By রাজীব সরকার
আহমদ শরীফের ইহজাগতিকতা
Media School September 10, 2021
আহমদ শরীফ ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ এবং মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গবেষক।
শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত ত্রৈমাসিক ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘আমার জীবনদর্শন’ প্রবন্ধে আহমদ শরীফ লিখেছিলেন:
‘সহনশীলতা হচ্ছে সংস্কৃতির একটি মৌল শর্ত। আমি যা জানি, যা বুঝি, যা ভাবি, তা সাধারণে জানে না, বোঝে না, ভাবে না, আমার জ্ঞান-বুদ্ধি-রুচি-বিচার-বিবেক অন্যদের চেয়ে উন্নত—এমনকি এক উত্তম্মন্যতা এবং অপরকে অযাচিত উপদেশ বা পরামর্শ দেওয়ার ধৃষ্টতা যে অপরিশীলিত বর্বর রুচি-বুদ্ধিরই পরিচায়ক, তা তথাকথিত শিক্ষিত সংস্কৃতিমানেরাও উপলব্ধি করেন না। যেকোনো মানুষের যেকোনো বিষয়ে স্বমত ও মন্তব্য প্রকাশের এবং অন্যের বিবেচনার জন্য নিবেদন করার অধিকার নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সর্বোৎকৃষ্ট মত-মন্তব্য বলে আস্ফালন বা দাবি করা যে অন্যের জ্ঞান-বুদ্ধি-রুচি-বিবেককে তাচ্ছিল্য কিংবা অস্বীকার করার ঔদ্ধত্যের নামান্তর, তা বোঝার মতো সংস্কৃতিমান মানুষ কোটিতেও গুটিক মেলে না।’
আহমদ শরীফের আট দশকব্যাপী জীবন ও কর্মসাধনার অন্তঃসার বিবৃত হয়ে আছে উপরিউক্ত বক্তব্যে। বক্তব্য প্রকাশে তিনি ছিলেন অনমনীয় ও নির্ভীক। শিক্ষক, গবেষক, প্রাবন্ধিক, বাগ্মী, সমাজ রূপান্তরকামী বুদ্ধিজীবী—বহুমাত্রিক পরিচয়ে বিভূষিত আহমদ শরীফ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি চিন্তাবিদ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সহনশীলতা—এ দুইয়েরই অবিচল অনুশীলন করেছেন তিনি আজীবন। তাঁর স্পষ্টভাষী বক্তব্যের কারণে উগ্রবাদীরা ‘মুরতাদ’ আখ্যা দিয়ে তাঁর ফাঁসি দাবি করেছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণে তিনি নিজের বাসায় স্বেচ্ছাবন্দী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীন মত প্রকাশ করা থেকে কখনো বিরত থাকেননি।
গবেষক আহমদ শরীফের প্রেরণার উৎস ছিলেন তাঁর পিতৃব্য আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। মধ্যযুগের সাহিত্যের এমন সব উপকরণ আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বিস্মৃতি ও বিলুপ্তির অন্ধকার থেকে উদ্ধার করেছিলেন, যেগুলো আবিষ্কৃত না হলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যেত। তাঁর আবিষ্কৃত উপকরণসমূহ আহমদ শরীফ অনন্যনৈপুণ্যের সঙ্গে সম্পাদনা ও মূল্যায়নের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে যুক্ত করেছেন। মধ্যযুগের সাহিত্যের প্রতি তাঁর অসাধারণ নিষ্ঠা দেখে তৎকালীন ছাত্র আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখেছিলেন, ‘অন্ধকার ঘরে বসে আহমদ শরীফ সমগ্র মধ্যযুগ করেছেন জরিপ।’ শুধু মধ্যযুগের নয়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও আহমদ শরীফ কুশলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের অবদানকে একসময় উপেক্ষা ও অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এর প্রতিক্রিয়ায় সম্পূর্ণ বিপরীত প্রবণতার জন্ম হয়। পাকিস্তানি শাসনামলে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মুসলমানিকরণের মাধ্যমে ইতিহাসকে খণ্ডিত ও বিকৃত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। যুক্তিমনস্ক আহমদ শরীফ সেই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অসাম্প্রদায়িক ইতিহাস রচনার পথ তিনি সুগম করেছিলেন। বাংলা পুঁথি সম্পাদনা ও বিশ্লেষণ তাঁর অসামান্য কীর্তি।
অগাধ পাণ্ডিত্য ও মানস্তাত্ত্বিকতার অধিকারী আহমদ শরীফ মূলত দুটি পরিসরে জ্ঞানচর্চা করেছেন। প্রথমটি মধ্যযুগের সাহিত্যগবেষণা, দ্বিতীয়টি আধুনিক সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আর্থসামাজিক ভাবনা। একসময় তিনি মূল্যায়ন করেছেন দৌলত উজির বাহরাম খান, আলাওল, কাজী দৌলত, সৈয়দ সুলতান প্রমুখের। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ‘লাইলী-মজনু’ (১৯৫৭) তিনি সম্পাদনা করেছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। তবে এই বৃত্তে নিজেকে কখনো আটকে রাখেননি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করেছেন আধুনিক কালের সমাজ-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। তিনি বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন আধুনিক কালের সমাজ-সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রূপকারদের—বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তসহ অনেকের। ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও বাংলার নবজাগরণকে ব্যাখ্যা করেছেন সমাজবিশ্লেষকের দৃষ্টিতে।
তাঁর মননচর্চার কেন্দ্রে ছিল বাংলা, বাঙালি ও বাঙালিত্ব। বক্তব্যের ঋজুতার কারণে কখনো কখনো তাঁর মূল্যায়ন বিতর্কের ঝড় তুলেছে। প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্বকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি এবং প্রগতির পক্ষে নিজের বলিষ্ঠ অবস্থান তুলে ধরেছেন। ঐতিহ আর সম্পদ—এ দুইয়ের পার্থককে আহমদ শরীফ খুব বড় করে দেখেছেন। এ কারণে পেছনে ঠেলে দেয়, ঐতিহকে অস্বীকার না করলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না—এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। মধযুগের সাহিত ও লোকসাহিত্যকে তিনি সম্পদ বলে মানেননি, ঐতিহের স্বীকৃতি দিয়েছেন। এমনকি রবীন্দ্রসাহিত্যকেও তিনি আমাদের ঐতিহ্য বলে মনে করতেন, সম্পদ নয়। আশির দশকে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ত্রৈমাসিক ‘উত্তরাধিকার’ পত্রিকায় ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র-মূল্যায়ন’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে দেশব্যাপী বিতর্ক ও সমালোচনার সূত্রপাত করেন।
চলতি হাওয়ার পন্থী ছিলেন না আহমদ শরীফ। তাঁর প্রবণতা ছিল স্রোতের বিপরীতে চলার। দ্রোহ ও ব্যক্তিত্ববাদ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি। উদার মানবতাবাদী ও মার্ক্সবাদের যৌথ প্রভাবে গঠিত হয়েছিল তাঁর চিন্তক সত্তা। বিভিন্ন প্রগতিশীল উদ্যোগ ও আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত ছিল। কিন্তু কোনো দল বা সংগঠনের মুখাপেক্ষী হয়ে তিনি কখনো কথা বলেননি। বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে অবলীলায় নিজের আদর্শ ও বিশ্বাসের কথা প্রচার করেছেন। এর ফলে বিচ্ছিন্নতার বেদনাভার তাঁকে বহন করতে হয়েছে। নিজের বাড়িতে একটি শুক্রবাসরীর সভা তিনি চালিয়ে গেছেন। সন্ধ্যাবেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে বেছে নিয়েছিলেন গণসংযোগের স্থান হিসেবে।
গত শতাব্দীর বিশের দশকে ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের উদ্যোক্তারা ‘শিখা’ নামে একটি মুখপত্র প্রকাশ করতেন। এর নামপত্রে লেখা থাকত তাঁদের মূলমন্ত্র: ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান সমাজে বৌদ্ধিক জাগরণ ঘটেছিল। এই আন্দোলনের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন আহমদ শরীফ। তিনি একান্তভাবে ইহজাগতিকতার অনুসারী ছিলেন। ‘মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর’—এই নীতিতে ছিল তাঁর অবিচল আস্থা। সারা জীবন তিনি সত্য ও ন্যায়ের পথে চলেছেন। কখনো অন্যায় করেননি।
ইহজাগতিকতা ছাড়া অন্য কোনো পারলৌকিক ভাবনা তাঁর ছিল না। মানবমুখিন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি এই আচরণ করেছিলেন। অলৌকিকতার বিপক্ষে ও ইহজাগতিকতার পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান তাঁর চরিত্রকে বিশিষ্টতা দান করেছিল।
আহমদ শরীফের যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয়েছিল ইহজাগতিক জীবনদর্শনকে কেন্দ্র করে। যে জগৎ ইন্দ্রিয়গোচর ও যুক্তিগ্রাহ্য সেই জগৎকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই ইহজাগতিকতা। এই দৃষ্টিভঙ্গি অজিত হয়েছিল ইতালীয় রেনেসাঁসের আবির্ভাবের কারণে। সভতার অগ্রযাত্রায় ইতিহাসের একটি বিশেষ স্তরে পৌঁছে নতুন যুগের আদর্শ হিসেবে রেনেসাঁসের উদ্ভব ঘটে, যা অলৌকিক ও দৈবনির্ভরতা থেকে মানুষকে মুক্ত করে। এই আদর্শকে আহমদ শরীফ সবলে ধারণ করেছিলেন, প্রচলিত অনাচার ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে দ্রোহের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে সচেষ্ট ছিলেন।
‘ধর্মমোহ’ নামক অবিস্মরণীয় কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
‘নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো।’
আহমদ শরীফ শাস্ত্র মানতেন না, তবে মানুষের ভালো যে তিনি মানতেন, এর প্রমাণ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দিয়ে গেছেন।
*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক প্রথম আলোর অন্য আলো-তে, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।