By সজীব সরকার
অ্যাকটিভ লিসেনিংয়ের জন্য দরকারি দক্ষতা
Media School January 23, 2025
প্রতীকী ছবি।
সক্রিয় শ্রবণ বা অ্যাকটিভ লিসেনিং (Active Listening) এক ধরনের সক্ষমতা। আর, এ সক্ষমতা মূলত অনেকগুলো দক্ষতার সমষ্টি বা যোগফল।
অ্যাকটিভ লিসেনার (Active Listener) বা সক্রিয় শ্রোতা হতে যেসব দক্ষতা অবশ্যই অর্জন করতে হবে, এর মধ্যে জরুরি কয়েকটি হলো :
১. অখণ্ড মনোযোগ দিতে পারা : আলোচনার সময় মনোযোগ হারিয়ে ফেলা যাবে না। পুরো সময় ধরে সর্বোচ্চ মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনতে পারার সক্ষমতা থাকতে হবে।
২. অবাচনিক ইঙ্গিতগুলো বুঝতে পারার সক্ষমতা : একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে মানুষ সারাদিনে যতো যোগাযোগ করে, এর সবচেয়ে অংশই আসলে অবাচনিক (non-verbal); অর্থাৎ, মুখসহ সারা শরীরের নানা অঙ্গভঙ্গি। তাই, কেবল মুখের ভাষা বা বাচনিক (verbal) যোগাযোগের দিকে মনোযোগ দেওয়া হলে কারো বার্তার একটা বড় অংশই আমরা হয়তো বুঝতে পারবো না।
এ কারণেই, শারীরিক ভাষা সম্বন্ধেও যথেষ্ট জ্ঞান ও তা বুঝতে পারার মতো দক্ষতা অর্জন করাও সফল যোগাযোগের একটি বড় শর্ত।
৩. ফিডব্যাক দেওয়ার অভ্যাস তৈরি করা : আলোচনা পুরোটাই একমুখী হওয়া ঠিক নয়। মাঝে-মধ্যে ফিডব্যাক (feedback) বা প্রত্যুত্তর দিতে হবে। ফিডব্যাক দিলে বক্তার মধ্যে আস্থা তৈরি হয় যে তার কথাগুলো শোনা হচ্ছে এবং আগ্রহ নিয়েই তার সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি, ফিডব্যাক দিলে নিজেও বোঝা যায় যে বক্তার কথাগুলো শ্রোতা ঠিকমতো বুঝতে পারছে কি না।
তবে, অনেকেই আবার অন্যের কথার মাঝখানে অকারণ বারবার কথা বলে। একজন বক্তার জন্য এটি খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। কথা বলার মাঝখানে অহেতুক বারবার ছেদ পড়লে যে-কেউ বিরক্ত হওয়া স্বাভাবিক। এতে আলোচনার স্বাভাবিক গতিতে ছন্দপতন ঘটে। এতে আলোচনা ব্যর্থও হতে পারে। কাজেই, ফিডব্যাক দেওয়ার জন্য এর উপযুক্ত সময় ও মাত্রার ব্যাপারে সচেতনতা থাকা জরুরি।
৪. আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা থাকা : মানবীয় আবেগ সম্বন্ধে সার্বিক ও স্পষ্ট ধারণা থাকা এবং প্রয়োজনমতো সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবহার করতে জানাই হলো আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (Emotional Intelligence)। কথোপকথনের সময় নিজের ও অন্যের আবেগগুলো সম্বন্ধে সচেতন থাকা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারার দক্ষতাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
৫. আলোচনার সময় নিজের ভূমিকা সম্বন্ধে সচেতনতা থাকা : আলোচনা একমুখী বা একঘেয়ে হচ্ছে কি না, বক্তার কথা শ্রোতা বুঝতে পারছে কি না, শ্রোতা কি বক্তাকে নিজের আন্তরিকতার ব্যাপারে নিশ্চিত করতে পারছে কি না - এ বিষয়গুলো সম্বন্ধে সবসময় সচেতনতা থাকলে সক্রিয় শ্রোতা হওয়া সহজ।
৬. মুক্ত আলোচনায় বিশ্বাসী হওয়া : আলোচনা যেন অকারণ একটি নির্দিষ্ট দিকেই ধাবিত না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। আলোচনার সময় নতুন নতুন তথ্য ও ধারণাকে যুক্ত করতে পারাও জরুরি। আগের ধারণাকে অহেতুক জিইয়ে রেখে কেবল সেটিরই আলোকে ধাবিত না হয়ে কথোপকথনে নতুন নতুন তত্ত্ব, তথ্য, ধারণা বা বিষয়ের অবতারণা এবং সেগুলোকেও আলোচনায় যুক্ত করে সার্বিক ও ফলপ্রসূ আলোচনা সম্ভব হতে পারে। একজন শ্রোতার মধ্যে এ উদারতা (openness) থাকা দরকার।
৭. সহনশীলতা থাকা : আলোচনার সময় শ্রোতার নিজের জ্ঞান, ধারণা বা বিশ্বাস যে সবসময় সবার সঙ্গে মিলবে, এমনটি নিশ্চয়ই হবে না। আর, নিজের মতের সঙ্গে না মিললেই আলোচনা আর এগোবে না - এমন হওয়াটা একেবারেই অনুচিৎ। ভিন্নমত থাকবে - এটি মেনে নিতে হবে। দ্বিমত থাকলেই সংঘাত হতে হবে - এমন হওয়াটা গ্রহণযোগ্য নয়। পরমতসহিষ্ণুতা (tolerance) থাকা খুব জরুরি। মতের ভিন্নতা থাকার পরও দুজন ব্যক্তির মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনা হতে হবে। ভিন্নমতের দুজন মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবেন - এটিই সভ্য মানুষের লক্ষণ।
৮. নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করতে পারা : কারো সঙ্গে কথোপকথনের সময় তার বলা নানা ঘটনা বা অভিজ্ঞতার সঙ্গে শ্রোতার অভিজ্ঞতার মিল থাকলে সেগুলো শেয়ার করার প্রবণতা থাকা ভালো। এতে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়ে। দুজনের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস বাড়ে। বক্তা সহজেই শ্রোতাকে বিশ্বাস করতে পারে এবং নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সেগুলো তুলনা করে দেখতে পারে। শ্রোতা যে আন্তরিক, এ বিশ্বাসও বাড়ে।
৯. অহেতুক 'বিচারকের' ভূমিকা না নেওয়া : কথোপকথনের সময় অকারণ জাজমেন্টাল (judgmental) হয়ে ওঠা বা দোষ-গুণ বিচার শুরু করা ঠিক নয়। মানুষ অনেক সময় নিজের বক্তব্যটুকু প্রকাশ করতে চায় কেবল আলোচনার তাগিদেই এবং কোনো ধরনের আক্রমণের শিকার না হয়ে। এ অবস্থায় তার কথাটুকু শোনাই শ্রোতার একমাত্র কাজ হওয়া উচিৎ; ভালো-মন্দ বিচার করা নয়।
ধরা যাক, আপনার বন্ধুর একটা পরীক্ষা খারাপ হলো। এটি নিয়ে সে খুব মানসিক চাপেও ভুগছে। আপনার সঙ্গে সে এ নিয়ে কথা বলতে চাইছে নিজের মনের চাপ কমাতে। এখন, আপনি মারমুখী হয়ে উঠলেন এভাবে- 'তোমার নিজের দোষেই তো এ অবস্থা... আগেই বলেছিলাম, ভালো করে পড়ো... অমুক তো ঠিকই ভালো করলো, তুমি তো পারলে না...'। এমন আচরণ একেবারেই ঠিক নয়। আপাতত তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন; তাকে সাহস দিন, ভরসা দিন। তার ভুল-ত্রুটিগুলো পরে একটা সময়ে আলাদা করে বুঝিয়ে বলুন।
১০. শ্রোতা কী চায়, তা বুঝে প্রত্যুত্তর দেওয়া বা প্রতিক্রিয়া দেখানোর চর্চা : একজন ব্যক্তির সঙ্গে আপনার কথোপকথন হচ্ছে। আগে বুঝে নিন- তিনি আপনার কাছে কী চান। শুধু মনোযোগ দিয়ে তার কথাগুলো শুনবেন? মুক্তভাবে আলোচনা করবেন? বিকল্প পথ দেখাবেন? সমস্যার সমাধান দেবেন? তার সিদ্ধান্ত বা অবস্থান ঠিক না ভুল - তার বিচার করবেন? - বক্তা একজন শ্রোতার কাছে ঠিক কী চান, সেটি আগে ভালোমতে বুঝে এরপরই প্রত্যুত্তর করা উচিৎ।
১১. বুঝতে না পারলে আবারো জিজ্ঞেস করার প্রবণতা : বক্তার কথাগুলো শ্রোতা ঠিকমতো বুঝতে পারছে কি না, এটি নিশ্চিত হওয়া দরকার। এজন্য একজন শ্রোতার উচিৎ বক্তার কথা বা বার্তা তিনি যা বুঝলেন, বক্তাকে সেটি আবার বুঝিয়ে বলা। এতে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে বক্তার কথাগুলো শ্রোতা ঠিকমতো বুঝেছেন কি না। তাহলে আর ভুল বোঝাবুঝির কোনো সুযোগ থাকবে না।
১২. সমানুভূতি থাকা : সর্বোপরি, একজন শ্রোতার মধ্যে অবশ্যই সমানুভূতির (empathy) গুণটি থাকতে হবে। সমানুভূতির বোধ না থাকলে সত্যিকার অর্থে বক্তার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া বা আন্তরিকভাবে আলোচনায় অংশ নেওয়া ও তাকে তার মতো করে বোঝার সুযোগ তৈরি হয় না।
এমন গুণ বা দক্ষতা দীর্ঘ চর্চার মাধ্যমে নিজের মধ্যে তৈরি করা সম্ভব। আর, এগুলোই শেষ কথা নয়; মানবিক এমন আরো অনেক গুণ বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা একজন ভালো, আন্তরিক বা সক্রিয় শ্রোতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে।