Media School

Dhaka    Wednesday, 04 December 2024

By নুসরাত জাহান

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব

Media School February 9, 2021

আন্তর্জাতিক অনেক উদ্যোগের পরও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের সমাধান হয়নি। ছবি : sbs.com.au

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে বিদ্যমান সংঘাত দেশদুটির মধ্যে সংঘটিত একটি চলমান সমস্যা, যার শুরু বিশ শতকের মাঝামাঝিতে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত এ সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে শান্তি প্রক্রিয়ার নানা উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত দেশদুটি চূড়ান্ত সমাধান পায়নি।

ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডে ইহুদি পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে শুরু হয় এ সমস্যা। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায় ইহুদিরা নিজেদের আবাসস্থল বানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এ সঙ্কট ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চলমান রয়েছে। সমস্যার মূল কারণ মূলত দেশদুটির একে অপরকে স্বীকৃতি দিতে ক্রমাগত অস্বীকৃতি, নিরাপত্তার ঘাটতি, সীমান্ত সমস্যা, পানির অধিকার সংক্রান্ত সমস্যা এবং সর্বোপরি জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ, ইসরায়েলিদের বসতি স্থাপন, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার অধিকারের প্রশ্ন।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত স্বাধীন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তথা 'দুই-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানের' অনেক উদ্যোগই নেওয়া হয়, যার কোনোটিই এ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। অবশ্য এটিই দীর্ঘদিনের চলমান এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র ও কার্যকর উদ্যোগ বলে ২০০৭ সালে সংঘটিত এক জরিপে অধিকাংশ ইহুদি ও আরব নাগরিক তাদের মতামতে জানায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত এর কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়নি বরং এ বিষয়কে কেন্দ্র করে এ জাতিদুটির মধ্যে এ পর্যন্ত ছোট-বড় হাজারো সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে যেখানে উভয় দেশেরই সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে আধা-সামরিক বাহিনী, জঙ্গিদল এমনকি একক ব্যক্তি জড়িত থাকার ঘটনাও ঘটেছে এবং ঘটছে। ফলে মৃত্যৃর ঘটনাও শুধু সেনাসদস্য নয় বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি আন্তর্জাতিক অনেক জোটও এখন এ সংঘাতে জড়িত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ইহুদি নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে সে সময় ইউরোপ থেকে পালিয়ে ফিলিস্তিনে এসে বসতি গড়ে ইহুদিরা। ১৮৯৬ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত হলোকাস্টের সময় হাজার হাজার ইহুদি তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ফিলিস্তিনে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়। সে সময় এটি ছিলো প্রথমে অটোমান ও পরে ব্রিটিশ শাসনাধীন আরব-মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। কিন্তু ইউরোপে ইহুদি-বিদ্বেষ বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে একসময় সেখানকার ইহুদিরা নিজস্ব ভূখণ্ডের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করে। এক্ষেত্রে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমিকেই নিজস্ব দেশ গঠনের আদর্শ জায়গা বলে অনুভব করে। সে সময় ইহুদিদের প্রায় ৯০ শতাংশই জায়োনিজমের (ইহুদি জাতির এক ধরনের মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যা মূলত ইসরায়েলে তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের ধারণাকে সমর্থন করে) ধারায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে আলাদা দেশ ও জাতি গঠনের প্রতি তাদের আগ্রহ প্রকাশ করে।

এ সময় উভয় জাতিকেই এ ভূমির সমান ভাগিদার করতে জাতিসংঘ উদ্যোগ নিলেও তা ভেস্তে যায় এবং এ নিয়ে হুইদিদের সাথে এ অঞ্চলকে ঘিরে থাকা আরব দেশগুলোর সাথে শুরু হয় একের পর এক যুদ্ধ। ফিলিস্তিনের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয় প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্র মিসর, জর্ডান, ইরাক এবং সিরিয়া।

এর মধ্যে ১৯৪৮ সালে সংঘটিত আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর এ পবিত্র ভূমিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় : ইসরায়েল রাষ্ট্র, (জর্ডান নদীর) পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা।  পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয় যখন ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বসবাসকৃত দুটি অঞ্চল গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীর নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলের সিনাই পেনিনসুলা ও গোলান হাইটসে বসতি স্থাপনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মিসর ও সিরিয়া ইসরায়েলের ওপর অতর্কিতে হামলা করে যা 'ইয়ম কিপ্পুর যুদ্ধ' নামে পরিচিত।

পরে ১৯৭৯ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘটিত শান্তিচুক্তি এ যুদ্ধের অবসান ঘটায়। তবে ভূমি নিয়ে সংঘটিত এ যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ফিলিস্তিনিরা নিজেদের স্বাধীন ভূখণ্ডের দাবিতে আন্দোলন ও বিক্ষোভ শুরু করে যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৭ সালে পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার কয়েক হাজার ফিলিস্তিনির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় প্রথম ইন্তিফাদা (আরবি ইন্তিফাদা শব্দের অর্থ 'যুদ্ধ')।

১৯৯৩ সালে ইসরায়েলি সরকার ও প্যালেস্টিনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। অসলো চুক্তি নামে পরিচিত এ চুক্তির মধ্য দিয়ে পশ্চিম তীরের কিছু অংশ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের অধীনে আসে। একইসঙ্গে এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনের জন্য আলাদা একটি শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয় যার মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ নিজেদের অঞ্চল পরিচালনা করাসহ ইসরায়েলের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপন করবে বলে বলা হয়।

কিন্তু এরপরও দুপক্ষের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি না হয়ে বরং অবনতি হয় যার ফলে ২০০০ সালে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় ইন্তিফাদা, যা ছিলো প্রথমটির চেয়ে আরও বেশি রক্তক্ষয়ী। কিন্তু যুদ্ধে ইহুদিদের  কাছে পরাজিত হয়ে ৭ লাখ ফিলিস্তিনি নাগরিক উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। এ সময় জাতিসংঘ ইহুদিদের ব্রিটিশ অধ্যুষিত ফিলিস্তিনের ৫৬ শতাংশ ভূমি দেওয়ার প্রস্তাব করলেও যুদ্ধ শেষে ইসরায়েলিরা পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা ও জর্ডান নিয়ন্ত্রিত জেরুজালেমের পূর্বাংশ ব্যতিত বাকি ৭৭ শতাংশই দাবি করে। আর এভাবেই জন্ম হয় বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের। আর 'নিজ গৃহে পরবাসী'তে পরিণত হয় ফিলিস্তিনি আরবেরা।

এরপরও ফিলিস্তিন পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা নিজেদের বলে দাবি করলেও ইসরায়েল ক্রমাগতভাবে এখানে তাদের বসতি বাড়িয়ে চলেছে। বর্তমানে পশ্চিম তীরের কিছু অংশ ফিলিস্তিনের দখলে থাকলেও এখানে রয়েছে ১৬০-এরও বেশি ইসরায়েলি বসতি। কিন্তু ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের পপুলেশন রেজিস্ট্রি অনুযায়ী বর্তমানে গাজা উপত্যকায় অন্তত ২০ লাখ এবং পশ্চিম তীরে ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি বসবাস করছে। তবে তাদের এ হিসাব বরাবরই অস্বীকার করে আসছে ইসরায়েল। উল্টো এ এলাকার ফিলিস্তিনি বিদ্রোহী ও আন্দোলনকারীরা রয়েছে ইসরায়েলের কড়া নিরাপত্তাবলয়ের অধীনে।

অন্যদিকে ১৯৬৭ সালের পর থেকে ফিলিস্তিনি ঘনবসতিপূর্ণ গাজা উপত্যকা ইসরায়েলের অধীনে থাকলেও ২০০৫ সালে এসে ইসরায়েল এখান থেকে তাদের শাসন তুলে নেয়। পরে ২০০৭ সালে এ অঞ্চল ফিলিস্তিনের বিরোধী সেনাদল হামাস দখলে নেয়। যদিও ইসরায়েল এ এলাকা অবরুদ্ধ করে রেখেছে এবং এখানে তাদের সরাসরি সেনা মোতায়েন নেই, তারপরও প্রায়ই ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা দলের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে হামাস।

কিন্তু এ দুই এলাকা ছাড়া পূর্ব জেরুজালেমেও ইসরায়েলিদের বসবাস বেড়ে চলেছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ইসরায়েলি সীমানা ছাড়াও ৬৬ লাখ ইহুদির ১১ শতাংশ বসবাস করছে দখলকৃত এ অঞ্চলে। অন্যদিকে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ই জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী হিসেবে দাবি করে আসছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বরাবরই উভয় পক্ষের এ দাবি নাকচ করে এসেছে। কারণ তাদের মতে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়েই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।

জাতিদুটির মধ্যে চলমান এ বিরোধের এখন পর্যন্ত  তথাকথিত সমাধান মনে করা হচ্ছে 'দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান', যার মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরের অধিকাংশ নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও বাকি এলাকা নিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে। কাগজে-কলমে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক এ সমাধান বিষয়ে খুব স্পষ্টভাবে সব বিষয় উল্লেখ থাকলেও দুঃখজনকভাবে উভয় পক্ষ এর যথাযথ বাস্তবায়ন নিয়ে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো সমাধানে আসতে পারেনি। এর বিপরীতে আরেকটি সমাধানের কথা বলা হয় : একরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান। অর্থাৎ ইসরায়েল অথবা ফিলিস্তিনের হাতে পুরো ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ দিয়ে দেওয়া। কিন্তু এটি দীর্ঘদিন ধরে চলমান এ সমস্যা না কমিয়ে বরং আরও বাড়িয়ে দেবে বলেই অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতামত। অবশ্য নানা ধরনের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় ধীরে ধীরে এ ধারণাই ক্রমে জনপ্রিয় হচ্ছে।

মূলত ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থনই এ অঞ্চলে কার্যকর কোনো সমাধান নিয়ে আসছে না বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত। অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক সহকারী অধ্যাপক মাহা নাসের এ বিষয়ে বলেন, 'ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী একটি মিত্র দেশের ক্রমাগত সমর্থনই ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সময় ধরে অধিকার বঞ্চিত করে রেখেছে। তারা নানাভাবে এটি করে যাচ্ছে যার ফলে ফিলিস্তিনিরা এখন নিজ দেশে পরাধীন। তাদের নিজেদের সীমানা, জল-স্থল, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এমনকি নিজ জনগণের ওপরও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের কখনোই একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।'

অর্থাৎ, যতদিন পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদার অধিকার দেওয়া না হবে, ততদিন পর্যন্ত এ অবস্থার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব নয় বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

তথ্যসূত্র :

https://en.wikipedia.org/wiki/Israeli%E2%80%93Palestinian_conflict
https://www.cfr.org/global-conflict-tracker/conflict/israeli-palestinian-conflict
https://www.vox.com/2018/11/20/18079996/israel-palestine-conflict-guide-explainer
https://theprint.in/theprint-essential/what-israel-palestine-conflict-is-all-about-and-why-both-want-west-bank-gaza-strip/323825/
https://www.sbs.com.au/news/the-israeli-palestinian-conflict-explained_2

নুসরাত জাহান : লেখক ও গবেষক।