By রাজীব সরকার
আত্মকথার দর্পণে বুদ্ধদেব বসু
Media School March 21, 2023
সাহিত্যের প্রত্যেক শাখায় অসাধারণ অবদান রাখলেও বুদ্ধদেব বসুর জীবন সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত ছিল কবিতায়।
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সব্যসাচী প্রতিভা বুদ্ধদেব বসু। বিভিন্ন গল্পে, উপন্যাসে, কবিতায় ও প্রবন্ধে বিক্ষিপ্তভাবে নিজের জীবনকাহিনি শুনিয়েছেন তিনি। তবে সুনির্দিষ্টভাবে তিনটি রচনায় তাঁর আত্মকথা পাওয়া যায় – ‘আমার ছেলেবেলা’, ‘আমার যৌবন’ ও ‘আমাদের কবিতাভবন’। যদিও শেষোক্ত রচনাটি তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে অসমাপ্ত, এরপরও ধারাবাহিকভাবে এই রচনা তিনটি পাঠে এক অসামান্য আত্মজীবনীমূলক সাহিত্যকর্মের স্বাদ অনুভব করা যায়। ‘কবিতা ও আমার জীবন’ প্রবন্ধটিকেও নিজের আত্মজীবনীর ভগ্নাংশ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
গতানুগতিক আত্মজীবনীর মতো কোনো গৌরচন্দ্রিকা বা দার্শনিক পটভূমি নেই বুদ্ধদেবের আত্মকথায়। খুব স্বল্পসংখ্যক আত্মকথার প্রথম বাক্যে নিজের জন্মস্থান ও জন্মসালের উল্লেখ পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, অত্যন্ত নির্মোহভাবে তিনি পিতৃমাতৃহীন অবস্থার কথা জানান। এই অভাব তাঁকে যেন কখনো স্পর্শ করেনি – আমি জন্মেছিলাম কুমিল্লায়, আমার দাদামশায়ের তৎকালীন কর্মস্থলে, বঙ্গাব্দ ১৩১৫, ১৫ অগ্রহায়ণ, খ্রিষ্টাব্দ ১৯০৮, ৩০ নভেম্বর তারিখে। পিতার নাম ভূদেবচন্দ্র বসু, মাতা বিনয়কুমারী – কন্যাবস্থায় তাঁর পদবি ছিল সিংহ। ‘বিনয়কুমারী’ নামটি আমি কারো মুখে উচ্চারিত হতে শুনিনি, ‘মুকুল’ পত্রিকার একটি পুরনো খণ্ডে কাঁচা হস্তাক্ষরে লেখা দেখেছিলাম – কেমন করে সেটিকে আমার মায়ের নাম বলে শনাক্ত করেছিলাম তা আমার মনে নেই। আমি বিনয়কুমারীর প্রথম ও শেষ সন্তান – আমার জন্মের পরে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই প্রসবোত্তর ধনুষ্টঙ্কার রোগে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুই আমার নামকরণের কারণ।
জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মাতৃবিয়োগ এবং সে-কারণে পিতার বৈরাগ্য এক অনিশ্চিত ও অস্বাভাবিক শৈশবের মুখোমুখি করে বুদ্ধদেবকে। মাতামহ ও মাতামহীর গৃহে তিনি সন্তানরূপে লালিত হন। তাঁদেরকেই তিনি পিতামাতা হিসেবে জানতেন। প্রৌঢ় বয়সে মায়ের কথা খুব মনে পড়ে তাঁর। মায়ের একমাত্র ছবি হারিয়ে ফেলা প্রসঙ্গে লিখেছেন – আমার কৌতূহল মেটাবার জন্য কেউ যখন বেঁচে নেই, তখনই আমার জানতে ইচ্ছে করছে সে কেমন ছিলো – আমার নাৎনির বয়সী না-দেখা ঐ মেয়েটি; কেমন ছিলো সে দেখতে, কেমন পছন্দ-অপছন্দ ছিলো তার, বই পড়তে ভালোবাসতো কিনা, আমার মধ্যে তার কোনো-একটি অংশ কি কাজ করে যাচ্ছে? মনে হয়, আমাকে জন্ম দেবার পরিশ্রমে যে-মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিলো, তার কিছু প্রাপ্য ছিলো আমার কাছে; তা দেবার সময় এখনো হয়তো পেরিয়ে যায়নি।
বুদ্ধদেবের জীবনের প্রথম শিক্ষক, প্রথম বন্ধু ও প্রথম ক্রীড়াসঙ্গী ছিলেন তাঁর দাদামশায় অর্থাৎ মাতামহ চিন্তাহরণ। বিদ্যালয়ে ভর্তি করার আগেই তিনি দৌহিত্রকে অতুলনীয় ভঙ্গিতে ইংরেজি শিখিয়েছিলেন। শুধু বিভিন্ন ভাষার পাঠ নয়, তাঁর মধ্যে লেখকসত্তার বীজও বপন করেন দাদামশায় – পারিবারিক ছোটো-ছোটো চিঠিপত্র তিনি আমাকে দিয়েই লেখান; আমার সাত বছরের জন্মদিন থেকে আমাকে একটি রোজনামচা লেখার কাজে লাগিয়ে দিলেন – সবই ইংরেজিতে। শুরুতে তিনি বাক্যগুলো বলে দিতেন আমাকে, বা সাহায্য করতেন : অল্পদিনের মধ্যে আমার কলম স্বাধীনভাবে সচল হয়ে উঠলো।
বাংলা ভাষায় বুদ্ধদেবের শিক্ষক ছিলেন লেখকরা – যোগীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাঁর অধ্যয়নের জগৎ। ইংরেজির পাশাপাশি বুদ্ধদেবের বাংলা ও সংস্কৃত ভাষাতেও হাতেখড়ি দাদামশায়ের কাছে। শৈশবেই কুমিল্লা থেকে পরিবারের সঙ্গে স্থানান্তরিত হন নোয়াখালীতে। সেখান থেকেই তাঁর স্মৃতির শুরু।
বুদ্ধদেবের বয়স যখন নয়, তখন প্রথম কবিতাটি লিখে ফেলেন মাতৃভাষায় নয়, ইংরেজিতে। ইংরেজিতে কেন সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন – ইংরেজিতে কেন? আমি জানি না – ইংরেজিতে এসেছিলো, এ ছাড়া আমার কোনো উত্তর নেই। কিন্তু ইংরেজিতে কেন ‘এসেছিলো’, তারও কোনো কারণ আছে নিশ্চয়ই? আমার বয়স তখন নয় হবে বা কিছু বেশি, হেম নবীন মধুসূদনের সঙ্গে চেনাশোনা হচ্ছে, আমি জানি এবং মানি এঁরা ‘বড়ো’ কবি, ‘মহাকবি’ – কিন্তু আসলে হয়তো অনেক বেশি ভালো লাগছে ‘ওয়ান থাউজেণ্ড অ্যান্ড ওয়ান জেম্স অব ইংলিশ পোয়েট্রি’ নামে লাল মলাটের মোটা বইটা – আমার পুরনো এক সঙ্গী যার
ছোটো-ছোটো অক্ষরে আমি প্রথম পড়েছিলাম ওঅর্ডস্বার্থ, কূপার, টমাস গ্রে-র এলিজি, এরিয়েল-এর গান। আসলে আমার জীবনে তখনো রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব হয়নি, শৈশবোত্তর বাংলা কবিতার অমৃতস্বাদ আমি পাইনি তখনো। হয়তো সেজন্যেই এই বিদেশি ভাষায় ডেলনি-হাউসকে বিদায় জানিয়েছিলাম।
এর পর থেকে আর কবিতাকে ছাড়তে পারেননি তিনি। আমৃত্যু কবিতায় সমর্পিত ছিল বুদ্ধদেবের সাহিত্যিক সত্তা; তবে ইংরেজি ভাষায় নয়, বাংলায়। এমন সাহিত্যিক প্রস্তুতি নিয়ে বাংলা ভাষায় খুব কম লেখকই আবির্ভূত হয়েছেন। আত্মজীবনীর পরবর্তী অংশ পাঠ করলে বোঝা যায়, কেন আধুনিক বাংলা সাহিত্য আন্দোলনের নেতৃত্ব বুদ্ধদেবের স্কন্ধে অর্পিত হয়েছিল।
বুদ্ধদেবের অপূর্ব গদ্যশৈলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য সমাসবদ্ধ পদের দক্ষ ব্যবহার। মেঘদূত-এর ভূমিকায় ‘লিবিডোভারাতুর’ কথাটি লিখে তিনি বিদগ্ধ পাঠকদের চমকে দিয়েছিলেন। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় সমাসের ক্ষমতা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের স্মৃতিচারণা করে তিনি লিখেছেন – সংস্কৃত ব্যাকরণে যেটুকু কাণ্ডজ্ঞান আমার আজ পর্যন্ত সম্বল তা সেখানকার হেডপণ্ডিতের কাছেই কুড়িয়ে পাওয়া, তাঁরই সাহায্যে সমাস জিনিসটার বিপুল ক্ষমতা আবিষ্কার করে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম, এও বুঝেছিলাম কেমন অল্প হেরফেরেই বাংলা বিশেষ্য থেকে নিটোল এক-একটি বিশেষণ বেরিয়ে আসে।
শৈশবেই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে বুদ্ধদেবের। অদ্ভুত হৃদ্যতা তৈরি হয়েছিল বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু প্রভুচরণের সঙ্গে। মেধাবী প্রভুচরণ উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে যান। তাঁর সঙ্গে ডাকযোগে বুদ্ধদেবের যোগাযোগ থাকে অবিচ্ছিন্ন। বিদেশ থেকে তাঁর পাঠানো চিঠি, বই, বিচিত্র পত্রপত্রিকা বুদ্ধদেবের শিশুমনকে সমৃদ্ধ করেছিল। তাঁর অন্তর্জগৎ কীভাবে বিশ^সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারাকে আত্মস্থ করেছিল এর সুখপাঠ্য বিবরণ পাওয়া যায় মাত্র কয়েকটি বাক্যে – তাঁর চিঠি হাতে পাওয়ার মুহূর্ত থেকে আমার সম্ভোগ শুরু হয়ে যায় : সারি-সারি বিদেশি ডাকটিকিট, ইস্ত্রি-করা কাপড়ের মতো কড়কড়ে কাগজ; কত অচেনা ভাষায় রাস্তার নাম, হোটেলের নাম – আর ভেতরে কত গল্প, কত নতুন খবর, কত স্নেহ সম্ভাষণ! বই আসে ইবসেন, ম্যাটারলিঙ্ক, গোর্কি, আন্ড্র্রিয়েহ¦, অস্কার ওয়াইল্ড, শ্যন ও’কেইসি, সমকালীন মার্কিন কবিতার সংকলন, আসে ন্যুয়র্কে মস্কো আর্ট থিয়েটারের অভিনয়-ঋতুর চিত্রময় অনুষ্ঠানলিপি, চিঠির মধ্যে সংবাদপত্রের কর্তিকা – পাভলোভার নৃত্য, ডুজের অভিনয়, শোপ্যাঁর সংগীত বিষয়ে আলোচনা। এর মধ্যে যা-কিছু আমি ঠিকমতো বুঝি না সেগুলিরও কিছু দেবার থাকে আমাকে – বইগুলোর গায়ে উন্মাদক এক গন্ধ, মুদ্রণের প্রসাধন, ছবি, আর অনেক দূর দেশের বাতাসের ছোঁয়া। পুরো পাশ্চাত্য জগৎ, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ, সেখানকার শিল্প-সাহিত্য জীবনযাত্রা, প্রাণবন্ত ভূগোল, আমার চোখে-না-দেখা কিন্তু মনের মধ্যে বাস্তব-হয়ে-ওঠা কত নদী নগর নর-নারী – এ-ই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন প্রভুচরণ, আমার চৌদ্দ থেকে ষোল বছরের মধ্যে, আমি যখন একটি চারাগাছের মতো মাটির তলা থেকে উদ্গত হচ্ছি, চাচ্ছি আমার সরু-সরু ডালগুলোকে জগৎ-জোড়া আকাশের দিকে তুলে ধরতে।
ষোলো বছর বয়সে প্রথম বই প্রকাশের স্মৃতি আবেগঘন ভাষায় উপস্থাপন করেছেন বুদ্ধদেব – ঢাকার স্থানীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন পরিমলকুমার ঘোষ। ইংরেজির অধ্যাপক তিনি, কবিখ্যাতিও আছে কিছুটা। … খুব সম্ভব তাঁরই প্ররোচনায় বা পরামর্শে, বাংলাবাজারের এক পাঠ্যপুস্তক-বিক্রেতা আমায় এমনকি গ্রন্থকারের মর্যাদা দিলেন – গাঁটের কড়ি খসিয়ে, একটি কপিও বিক্রির আশা না-রেখে। চটি কবিতার বই – আমি নাম দিয়েছিলাম ‘মর্মবাণী’, তখন পর্যন্ত জীবিত দাদামশায়ের নামে একটি বাগ্বহুল উৎসর্গলিপি লিখেছিলাম। বালি কাগজে ছাপা, আমার পক্ষে খেদজনকভাবে হাতছানি কথাটা ছাপা হয়েছে ‘হাতসানি’ – তবু যা-ই হোক একটা বই তো। মুন্সীগঞ্জে যেবার বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হ’লো – আমার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার পরে লম্বা ছুটি চলেছে তখন – আমি অনেকগুলো কপি সঙ্গে ক’রে নিয়ে গেলাম।
আটাশটি ছোট পরিচ্ছেদে বিভক্ত আমার ছেলেবেলা। বিচিত্র ও বর্ণিল অভিজ্ঞতার সমাহার এ-কাহিনির ঘটনাক্রমকে এভাবে বিন্যস্ত করা যায় – প্রথম শৈশবস্মৃতি শব্দের ও ভাষার; দাদামশায়ের মামিমা, এক নিষ্ঠাবতী নিরলস প্রৌঢ়া বিধবার আলেখ্য; নোয়াখালীর মফস্বলি বৃত্তান্ত; ধ্বংসপরায়ণ মেঘনা; প্রথম কবিতার রচনা; প্রথম প্রেমের অস্ফুট উপলব্ধি; চিঠিলেখা ও পোস্টাপিস প্রীতি; সরস্বতী পূজা; মৌচাকে লেখা ছাপা না হওয়ায় সম্পাদকের বিরুদ্ধে পক্ষপাতদোষের অভিযোগ; টাউন হল ও তার থিয়েটার; পড়া-লেখা-ছাপা; চয়নিকা পাঠ ও রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার; ছিন্নপত্রে আচ্ছন্ন; চিত্তরঞ্জন দাশ ও বাসন্তী দেবীর সাথে নৌকা ও স্টিমার ভ্রমণ; জলে বোঝাই গ্রামের স্মৃতি; প্রথম মহাযুদ্ধ ও অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ; নোয়াখালী ছেড়ে ঢাকায়; প্রথম সুহৃদ প্রভুচরণ গুহঠাকুরতা; স্কুলে ভর্তি; সিনেমার নেশা; দাদামশায়ের মৃত্যু; পুরানা পল্টন; পরিমলকুমার ঘোষ ও প্রথম বই মর্মবাণী; বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে শরৎচন্দ্রের উপস্থিতিতে কবিতাপাঠ; প্রথম রবীন্দ্রনাথ দর্শন; অপূর্বকুমার চন্দের স্নেহ; প্রথম কলকাতা ও কল্লোলের দলে নাম লেখানো; ‘বন্দীর বন্দনা’র আবির্ভাব।
বন্দীর বন্দনার জন্ম অর্থাৎ বুদ্ধুদেব বসুর স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্নেই আমার ছেলেবেলার সমাপ্তি ঘটেছে। আত্মজীবনীর প্রথম পর্বটি একজন বহুমাত্রিক লেখকের প্রস্তুতিপর্বের উজ্জ¦ল স্মারক।
বুদ্ধদেবের জীবনের মধ্যাহ্ন নিয়ে রচিত আমার যৌবন ৩৭টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত। ঢাকা ও কলকাতায় তাঁর জীবন নানা ঘটনার সূত্রে আন্দোলিত হচ্ছে। এই পর্বের বর্ণিল সূচনা ঘটে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে তাঁর দৃপ্ত পদচারণার মধ্য দিয়ে। ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। সেই বছরেই প্রগতি পত্রিকা ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হতে শুরু করে।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বুদ্ধদেবের জীবন ছিল মুক্ত বাতায়নের মতো। অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ ছিল তাঁর বিশ^বিদ্যালয়জীবন। ইংরেজি বিভাগে বিদ্যায়তনিক ফলাফলের বিচারে এখন পর্যন্ত তিনি অনতিক্রম্য। শুধু ভালো ফল তাঁর লক্ষ্য ছিল না। মুক্তদৃষ্টিতে তিনি চারপাশকে অবলোকন করেছেন, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বর্ণিল ভুবনে নিজের অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। বিভিন্ন সৃজনশীল উদ্যোগে নিজেকে নিবিড়ভাবে যুক্ত করেছেন। আমার ছেলেবেলা শেষ হয়েছে আত্মপ্রকাশের সন্ধিক্ষণে, ‘আমার যৌবন’-এর শেষ ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিন্যুতে এসে অধিষ্ঠানে। মাত্র চার বছর এই পর্বের কার্যক্রম, অথচ অভিজ্ঞতা যেন চোদ্দো বছরের। তবে এই অভিজ্ঞতার বিবরণ পুরোপুরি ক্রমিক নয়, নির্ঘণ্ট করলে দেখা যাবে, একটু কলকাতার কথাও এখানে-ওখানে ঢুকে পড়ছে। তেমনি কলকাতা পর্বেও ঢাকার কথা আছে। তবু ক্রমটা এই – প্রগতি প্রকাশ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও জগন্নাথ হল, ঢাকায় নজরুল, বিশ^বিদ্যালয়ের সমৃদ্ধ কমনরুম, চায়ের দোকানের আড্ডা, বন্ধুবর্গ, রমনা ও শিক্ষকবৃন্দ, পুরানা পল্টনের আড্ডা, ঢাকার খানিক ভূগোল, প্রগতির লেখকগোষ্ঠী, ঘটক-গৃহ, মোহিতলাল, সুশীলকুমার দে, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সন্ত্রাসবাদের ছোঁয়া, কলকাতার কল্লোলের আড্ডা, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে, সুকুমার সরকার, প্রিয়ংবদা দেবী, নীলিমা দেবী, অনার্স পরীক্ষা ও প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সুশোভন সরকার।
‘প্রগতি পত্রিকাটিকে কল্লোলেরই একটি টুকরো বলা যায়’ – বুদ্ধদেব বসুর এই কথার মধ্যে প্রত্যক্ষ সত্য আছে। নতুন পত্রিকা মানে নতুন সাহিত্যাদর্শ। কল্লোল ও প্রগতির সাহিত্যাদর্শে কোনো ভেদ ছিল না – উভয়েই শনিবারের চিঠির চক্ষুশূল। আধুনিকতা থেকে যে প্রগতি দূরে থাকতে চায়নি তার আভাস তো তার নামেই স্পষ্ট। তার প্রগতিশীল চরিত্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রতি সংখ্যায় যে সাহিত্যিক বাদানুবাদ থাকত তার মূলেও ছিল বহুনিন্দিত আধুনিকতা। রবীন্দ্রনাথের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে অচিন্ত্য-প্রেমেন-বুদ্ধদেবের দল কোন কোন কবির কথা ভাবছিলেন তার তালিকা দিয়েছেন। তাঁরা যে শেষ পর্যন্ত সত্যেন্দ্রনাথ, নজরুল, গোবিন্দচন্দ্র দাস ও যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তকে পেরিয়ে মোহিতলালের বিস্মরণীতে পৌঁছেছিলেন তা জানিয়েছেন। আবার এটিও বলেছেন যে, কল্লোল ও প্রগতির প্রতি মোহিতলালের বিরাগ উপলব্ধি করতে তাঁদের দেরি হয়নি।
কল্লোল ও প্রগতি পত্রিকাকে ঘিরে সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে বুদ্ধদেবের অমøমধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। এই দুই পত্রিকার মধ্যে নিবিড় সংযোগ ছিল। কল্লোলের সঙ্গে প্রগতির মূল পার্থক্য ছিল এই যে, প্রগতিতে সাহিত্যিক বাদানুবাদ নিয়মিত স্থান পেয়েছে। সেই বাদানুবাদে বুদ্ধদেব শনিবারের চিঠিসহ নানা মহলের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন। জীবনানন্দ দাশ অভিহিত হয়েছিলেন ‘গণ্ডার কবি’ হিসেবে। উপেক্ষার অন্তরাল থেকে সবলে তাঁকে বের করে এনে আলোকোজ্জ¦ল প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। সেই দ্বন্দ্বমুখর সময়ের বৈশিষ্ট্যকে প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন বুদ্ধদেব – ‘প্রগতির জন্য এটুকু অন্তত দাবি করা যায় যে, সেই দূর সময়ে, যখন ‘গণ্ডার কবি’কে নিয়ে রোল উঠেছিল অট্টহাসির, অন্য কোথাও সমর্থনসূচক প্রয়াস ছিলো না, তখন সেই ক্ষুদ্র মঞ্চটিতেই প্রথম সংবর্ধিত হন জীবনানন্দ প্রকাশ্যে, একক কণ্ঠে, সোচ্চার ঘোষণায় এবং – এটাও উল্লেখ্য – রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুখোমুখি একটি অতি আবশ্যক বোঝাপড়ার চেষ্টাও সেখানেই আমরা প্রথম করেছিলাম। বোঝাপড়া – মানে, এমন কোনো ব্যবস্থা, কিংবা বলা যাক আমাদের দিক থেকে প্রস্তুতি, যাতে রবীন্দ্রনাথের বিশাল জালে আমরা আটকে না থাকি চিরকাল, তাঁকে আমাদের পক্ষে সহনীয় ও ব্যবহার্য করে তুলতে পারি। লোকজন এর নাম দিয়েছিল রবীন্দ্র-বিদ্রোহ, কিন্তু শেষের কবিতার প্রথম দু-তিনটি পরিচ্ছেদ পড়ে আমার মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ আমাদের মনের কথাটা আঁচ করেছিলেন।
‘শুরুতে বেশ জমেছিল এই তর্কের খেলা, কিন্তু কিছুদিন যেতেই আমোদের অংশ উবে গেল, যা ছিল স্রোতের জল তা হয়ে উঠলো পাঁকালো, রঙ্গরস গাঁজিয়ে উঠল তিক্ততায়। মাঝেমধ্যে আমার অনুভূতি হয় এসব বাগ্বিতণ্ডা নিষ্ফল, নিজের ধরনে নিজের কাজ করে যাওয়ার মতো ভালো আর কিছু নেই। প্রগতি যখন উঠে গেলো, আমি এ-কথা ভেবে স্বস্তি পেলাম যে কোনো জুগুপ্সাপরায়ণ পত্রিকা আমাকে আর খুলে দেখতে হবে না।’
লেখক জীবনের শুরু থেকেই অশ্লীলতা বিতর্ক বিব্রত করেছে বুদ্ধদেব বসুকে। যৌবনে আদালত-পুলিশের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে। ত্রিশের দশকের শুরুতে চারটি উপন্যাসের বিরুদ্ধে পাবলিক প্রসিকিউটর অশ্লীলতার অভিযোগ আনেন। উপন্যাসগুলি ছিল – প্রবোধ সান্যালের দুয়ে আর দুয়ে চার, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের বিবাহের চেয়ে বড়ো এবং প্রাচীর ও প্রান্তর, বুদ্ধদেবের এরা আর ওরা এবং আরো অনেকে। বুদ্ধদেবের ঘনিষ্ঠ দিলীপকুমার রায় একজন দুর্জয় ব্যারিস্টারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই ব্যারিস্টারের সঙ্গে গাড়িতে করে লালবাজারে যাচ্ছিলেন বুদ্ধদেব। বাকিটুকু বুদ্ধদেবের অনবদ্য ভঙ্গিতে শোনা যাক – আর তারপর, ট্যাক্সি যখন মোড় নিচ্ছে লালবাজারে যেন হঠাৎ কাজের কথাটি মনে পড়ে গেছে এমনি সুরে আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি কী লিখেছিলেন বলুন তো?’ প্রশ্নটা অদ্ভুত শোনালো আমার কানে, কেননা আমি তাঁকে এক কপি বই দিয়ে এসেছিলাম, ধরে নিয়েছিলাম ইতোমধ্যে তিনি খুঁটে-খুঁটে পড়েছেন সেটা, আমার সমর্থনকল্পে অনেক যুক্তি সাজিয়েছেন মনে-মনে। তাঁকে আশ^াস দেবার ধরনে আমি বললাম, ‘কিছু না – তরুণ-তরুণীর প্রেমের কথা আরকি।’ ‘অ্যাঁ!’ শূন্যে হাত তুলে আঁৎকে উঠলো ব্যারিস্টার সাহেব, ‘ÔLove between unmarried men and women! …! আপনি করেছেন কী! এসব কথা কি শেক্সপিয়র লিখেছেন, না মিল্টন লিখেছেন? আমরাও তো বিলেতে শ্চুডেন্ট ছিলুম – কই, এ-রকম তো দেখিনি!’ আমার মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে উঠল, এই অকল্পনীয় উক্তি শুনে হাসতে পর্যন্ত পারলাম না।
এই ঘটনার পর বুদ্ধদেবের বই প্রকাশ করতে প্রকাশকগণ ভয় পাচ্ছিলেন। বুদ্ধদেব হলেন ছদ্ম প্রকাশক। প্রকাশিত বইয়ে লেখক ও প্রকাশক হিসেবে মুদ্রিত হলো তাঁর নাম। এরই ধারাবাহিকতায় প্রকাশক হিসেবে আবির্ভাব ঘটে বুদ্ধদেবের। ‘গ্রন্থকার মণ্ডলী’ সেই প্রকাশনা সংস্থার নাম। বুদ্ধদেবের নিজের এবং অচিন্ত্য সেনগুপ্ত ও বিষ্ণু দে-র বই প্রকাশিত হয় সেই প্রকাশনা সংস্থা থেকে।
আমার যৌবন বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বুদ্ধদেবের কলকাতাবাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এই পর্বকে ধারাবাহিকতার ক্রমানুসারে এভাবে বিন্যস্ত করা যায় – কলকাতার প্রথম বাড়ি ভাড়া নেওয়া; হোয়াইটওয়ে লেডল’র লোভনীয় চায়ের দোকান; এম. সি. সরকার ও গুপ্ত ফ্রেন্ডস্-এর বদান্যতা; অচিন্ত্যকুমারের দেওয়া ট্যুশনির ছাত্র দিলীপকুমার গুপ্ত; সমর সেনের আবির্ভাব; পরিচয়ের আড্ডা-বর্ণন; পূর্বাশা, সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও সত্যপ্রসন্ন দত্ত; হেমচন্দ্র বাগচী; পেশাদারী মঞ্চে ‘রাবণ’ অভিনয়ের সম্ভাবনা ও আশাভঙ্গ; অগাধ স্নেহের অধিকারী দিলীপকুমার রায়; আশালতা সিংহের সঙ্গে পত্রালাপ; অশ্লীলতার মামলা; নিজেদের প্রকাশনী ‘গ্রন্থকারমণ্ডলী’; কেবল লিখে সংসার চালানো; প্রেম ও বিবাহ; কবিতা পত্রিকা ও প্রথম সন্তান; কাব্যনাট্য ‘অনুরাধা’ অভিনয়; পি. ই. এন.-এ হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে আলাপ; ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিন্যুতে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে উঠে আসা।
জীবনের যাবতীয় অনিশ্চয়তা ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম সত্ত্বেও কলকাতার মায়া বুদ্ধদেব কাটাতে পারেননি। ঢাকায় তারুণ্য কাটলেও ঘটনাবহুল কর্মক্ষেত্র হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন কলকাতাকে। কলকাতাপ্রেমী বুদ্ধদেব লিখেছেন – আমার এক প্রাক্তন অধ্যাপক আমাকে জিগ্যেস করে পাঠালেন আমি তিন মাসের জন্য কৃষ্ণনগর কলেজে যাবো কিনা, বুদ্ধু-দা দিল্লি থেকে একটা সাংবাদিক কর্মের বার্তা জানালেন। কিন্তু কোনোটাই লুব্ধ করলো না আমাকে; টানাটানির মধ্যেও এ-ই আমার মস্ত সুখ আমি কলকাতায় আছি – কলকাতার ধুলোর গন্ধেও মাদকতা।
কৃতী সাহিত্যিক শিল্পীদের অনেকের কথা বুদ্ধদেব স্মরণ করেছেন। হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিয়েছেন সুকুমার সরকার ও হেমচন্দ্র বাগচীর করুণ পরিণতির । বুদ্ধদেব লিখেছেন, ‘কবিতা দেবী প্রতি যুগে একটি-দুটি বলি গ্রহণ করে থাকেন, কল্লোল যুগে সুকুমার তার উদাহরণ।’
বুদ্ধদেব বসু ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শেষ অভিভাবক। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সময়ে যে-অর্থে অভিভাবক ছিলেন, বুদ্ধদেবও সেই অর্থেই অভিভাবক ছিলেন। তাঁরা তিনজনই প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁরা তিনজনই সম্পাদনা করেছেন অমূল্য সব সাহিত্যপত্র যা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্য সম্পাদনার ক্ষেত্রে দুই মহৎ পূর্বসূরিকে ছাড়িয়ে গেছেন বুদ্ধদেব বসু কবিতা নামক অবিস্মরণীয় সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। কবিতার আবির্ভাব এবং জয়যাত্রার উজ্জ্বল স্মারক বুদ্ধদেবের আত্মজীবনীয় তৃতীয় পর্ব আমাদের কবিতাভবন। শুধু কবিতার জন্য একটি পত্রিকা প্রকাশ ছিল অভূতপূর্ব উদ্যোগ। কীভাবে এই ভাবনা বুদ্ধদেবকে নাড়া দিয়েছিল সে-সম্পর্কে তিনি লিখেছেন – পরিচয়ের কোনো-এক বৈঠকে দেখেছিলাম অন্নদাশঙ্করের হাতে একটি ইংরেজি পত্রিকা – চেহারা কিছুটা শেষ উনিশ-শতকী, ইট-রঙের মলাট থেকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছেন শেলি লম্বা রোগা অক্ষরে আঁকা ‘পোয়েট্রি’ তার শিরোনামা। আমি জানি না সেটাই হ্যারিয়েট মনরো-স্থাপিত শিকাগোর ‘পোয়েট্রি’ কিনা – তখনো সেই বিখ্যাত পত্রিকাটির নাম শুনিনি; কিন্তু সেটাতেও ছিল শুধু কবিতা আর হয়তো কিঞ্চিৎ কবিতা-সংক্রান্ত গদ্য। নমুনাটি উল্টে-পাল্টে দেখে আমার মনের মধ্যে একটা উশকানি জাগলো। এরকম একটি কবিতাসর্বস্ব পত্রিকা বাংলায় কি বের করা যায় না? তখন এ নিয়ে কথা বললাম না কারো সঙ্গে, হয়তো অসম্ভব ভেবে মনের তলায় চেপে দিয়েছিলাম কিন্তু সেই অঙ্কুর থেকেই ফল ফললো প্রায় চার বছর পরে – আমার সে-সময়কার ঘনিষ্ঠতম সাহিত্যিক বন্ধু প্রেমেন আমার সঙ্গী, প্রধান উৎসাহদাতা বিষ্ণু দে ও সমর সেন।
কবিতার প্রকাশলগ্নে রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয়ভাবে সৃষ্টিশীল, যাঁর সাহিত্য ছিল বুদ্ধদেবের পরম আশ্রয়। তিনি ভয়ে ভয়ে পত্রিকার প্রথম সংখ্যা পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। বুদ্ধদেব লিখেছেন –
… ভয় এজন্যে নয় যে আমাদের ক্ষুদ্র উপচার তাঁর পছন্দ হবে না – সেটা প্রায় প্রত্যাশিত বলা যায়, পাছে, তাঁর অসামান্য সৌজন্য ও কর্তব্যবোধের তাগিদে, তিনি লিখে পাঠান কোনো দায়সারা গোছের সার্টিফিকেট, অথবা তাঁর ঝুলি হাৎড়ে বের ক’রে দেন দু-চার লাইনের কোনো পদ্য-বিন্যাস …। কিন্তু আমাদের সব দ্বিধা উড়িয়ে দিয়ে দ্রুত এল তাঁর উত্তর – মস্ত একখানা তুলোট কাগজের এপিঠ-ওপিঠ ভর্তি সেই অনিন্দ্যসুন্দর হস্তাক্ষর, যার তুলনা আমি দেখেছিলাম বহুকাল পরে অক্সফোর্ডে এক প্রদর্শনীতে টেনিসন ও রবার্ট ব্রিজেসের পাণ্ডুলিপিতে, উপরন্তু এলো তাঁর আনকোরা নতুন লম্বামাপের গদ্য-কবিতা ‘ছুটি’…। কবিতার দ্বিতীয় সংখ্যা শুরু হয়েছিল এই ‘ছুটি’ কবিতা দিয়েই …।
রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় বাংলা কাব্যপরিচয় পর্যবেক্ষণ করে আধুনিক কবিতার একটি দর্শনপ্রতিম সংকলন প্রকাশ করার ইচ্ছা তাঁর মনে জেগে ওঠে। সেই সংকলনটি দেখে বুদ্ধদেবের বিশ^াস করতে কষ্ট হয়েছে যে, এটি রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা করেছেন। এরই পরম্পরায় ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় আধুনিক বাংলা কবিতা। আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল সংকলনটি। বিদগ্ধ সম্পাদকদের দুজনের একজনও কবি ছিলেন না। সংকলনে যা ছাপা হলো তাতে বুদ্ধদেবের পুরো সায় ছিল না। জীবনানন্দের আরো উন্নত কবিতাগুলি স্থান দিতে না পারার বেদনা তাঁকে আহত করল। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বইয়ে দুই সম্পাদক পরস্পরবিরোধী দুটি আলাদা সম্পাদকীয় লিখলেন। সেই সংকলনে ‘সমাজচেতন’ কবিতার প্রাধান্য ছিল। চোদ্দো বছর পর নতুন সংস্করণের সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে তিনি জীবনানন্দকে যোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। এতে বুদ্ধদেবের রসবোধ ও বিবেক দুই-ই তৃপ্ত হয়েছিল।
ততদিনে বুদ্ধদেব বসুর নামের পাশে রবীন্দ্রবিরোধী বিশেষণ যুক্ত হয়ে গিয়েছে। ১৯৩৮ সালে ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘে’র মুখপত্র প্রগতি পত্রিকায় আলোচনা সূত্রে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘The age that produced Rabindranath is over.’ অমৃতবাজার পত্রিকা তাঁর কথাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে লিখল, ‘The age of Rabindranath is over.’ ‘রবীন্দ্রবিরোধী’ বুদ্ধদেবকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন ‘সময়হারা’ নামে একটি কবিতা – ‘খবর এল সময় আমার গেছে/ আমার গড়া পুতুল যারা বেচে’।
তাঁর নামের সঙ্গে রবীন্দ্রবিরোধী বিশেষণ যুক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটলেও তার কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখালেন না বুদ্ধদেব বসু। অপেক্ষা করছিলেন বড় কোনো উপলক্ষের। সিলেটের করিমগঞ্জে অপেক্ষার অবসান হলো। করিমগঞ্জে একটি সাহিত্য-সভায় অংশ নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। রবীন্দ্রবিরোধী চিহ্ন মুছে ফেলতে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ পড়েন সেখানে। কলকাতায় ফিরে প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘আধুনিক বাংলা ভাষা রবীন্দ্রনাথই সৃষ্টি করেছেন’। অনেক পরে এ-প্রসঙ্গে সেই সময়ের অনুভূতি নিয়ে আত্মজীবনীতে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘তিনি কী জানতেন না, ঘোষণাকারীর (বুদ্ধদেবের) এক দণ্ড রবীন্দ্রনাথ বিনা চলে না?’
কবিতাভবনে অনুষ্ঠিত আড্ডা সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন – কবিতাভবনে আড্ডা চলে বিশুদ্ধ শৈলীতে, আয়োজনহীন, স্বতঃস্ফূর্ত; সন্ধে থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত খোলা, অতিথিরা আসা-যাওয়া করেন যেমন খুশি, সপ্তাহে প্রতিদিন, বারো মাস, প্রায় একটা সন্ধ্যাও ফাঁকা রাখা যায় না। একান্ত চায়ে আপ্যায়ন – উপসংহারে কখনো কখনো পান – আর আনুষঙ্গিক বড়োজোর কখনো ডালমুট বা পাঁপর ভাজা।
একবারই ‘কবিতাভবনের’ আড্ডায় এসেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। কবিতা পাঠের আসর ছিল সেদিন। তিনি উপস্থিত হয়েই জানান তাঁর দাঁতে ব্যথা। অনেক সাধ্য-সাধনা করেও তাঁকে দিয়ে কবিতা পড়ানো গেল না। শেষে দাঁতে ব্যথা বলতে বলতে গালে হাত চেপে চিরাচারিত শশক পদক্ষেপে চলে গিয়েছিলেন তিনি।
অশ্লীলতা বিতর্ক কখনো পিছু ছাড়েনি বুদ্ধদেব বসুর। নির্ধারিত প্রেস থেকে একদিন কবিতা পত্রিকার নতুন সংখ্যা আনতে গেছেন। সেখানে গিয়ে শুনলেন পত্রিকা ছাপা হয়েছে কিন্তু চালান দেওয়া যাবে না। প্রেসের এক কর্মী একটি কবিতার অংশবিশেষ দেখিয়ে বললেন, আগে লক্ষ করলে এসব অশ্লীলতা তারা ছাপতেন না। কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তর সেই কবিতায় নারীদেহের কয়েকটি প্রত্যঙ্গের নামোল্লেখের কারণে অশ্লীলতার অভিযোগ। নিরুপায় হয়ে বুদ্ধদেবকে বিখ্যাত লেখক ও আইনজীবী অতুলচন্দ্র গুপ্তের লিখিত অভয়বাণী এনে পত্রিকা নিতে হয়েছিল।
আমাদের কবিতাভবন-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য সমকালীন সাহিত্যিক-শিল্পীদের অন্তরঙ্গ ব্যক্তিত্ব উন্মোচন। তাঁদের কয়েকজনের তিনি আলেখ্য রচনাও করেছেন, যেমন ইংল্যান্ড-ফেরত অমিয় চক্রবর্তীর, ‘উদয়ের পথে’-খ্যাত জ্যোতির্ময় রায়ের, চাঁদ-চামেলি খ্যাত হিমাংশু দত্ত সুরসাগরের, রবীন্দ্রসংগীতবিশারদ শৈলজারঞ্জন মজুমদারের, এবং পণ্ডিচেরি-খ্যাত দিলীপকুমার রায়ের; কিন্তু সবচেয়ে বেশি যাঁকে নিয়ে ভেবেছেন তিনি যামিনী রায়। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কি বিষ্ণু দে-র মতো তিনি চিত্রকলা নিয়ে আলাদা কিছু বলেননি, কিন্তু সেই সূত্র ধরে তিনি পৌঁছতে চাইছিলেন যামিনী রায়ের চরিত্রে, তাঁর স্বধর্মপালনের রহস্যে। যামিনী রায়-প্রস্তাবিত ভারতীয় অভারতীয় ভেদ বা গ্রাম-শহরের অনৈক্য বা তাঁর সারল্য বন্দনা তিনি মানেননি, কিন্তু তাতে কিছু এসে যায়নি, কারণ যামিনী রায়ের ‘ব্রতপালনের মতো দিনযাপন’ ছিল তাঁর কাছে আদর্শ। রিলকে যেমন রদ্যাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, বুঝেছিলেন শিল্পীও আসলে শ্রমিক – আর তাঁর রিলকে অনুবাদের ভূমিকায় এই ‘নিরন্তর’ কর্মযোগের কথা বিশেষভাবে বলেছিলেন বুদ্ধদেব বসু – হয়তো তেমনভাবেই তিনি যামিনী রায়কে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি গ্রহণ করতে পেরেছিলেন কারণ তাঁর স্বভাবেও ব্রতপালন ছিল। একটু অন্যভাবে তিনি আদর্শ মেনেছিলেন পুলিবিহারী সেনকে। ‘যুগবতী’-‘যুগবর্তী’ বিতর্কে যে তিনি তাঁর কাছে হেরেছিলেন দলিলের অভাবে। দলিল বিনা যে-ইতিহাস অসিদ্ধ তা তিনি এই আত্মাভিমানশূন্য রবীন্দ্রনাথ তথ্যবিশারদের কাছেই শেখেন।
আমাদের কবিতাভবনে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিবরণ সম্ভবত অজিত চক্রবর্তীর – আলো-অন্ধকারের এমন বণ্টন আর কোনোটিতে নেই। অমিয় চক্রবর্তীর ভাই হয়েও তাঁর কত বিপরীত হওয়া যায় তার প্রমাণ অজিত চক্রবর্তী এবং অমিয় চক্রবর্তীর একান্ত গুণগ্রাহী হয়েও অজিত চক্রবর্তীকে যে শ্রদ্ধা করা যায় – করুণা নয়, শ্রদ্ধা – তার প্রমাণ বদ্ধুদেব বসু। সেইসঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছেন জরাগ্রস্ত প্রমথ চৌধুরী (জীবনানন্দের ভাষায় ‘আহত বৃদ্ধ ঈগল’), আত্মধ্বংসী অজিত চক্রবর্তীর একতলা যাঁর গন্তব্যের একটি। অজিত চক্রবর্তীর আত্মহত্যায় সবচেয়ে ধাক্কা দিয়েছিল তাঁর শেষ চিঠি, যেখানে তিনি লিখেছিলেন তাঁর স্বাস্থ্য ইদানীং ভালো যাচ্ছে বলেই বহুদিন লালিত এই সংকল্প তিনি সাধন করতে পেরেছিলেন।
বুদ্ধদেব বসু কিছুদিন রিপন (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ) কলেজে পড়িয়েছিলেন। কলেজ কর্তৃপক্ষের অবিবেচক আচরণের জন্য তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথাও এখানে আছে। তবে তাঁর সহকর্মী ছিলেন অজিত দত্ত, বিষ্ণু দে, প্রমথনাথ বিশী, বিমলাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং কিছুদিন হমফ্রি হাউস। সেই সুবাদে বিষ্ণু দে-র সঙ্গে গল্প করতে করতে ট্রামে বাড়ি ফেরার স্মৃতিও আছে। আমাদের কবিতাভবনের চব্বিশটি পরিচ্ছেদের নির্ঘণ্ট তৈরি করলে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য সংযোজন হবে এই বিবরণে যেমন – কবিতাভবন প্রকাশনার এক পয়সায় একটি কবিতামালা, ছোটোগল্প গ্রন্থমালা ও বৈশাখী বার্ষিকীর কথা; প্রতিভা বসুর সংগীতচর্চা ছেড়ে সাহিত্যসাধনায় মনোযোগের কথা; চৌরঙ্গি টেরাসের যতীন্দ্রমোহন ও শোভনা মজুমদারের গুণগ্রাহিতার কথা; যুদ্ধকালীন কলকাতায় বোমা ও বাংলা সাহিত্যের সম্প্রসারণ সমাচার; আর বাইশে শ্রাবণের অমোচনীয় স্মৃতি যা অবিস্মরণীয়ভাবে অঙ্কিত আছে তাঁর তিথিডোর উপন্যাসেও।
বুদ্ধদেব তাঁর সাহিত্যচর্চার দর্শনকে কখনো আবৃত রাখেননি। গদ্যে ও পদ্যে স্পষ্টভাবে তাঁর সাহিত্যদর্শনকে উন্মোচন করেছেন। তিনি লিখেছেন – ‘অনেক বিক্ষেপ ও বিশৃঙ্খলা ও সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে, উদ্যমের অনেক অপব্যয় ও আবেগের ব্যর্থতা পেরিয়ে, ধীরে-ধীরে আমার অনুভূতি হলো যে, সব গতি ও প্রগতি ও পতন ও বিতর্কের পরে অবশেষে কোনো-এক গভীর রাত্রে নিজের মধ্যে নিবিষ্টতা ভালো।’
কেন এই উপলব্ধি? নিজের বর্ণিল অভিজ্ঞতা থেকে বুদ্ধদেব বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাহিত্যচর্চাই তাঁর স্বধর্ম। অন্য কোনো ধর্ম তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। সেজন্যই নিজের মধ্যে নিবিষ্ট হওয়া একজন সৎ সাহিত্যিকের অবশ্যকর্তব্য। এই নিবিষ্টতা বুদ্ধদেব শুধু নিজের মধ্যে ধারণ করেননি, সমকালীন সাহিত্যিকদের মধ্যেও সঞ্চারিত করেছেন। একটি ভালো কবিতা বা গদ্যের যাত্রাপথকে মসৃণ করার দায়িত্বটি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন তিনি। বুদ্ধদেবের ঋষিতুল্য নিষ্ঠার উজ্জ্বল ফসল তিরিশ ও চল্লিশ দশকের বাংলা কবিতা। সেই সময়ের প্রায় সব কৃতী কবিকে লালন করেছে কবিতা পত্রিকা। লালন শব্দটির তাৎপর্য অসাধারণ – শুধু কবিতা ছাপিয়ে বুদ্ধদেব দায়িত্ব শেষ করতেন না। পছন্দের কবিকে নিয়ে একের পর এক গদ্য লেখানোতে তিনি ছিলেন অক্লান্ত। এভাবেই কবিতা পত্রিকার পাতায় পাতায় সেই সময়ের সাহিত্যের ঐশ^র্যরাশি সঞ্চিত হয়েছে।
সাহিত্যের প্রত্যেক শাখায় অসাধারণ অবদান রাখলেও বুদ্ধদেব বসুর জীবন সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত ছিল কবিতায়। কবি ও কবিতাকর্মী হিসেবে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ‘কবিতা ও আমার জীবন’ প্রবন্ধের সূচনায় তিনি বলেছেন – যা লিখছি তা ভালো হবে কি হবে না, তা পুরোপুরি দৈবের ওপর নির্ভর করছে, আমি ভাগ্যের গাঙে গা ভাসিয়ে চলেছি। যেটা উৎরে গেলো সেটার জন্য আমার কোনো দায়িত্ব নেই, সত্যি বলতে; বই ছাপানোর সময় আমি যে রাশি-রাশি জঞ্জাল থেকে ঠিক কবিতাগুলোকে বেছে নিতে পেরেছিলাম, আমার কৃতিত্ব সেটুকুই।
এই প্রবন্ধে অপূর্ব ভাষায় নিজের কবিজীবনের বিবর্তনকে উপস্থাপন করেছেন বুদ্ধদেব। জগতের শ্রেষ্ঠ কবিদের কবিতা তাঁকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। এভাবেই কবি ও অনুবাদক হিসেবে তিনি সিদ্ধি অর্জন করেছেন। তিনি অনুভব করেছেন কবিতার জন্মকথা কখনো জানা যায় না – কবিতার জন্মকথা সম্পূর্ণরূপে অনাবৃত হয় না কখনো, তার একটা অংশ চিরকাল গোপন থেকে যায় – আর সেই অংশটাই আসল। কোনো কবিতা যেদিন উপ্ত হ’লো, তারপর থেকে কতকাল তার গর্ভবাস চলবে, এমনকি সেটি আদৌ কখনো ভূমিষ্ঠ হ’তে পারবে কিনা, এই মোটা হিশেবটাও কোনো বিজ্ঞান ক’ষে উঠতে পারে না, কবির নিজের পক্ষেও তা ধারণাতীত।
বুদ্ধদেব বসু ছিলেন সর্বসত্তানিমগ্ন সাহিত্যিক। আত্মজীবনীমূলক রচনা তাঁর নিষ্ঠাবান সাহিত্য সাধনার অমূল্য দলিল। মনে রাখতে হবে, বুদ্ধদেব বসু একটি সম্পূর্ণ জীবন ব্যয় করেছেন শুধু নিজের সাহিত্যসাধনার জন্য নয়; আরো অনেককে সাহিত্যিক হতে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন, তাঁদের প্রতিভার পরিচর্যা করেছেন। বলতে পারি, আত্মকথার দর্পণে এক ঋষিতুল্য সাহিত্যসাধকের উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে।
*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় কালি ও কলম-এ, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।