By রাজীব সরকার
অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাঙালিত্ব সাধনা
Media School June 22, 2020
অন্নদাশঙ্কর রায় [১৫ মে ১৯০৪-২৮ অক্টোবর ২০০২]/ছবি : উইকিপিডিয়া
রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ দুই দশকে যে তরুণ সাহিত্যিকদের রচনায় বাংলা সাহিত্যভাণ্ডার ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়েছিল অন্নদাশঙ্কর রায় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাংলার রেনেসাঁসের শেষ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত অন্নদাশঙ্কর ছাত্র ও পেশাগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত কৃতী, সৃজনশীল ও মননশীল উভয় ধারায় সফল সাহিত্যিক এবং নান্দনিক ও মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ মনীষী। তাঁর সাহিত্য সাধনায় ভারতীয় সংস্কৃতি ও ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের সমন্বয় ঘটেছিল। ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটাতে দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে তিনি প্রাচ্যের সঙ্গে প্রতীচ্যের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। বিশ্বনাগরিক হয়েও পরম ভালোবাসায় লালন করেছেন আবহমান বাংলার সংস্কৃতিকে। এ কারণে তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি গান্ধীর সত্যাগ্রহ ও লালনের মরমি দর্শনের প্রতি তার অনুরাগ ছিল লক্ষণীয়।
অন্নদাশঙ্করের চিন্তাজগতের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ধারা বিশেষত তৎকালীন পূর্ববঙ্গের আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্য। তাঁর স্মৃতিচারণমূলক রচনায়, প্রবন্ধসম্ভারে বারবার উঠে এসেছে পূর্ববাংলার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম অনুরাগ। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগকে তিনি কখনোই মেনে নেননি। ছড়া-কবিতায় মর্মান্তিক দেশ ভাগের বিরুদ্ধে শানিত হয়ে উঠেছে তাঁর কলম। মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের মানুষের অকৃত্রিম সুহৃদের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। তদানীন্তন পূর্ববাংলার প্রতি অন্নদাশঙ্করের ভালোবাসার উন্মেষ ঘটেছিল কর্মসূত্রে। সর্বভারতীয় সিভিল সার্ভিস প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে তিনি ইংল্যান্ডে দু'বছরের প্রশিক্ষণ লাভের জন্য কাটান। তখনই 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তাঁর কলামে প্রকাশিত 'পথে প্রবাসে' বিদগ্ধ সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেখান থেকে ফিরে তিনি পদায়নের জন্য বেছে নেন অবিভক্ত বাংলাকে। নওগাঁ, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা ও ময়মনসিংহে চাকরিসূত্রে বহুদিন অবস্থান করেন অন্নদাশঙ্কর। ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য তখন ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। মহকুমা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, জেলা প্রশাসক এবং জজিয়তির কর্মসূত্রে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন বাংলার হিন্দু-মুসলমানের অন্তর্জগৎ এবং প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ভূমিকার পালাবদলও প্রত্যক্ষ করেছেন।
তখনকার দিনে হিন্দুরা বলত, 'আমরা বাঙালি, ওরা মুসলমান।' আর মুসলমানরা বলত 'আমরা মুসলমান, ওরা বাঙালি।' উভয়পক্ষ বাংলায় কথা বলার পরও কেন এই বিভাজন তা ভেবে অন্নদাশঙ্কর ব্যথিত হয়েছেন। স্ত্রী লীলা রায়ের বান্ধবী সুলতানার উদাহরণ দিয়েছেন তিনি। বাংলাভাষী সুলতানা তখন বলত, 'আমার অনেক বাঙালি বন্ধু আছে।' তার মানে সে নিজে বাঙালি নয়, মুসলমান। পাকিস্তান সৃষ্টির পর সুলতানার পরিবার ঢাকায় চলে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর অন্নদাশঙ্কর যখন ঢাকায় যান, তখন সুলতানা নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেয়। এ ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি 'জীবন যৌবন' বইয়ে-
'শুধু সুলতানা কেন, বাংলাদেশের সব মুসলমানই তখন বাঙালি। এর জন্য দরকার ছিল উর্দুভাষী মুসলমানদের সঙ্গে বৈসাদৃশ্য ও বাংলাভাষী হিন্দুদের সঙ্গে সাদৃশ্য উপলব্ধি। বাংলাদেশে আজকাল বাঙালি জাতি কথাটাই শুনতে পাওয়া যায়, মুসলিম জাতি নয়। তবে তার সঙ্গে যুক্ত হয় মুসলিম ধর্ম বা হিন্দু ধর্ম। এই জ্ঞানটা আগে হলে হয়তো দেশ ভাগটাই হতো না।' অন্নদাশঙ্করের এই উপলব্ধির সঙ্গে দ্বিমত পোষণের কি কোনো কারণ রয়েছে?
দুই.
রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ছিলেন অন্নদাশঙ্কর। রবীন্দ্রনাথকে তিনি ভিন্নরূপে আবিস্কার করেন নওগাঁর মহকুমা প্রশাসক থাকার সময়। রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্যতম সৃষ্টিশীল ও জনহিতৈষী পর্ব কেটেছে নওগাঁর পতিসরে। একবার আত্রাই ঘাটে রবীন্দ্রনাথের অভ্যর্থনায় যান তিনি। স্টেশনের পল্গ্যাটফর্মে দুটি চেয়ারে পাশাপাশি বসে তারা কলকাতাগামী ট্রেনের প্রতীক্ষা করেন। শতাধিক বৃদ্ধ মুসলমান রবীন্দ্রনাথকে বিদায় জানাতে আসেন। তাদের কেউ কেউ অশ্রুসিক্ত। রবীন্দ্রনাথ একান্তে অন্নদাশঙ্করকে বললেন, 'ওরা কী বলেছে, জানো? বলেছে আমরা পয়গম্বরকে চোখে দেখিনি, আপনাকে দেখলুম।' অন্নদাশঙ্করের পর্যবেক্ষণ-
'রবীন্দ্রনাথের মুখে পীরের মতো দাড়ি, পরনে পীরের মতো আলখাল্লা, দেখলে পীর বলে ভ্রম হয়। পীরালি ব্রাহ্মণ বংশে তার জন্ম। মুসলমানরা যদি তাঁকে আপনার বলে মনে করে তা হলে আশ্চর্যের কী আছে !'
নওগাঁতেই অন্নদাশঙ্কর পরিচিত হন স্কুল সাব-ইন্সেপেক্টর মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিনের সঙ্গে। প্রখ্যাত এই লোকসংগীত সংগ্রাহকের অন্যতম অবদান 'হারামনি'। লোকসংস্কৃতির প্রতি দুর্বলতার কারণে অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে মনসুর উদ্দীনের। 'নওগাঁর স্মৃতি ও অন্নদাশঙ্কর' শীর্ষক রচনায় মনসুর উদ্দীন উল্লেখ করেছেন লোকসংস্কৃতির বিকাশে অন্নদাশঙ্করের ভূমিকার কথা। তাঁর আমন্ত্রণে ইংল্যান্ডের সুপণ্ডিত বাকে দম্পতি পল্লী সংগীত রেকর্ড করার জন্য নওগাঁয় আসেন। নওগাঁয় নানা অঞ্চল থেকে অনেক গায়ক-গায়িকা এসে গান রেকর্ড করেন। হঠাৎ এক ভোর বেলায় একটি গান অন্নদাশঙ্করকে বিমোহিত করে। সেই গানের চরণগুলো সুবিখ্যাত- 'প্রেম করো মন প্রেমের মর্ম জেনে।/প্রেম করা কি কথার কথারে, গুরু লহ চিনে।/চণ্ডীদাশ আর রজকিনী তারাই প্রেমের শিরোমণি।/এক মরণে দুজন মলোরে প্রেমপূর্ণ প্রাণে।'
নওগাঁয় থাকতেই অন্নদাশঙ্কর পূর্ব বাংলার মাটি, মানুষ, নদী, প্রকৃতির প্রেমে পড়েন। এই প্রেম আরও গাঢ় হয়ে ওঠে কুষ্টিয়ায় মহকুমা হাকিমের দায়িত্ব পালনের সময়। কুষ্টিয়ার প্রতি তিনি ভালোবাসা লালন করেছেন আমৃত্যু। 'জীবন যৌবন' গ্রন্থে তাঁর অন্তরঙ্গ ভাষ্য-
'আমরা কুষ্টিয়ায় যত সুখী ছিলুম আর কোথাও অত সুখী ছিলুম না। আমি তো ভেবেছিলুম অকালে অবসর নিয়ে কুষ্টিয়াতেই বসবাস করব। সেই মহকুমাতেই রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ আর লালন ফকিরের ছেঁউড়িয়া। আমার মতে রাজশাহী, পাবনা ও কুষ্টিয়াই হচ্ছে সারা বাংলার হৃদয় ভূমি।'
শুধু 'জীবন যৌবন' নয়, 'যুক্তবঙ্গের স্মৃতি', 'লালন ও তার গান', 'বিদগ্ধ মানস'- এই বইগুলোতেও পূর্ববাংলা ও এর প্রকৃতি-সংস্কৃতির প্রতি অন্নদাশঙ্করের তীব্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। 'যুক্তবঙ্গের স্মৃতি' বইয়ে তাঁর আন্তরিক অভিব্যক্তি-
'পূর্ববঙ্গে যতবার বদলি হয়েছি, কোনোবার খুশি হয়ে যায়নি, কিন্তু গিয়ে খুশি হয়েছি বার বার। বিধাতার মনে কী ছিল সে বয়সে বুঝতে পারিনি, এখন বুঝি আর ধন্যবাদ দিই। একালের সরকারি কর্মচারীরা আমার মতো বদলির দুঃখ পাবেন না, কিন্তু সুখও পাবেন না বাংলার মুখ দেখার। যে মুখ পদ্মার ওপারে বিচিত্র সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত। মানুষও কি কম বিচিত্র, কম সুন্দর! আমি তো মনে করি ওরা আরও অকপট, আরও অকৃত্রিম, আরও দিলখোলা, আরও তেজী। ওদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা একটা দুর্লভ সুযোগ।'
তিন.
ঢাকায় তিনি অন্তরঙ্গভাবে মিশেছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সঙ্গে। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ও বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে তাদের অবদানের উচ্চ মূল্যায়ন করেছেন তিনি। কর্মসূত্রে পূর্ববাংলার সঙ্গে স্থাপিত তাঁর অন্তরের যোগের কারণেই কখনও তিনি মেনে নিতে পারেননি দেশভাগকে। সেই মুহূর্তে তার আবেগাকুল উপলব্ধি ছবি হয়ে উঠেছে 'জীবন যৌবন' এর শেষ ভাগে-
'...ছিন্ন হয়ে গেল পূর্ববঙ্গের সঙ্গে আমার এতদিনের প্রশাসনিক সম্পর্ক। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বলতে যাকে বোঝায় তা পূর্ববঙ্গই। সোনার বাংলা যাকে বলা হয় সে-ও পূর্ববঙ্গ। হায়, সেখানে আমি বিদেশি।'
দেশ ভাগের রক্তাক্ত যন্ত্রণা থেকেই তিনি লিখে ফেলেন অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা যা শিক্ষিত বাঙালির মনে দাগ কেটেছে- 'তেলের শিশি ভাঙলো বলে/খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যেসব বুড়ো খোকা/ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো, তার বেলা?' বাংলা ভাগের বেদনা থেকেই জন্ম নিয়েছে নজরুলকে নিয়ে তাঁর অনন্য ছড়া- 'ভুল হয়ে গেছে বিলকুল-/আর সবই কিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নি কো নজরুল।/এই ভুলটুকু বেঁচে থাক,/বাঙালী বলতে একজন আছে- /দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।'
সাহিত্যচর্চায় অধিকতর আত্মনিয়োগ করার জন্য অন্নদাশঙ্কর স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন ১৯৫১ সালে। শান্তিনিকেতনে বসবাস শুরু করেন। সেখানে সাহিত্য মেলা আয়োজন করে পূর্ব বাংলার সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানান। আজীবন তিনি সচেষ্ট ছিলেন দুই বাংলার সেতুবন্ধ গড়তে। খাঁটি বাঙালি অন্নদাশঙ্কর ছিলেন হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার সংশপ্তক যোদ্ধা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কলকাতার শিল্পী, সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের অন্তিমপর্বে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচনা করেন চিরভাস্বর কবিতা-
'যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।'
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর এই কবিতাটি অধিকতর তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। পরবর্তী দুই দশকে বঙ্গবন্ধুবিরোধী অব্যাহত প্রচারণার পরও বাঙালির হৃদয় থেকে মুছে যাননি বঙ্গবন্ধু। তার পঙ্ক্তিই শাশ্বত হয়ে ওঠে- 'ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।' বিংশ শতাব্দীর সমান বয়সী অন্নদাশঙ্করের কর্মজীবন ও সাহিত্য জীবনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে বাঙালিত্বের প্রতি তার অকৃত্রিম অনুরাগ ও বাংলাদেশের জন্য নিখাদ ভালোবাসা। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বনাগরিক হওয়ার শর্ত হিসেবে কায়মনোবাক্যে বাঙালি হওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। বিশ্বনাগরিক হওয়ার শর্ত হিসেবেই অন্নদাশঙ্কর কায়মনোবাক্যে বাঙালি হয়েছিলেন। তাঁর বাঙালিত্ব সাধনার এটিই ছিল মূলমন্ত্র।
রাজীব সরকার : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।
[লেখাটি দৈনিক সমকাল (কালের খেয়া)-এ ২৫ অক্টোবর ২০১৯ প্রকাশিত হয়। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।]