও ‘আকাশ থেকে করোনার ওষুধ ঝরে পড়ছে’–এমন গুজব বিশ্বাস করে তা কুড়োতে ছুটে যায়। এই যুগেও কিছু মানুষ বিশ্বাস করে, ‘স্বপ্নে’ সর্বরোগের ওষুধ পাওয়া যায়।
এখনো কিছু মানুষ নারীর ওপর পুরুষের অন্যায়-নিপীড়ন-কর্তৃত্বকে স্রষ্টাপ্রদত্ত শ্রেষ্ঠত্বের অধিকার বলে মনে করে। আমাদের দেশে এখনো অনেক শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত; তুচ্ছ অপরাধের অভিযোগে অবোধ শিশুকে লাঠিপেটা করে হত্যা করতে দ্বিধা করে না এই সভ্য সময়ের পরিণত বয়সীরা। গৃহকর্মীকে নির্যাতন করেন নারী অধিকার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী এমনকি পুলিশ; গৃহকর্তার কাছে যৌননির্যাতনের শিকার হন অনেক গৃহকর্মী। ধর্ষণ থেকে রেহাই পায় না দুই মাসের নবজাত থেকে শুরু করে অশীতিপর কিংবা শতবর্ষী নারী। জ্ঞান-বিজ্ঞানে আর সভ্যতায় পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দেশটিতেও এখনো রয়ে গেছে নারী-পুরুষ বৈষম্য; রয়ে গেছে জাতি-বর্ণভেদ। তথাকথিত উন্নত এসব দেশে নারী নির্যাতনও ঘটছে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর মতোই।
আজ এই দুর্যোগের মধ্যেও আমরা দেখছি, লোকে ঘরে বউ পেটাচ্ছে। ফেসবুক লাইভে এসে বউকে কুপিয়ে হত্যা করছে। মামার চড়-থাপ্পড়ে জীবন গেছে এক শিশুর। গ্রামবাসীর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে স্ত্রী-বাবা-মাকে জঙ্গলে ফেলে আসছে কিছু মানুষ। বাড়িভাড়া দিতে না পারায় এই দুর্যোগের মধ্যেও ভাড়াটিয়া পরিবারকে শিশুসন্তানসহ বাড়িছাড়া করছেন বাড়িওয়ালা।
করোনাবিষয়ক যে হেল্পলাইন সরকার চালু করেছে, প্রয়োজনের তুলনায় সেখানে জনবল এখনো পর্যাপ্ত নয়। ফলে সেখানে দরকারি সাহায্যের জন্যে ফোন করে প্রথমবারেই সংযোগ পাওয়া যায় না বলে অনেকে জানিয়েছেন। সরকারও চেষ্টা করছে এই সেবার আওতা বাড়াতে। কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যেও সেসব নম্বরে কিছু ব্যক্তি ফোন করছেন কেবল ফোন ধরেন যে নারীরা, তাদের সাথে নিছক ‘ফাজলামো’ করে বিকৃত বিনোদন পেতে। এই দুর্যোগের মধ্যেও চলছে শিশুসহ নানা বয়সীদের ওপর ধর্ষণ ও হত্যার মতো নির্যাতনের ঘটনা। দরিদ্রদের জন্যে সরকারের দেওয়া ত্রাণসামগ্রী লুট করছেন জনপ্রতিনিধিরা; অথচ গরিবের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন রিকশাচালক এমনকি ভিক্ষুক! করোনাকালে সেবাদানকারীদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তার জন্যে দরকারি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর (পিপিই) একদিকে অভাব; অন্যদিকে ব্যবহারের পর বাতিল হয়ে যাওয়া পিপিই সংগ্রহ করে পুনরায় ব্যবহারের একেবারেই অযোগ্য সেসব পিপিই আবারো বিক্রি করছে কিছু ব্যবসায়ী।
সত্যি সেলুকাস; কী বিচিত্র এই দেশ, কী বিচিত্র এই পৃথিবী!
অনেক বিষয়ে আগের চেয়ে অগ্রগতি নিশ্চয়ই আমাদের কিছু হয়েছে; তবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কল্যাণে গুটিকয় মানুষের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য নির্মাণ করাই মানবজাতির চূড়ান্ত উৎকর্ষ নয়। এখনো চারপাশে এই যে এত বিকৃতি-অনাচার-অবিচার-নির্মমতা, এতকিছুর পরও মানবজাতি উন্নতির উৎকর্ষে অবস্থান করছে—এমন গর্ব নিতান্তই মিথ্যা দম্ভোক্তি।
জ্ঞান-বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিতে অগ্রসর হলেই নিজেকে অগ্রসর বলে দাবি করা যায় না। মানুষের যে প্রবৃত্তিগুলোকে ‘আদিম ও বর্বর’ বলে আখ্যা দিয়ে হাজার বছর আগেকার মানুষদের অসভ্য ও বর্বর বলে গাল দেওয়া হয়, সেই প্রবৃত্তিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আনাই প্রাগ্রসরতা। কাম-ক্রোধ-লোভ-অপরাধপ্রবণতা-স্বার্থান্ধতার মতো প্রবৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তবেই আমাদের নিজেদের আধুনিক ও অগ্রসর মানুষ বলে দাবি করা সাজে। গত কয়েক হাজার বছরে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে; পরিবর্তন এসেছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়। পারিপার্শ্বিক ও প্রাযুক্তিক জ্ঞান বেড়েছে; কিছু ক্ষেত্রে প্রায়োগিক জ্ঞানও বেড়েছে। চিকিৎসার প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে। বিজ্ঞানের কল্যাণে জীবনধারণে আরাম বেড়েছে। কিন্তু আমাদের মন-মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন কতোটা ঘটেছে?
মানুষের ওপর মানুষের আস্থা নেই। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ নেই। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থে অন্যের সম্পদ এমনকি প্রাণ কেড়ে নিতেও মানুষ পিছপা হয় না। পরিবারগুলোর মধ্যে বেড়ে চলেছে অবিশ্বাস ও মানসিক বিচ্ছিন্নতার বোধ। বাবা-মায়ের সাথে দূরত্ব বাড়ছে সন্তানের। মনুষ্যত্বের চেয়ে আজ অর্থ-সম্পদ-অন্যায় ক্ষমতার কদর বেশি। যে প্রকৃতির মধ্যে আমাদের বসবাস, সেই প্রকৃতির প্রতিই আমাদের ভালোবাসা নেই, কৃতজ্ঞতাবোধটুকু নেই; সর্বনাশ হবে জেনেও মানুষ নির্বিচারে উজাড় করে যাচ্ছে গাছপালা, করছে জলাশয় দখল ও ভরাট, বাড়িয়ে চলেছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। এরই মধ্যে এসবের কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগ মানুষ পোহাতে শুরু করেছে; তবু কিছুতেই আমরা তা আমলে নিতে রাজি নই! এমনতরো নির্বোধ এক মানবজাতির নিজেকে নিয়ে অন্ধভাবে এত বড়াই করার কী থাকতে পারে?
ভালো অনেক কিছুই আমাদের রয়েছে, তবে আমাদের দুর্বল দিকগুলোকে অস্বীকার করা চলে না; সত্যিকার অর্থে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হলে নিজেদের ত্রুটিগুলোকে আমলে নেওয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে, ‘অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না’। অর্থাৎ, নিজেকে নির্বিচারভাবে শ্রেষ্ঠ দাবি করলেই শ্রেষ্ঠ হওয়া যায় না, যত্ন ও চর্চার মাধ্যমে শেষ্ঠ হয়ে উঠতে হয়।
করোনার অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট বোঝা গেল, আমরা এখনো একটি সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম নই। এমন দুর্যোগে সৎ ও আন্তরিক সেবা নিশ্চিত করতে প্রস্তুত নই। যেখানে লোকে না খেয়ে মরছে, সেখানেও আমরা নিজের অন্যায় লোভ সম্বরণ করতে আগ্রহী নই। এই দুর্যোগেও আমরা সরকারি দল-বিরোধী দল দ্ব›দ্ব ছেড়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত নই। দেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে ও বাইরে রাজনৈতিক দাপটের চিন্তা ছেড়ে বেরিয়ে এসে সীমানার তোয়াক্কা না করে বিশ্বমানবের কল্যাণে ভাবতে আমরা রাজি নই।
এই দুর্যোগকাল আরও দীর্ঘায়িত হলে এ কারণে সৃষ্ট বেকারত্ব সামলানোর সক্ষমতা কি আমাদের মতো রাষ্ট্রের রয়েছে? রাষ্ট্র একা কতদিন আর কতগুলো মানুষের অন্নসংস্থান করতে সক্ষম? আমাদের রাষ্ট্রের যে এ বিষয়ে যথেষ্ট সদিচ্ছা ও চেষ্টা রয়েছে, তাতে সন্দেহের সুযোগ নেই; কিন্তু সদিচ্ছার পাশাপাশি সক্ষমতাও তো দরকার। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো কেন, অনেক আগে থেকে উন্নত হওয়া দেশগুলোও এমন দুর্যোগ দীর্ঘদিন সামলাতে সক্ষম নয়।
সৃষ্টির পর থেকে পৃথিবীতে নানা ধরনের দুর্যোগ ঘটে এসেছে; কিন্তু আজকের পৃথিবী কি সেগুলো থেকে শিক্ষা নিয়েছে? অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে চলমান এ দুর্যোগের জন্যে এ বিশ্ব কি প্রস্তুত ছিল? হাজারো যুদ্ধ ও যুদ্ধের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতির ইতিহাস আমরা জানি; অথচ এই যুদ্ধই এখনো অনেক দেশের সবচেয়ে বড় ও লাভজনক ‘ব্যবসা’!
উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি এখন আমাদের আছে, তবে এসবের সুবিধা ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সবার জন্যে নিশ্চিত করা যায়নি; বিশেষ একটি শ্রেণির হাতেই এখনো এর নিয়ন্ত্রণ রয়ে গেছে। সমাজে নারীর অধিকার নেই, ব্যক্তির ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। অর্থসম্পদ না থাকলে শিক্ষা এমনকি জীবন রক্ষাকারী প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু পাওয়ার সুযোগ নেই। ভূগর্ভস্থ সম্পদ আহরণ ও নতুন সম্পদ উৎপাদনের সক্ষমতা আমাদের হয়েছে, তবে বৈষম্য না করে বিশ্বমানবের কল্যাণে এসবের আন্তরিক ব্যবহার নিশ্চিত করার মতো মানসিকতা আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি।
জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মতো কিছু ক্ষেত্রে আমরা দৃশ্যমান উন্নতি অর্জন করেছি বটে, তবে মানুষ হিসেবে আমাদের কুপ্রবৃত্তিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ এসেছে—এমনটি দাবি করার মতো অর্জন আমাদের খুব বেশি নেই। একটি বন্য পশুও ক্ষুধা না পেলে অন্য প্রাণিকে হত্যা করে না; অথচ মানুষদের মধ্যে যারা সীমাহীন সম্পদের অধিকারী, তারা অভুক্তেরও মুখের খাবার কেড়ে নিতে দ্বিধা করছে না। বিশ্বের সর্বোচ্চ উন্নত ও জ্ঞান-গরিমায় এগিয়ে থাকা তথা সভ্য বলে স্বীকৃত দেশগুলো নিজেদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় আফ্রিকাসহ পৃথিবীর নানা অঞ্চলকে দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ আর যুদ্ধের কষাঘাতে জর্জরিত করে রেখেছে; এর ফলে দিনের পর দিন ধুঁকে মরছে হাজারো, লাখো মানুষ এমনকি নিষ্পাপ শিশু। তাই আগেরদিনের মানুষদের অসভ্য-বর্বর বলে ছোট করা আর বর্তমান সময়ের এই তথাকথিত আধুনিক মানুষদের নিয়ে আত্মম্ভরিতার আসলে কোনো ভিত্তি নেই।
আমাদের অর্জন নিয়ে তাহলে নতুন করে ভাবার দরকার রয়েছে। আমাদের মধ্যে এই উপলব্ধি ঘটা দরকার, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যোগ করার মধ্যে সীমিত অর্থে ‘আধুনিকতা’ থাকতে পারে, তাতে সত্যিকার অর্থে অগ্রসর হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। সময়ের সাথে সাথে অভিজ্ঞতাসঞ্জাত জ্ঞান, উপলব্ধ বোধ ও অর্জিত দক্ষতাকে প্রায়োগিক করে তুলতে হয়; অর্জিত জ্ঞান বা দক্ষতাকে কোনো ধরনের সীমা বা বৈষম্য ছাড়া যত বেশি মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা যাবে এবং যত বেশি উদার ও বেশি মানুষের জন্যে কল্যাণকামী হয়ে ওঠা যাবে, নিজেকে ততো বেশি প্রাগ্রসর দাবি করা যাবে। প্রাণিকূলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দাবির জন্যে কেবল প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানোই যথেষ্ট নয়; মন-মানসিকতা ও চিন্তা-ভাবনারও উন্নয়ন ঘটানো জরুরি।
কেবল নৃতত্ত্বের বা জীববিদ্যার বিচারে ‘মানুষ প্রজাতিভুক্ত’ হলেই সত্যিকার মানুষ হওয়া যায় না; মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারলে তবেই আদর্শিক বিচারে মানুষ হওয়া যায়। মানুষের মন ও মননের প্রকৃত বিকাশ ঘটুক; সবার মধ্যে সুকুমারবৃত্তি জাগ্রত হোক। প্রতিটি মানুষ হোক পরস্পরের হিতৈষী ও বিশ্বমানবের কল্যাণাকাক্ষী; মানুষ হয়ে উঠুক সত্যিকার অর্থেই মানুষ।
এমন মানবজাতিই শ্রেষ্ঠত্বের গৌরবের প্রকৃত অধিকারী।
[লেখাটি দৈনিক আমাদের সময়-এ ৩ মে ২০২০ প্রকাশিত হয়।]