By রাজীব সরকার
নজরুল ও বাঙালির সমন্বয়বাদী ঐতিহ্য
Media School May 25, 2021
নজরুলের প্রকৃত পরিচয় অনুধাবন করতে হলে বাঙালি সংস্কৃতির বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে তাঁকে বিবেচনা করতে হবে।
'বিদ্রোহী কবি' ও 'জাতীয় কবি' বলে যিনি বহুল বিজ্ঞাপিত, সেই কাজী নজরুল ইসলামের উপযুক্ত মূল্যায়ন এখনো আমরা করতে পারিনি। ব্রিটিশ শাসনামলে যিনি 'কাফের' আখ্যায়িত হয়েছিলেন, মুনশী রেয়াজুদ্দীন আহমেদ যাকে সন্দেহ করে বলেছিলেন, 'লোকটি মুসলমান না শয়তান?' সেই নজরুলকে পাকিস্তান আমলের শেষ পর্বে 'হিন্দু কবি রবীন্দ্রনাথ' এর বিপরীতে 'মুসলমান কবি'র তকমা দেওয়া হয়। শুধু দৈহিকভাবে নয়, চৈতন্যের দিক থেকেও যদি নজরুল তখন জীবিত থাকতেন তবে তাকে নিয়ে এসব তুঘলকিকাণ্ডে তিনি যে ক্ষুব্ধ হতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক যতীন সরকার দেখিয়েছেন সামগ্রিক নয়, খণ্ডিত মূল্যায়নের শিকার হয়েছেন নজরুল। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদী, হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী, মার্কসবাদী- প্রত্যেকেই নিজের সুবিধামতো নজরুলকে খণ্ডিত করেছেন। অখণ্ড নজরুল তাদের জন্য বিব্রতকর। নজরুলের সামগ্রিক তথা প্রকৃত পরিচয় উদঘাটন ব্যতীত এই কীর্তিমান শিল্পীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র।
নজরুলের প্রকৃত পরিচয় অনুধাবন করতে হলে বাঙালি সংস্কৃতির বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে তাঁকে বিবেচনা করতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস হাজার বছরের। এ অঞ্চলের জীবনাচরণে, সংগীতে, সাহিত্যে, চিত্রকলায়, ভাস্কর্যে, নাটকে বাঙালি সংস্কৃতির ঔজ্জ্বল্য প্রতিফলিত। বাঙালি সংস্কৃতির ধারা গত কয়েকশ' বছরে বিশেষ কোনো ছকে রূপান্তরিত হয়েছে এমন বলা যাবে না। বিভিন্ন মত-পথ-পন্থা, তান্ত্রিকতা, সুফিবাদ ও মূল ধর্মসমূহের আদর্শগত দ্বন্দ্ব-বিরোধ এবং কেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে বিশাল গ্রামীণ জনপদে গ্রহণ-বর্জন সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে একটি মূলধারা ও পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। এই সংস্কৃতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর সমন্বয়ধর্মী ধারা। শুধু সমন্বয়ধর্মী নয়, মানবতাবাদীও। বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর থেকে ইসলাম ধর্ম এখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেতে শুরু করে। দেশজ সংস্কৃতি ও ইসলাম পরস্পরের পরিপূরক হয়েছে। পাঠান রাজত্বে এদেশের ভাষা ও সংস্কৃতি পৃষ্ঠপোষকতা পায়। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের শাসনামলে এদেশের ভাষা, সাহিত্য সমাদৃত হয় এবং দেশীয় পণ্ডিত কবিবৃন্দ পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেন। এ সময় যথার্থ অর্থেই একটি সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির উত্থান ঘটে। একদিকে শ্রীচৈতন্যের ভক্তিবাদ ও ভালোবাসার বাণী এবং অন্যদিকে সুফি সাধকদের মানবতাবাদী মতবাদ- এই দুইয়ের সংমিশ্রণে এক অসামান্য সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছিল। এভাবে আমাদের সংস্কৃতিতে সকল ধর্মের ও নানা লোকধর্মের চিন্তা-চেতনার মানবিক অন্তঃসারযুক্ত হওয়াতে এই ধারাটি প্রাণবন্ত ও গতিশীল হয়ে ওঠে। এই ধারাটির প্রকাশবাহন হয়ে ওঠে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ভাষা নির্মাণের বুলি- আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। সমাজজীবন ও ভাষার এই মেলবন্ধনের মধ্যেই বাঙালির স্বকীয় জীবনঘনিষ্ঠ ও গভীরভাবে মানবিক এক সংস্কৃতি বিরাজমান। এই সংস্কৃতি বাঙালি হিন্দুর নয়, বৌদ্ধের নয়, খ্রিষ্টানের নয়, মুসলমানের নয়- এই সংস্কৃতি সকল বাঙালির সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির ভিত্তি আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।
বাঙালি সংস্কৃতির এই সমন্বয়বাদিতা ও লৌকিক ঐতিহ্য নজরুলের কবি মানস তৈরি করে দিয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও যে নজরুল বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদী নির্যাসটুকু তাঁর চৈতন্যে ধারণ করেছিলেন তা দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে আমাদের। বাল্যকালেই লেটো গানে হাতেখড়ি হয় নজরুলের। বাংলার লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রকরণ লেটো লোককবিতা সমন্বয়ধর্মী বাঙালি ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের ধারক। সেই ঐতিহ্যকে ধারণ করে তিনি লেটোর জন্য যেমন লিখেছেন, কারবালার শোকাতুর ঘটনা নিয়ে পালা, তেমনি লিখেছেন 'মেঘনাদবধ' পালা। ইসলামী ঐতিহ্য ও হিন্দুপুরাণ উভয় উৎস থেকেই নজরুল সৃষ্টির উপকরণ গ্রহণ করেছেন বাল্যকালেই।
বাঙালি সংস্কৃতির গ্রহণ ও আত্তীকরণের ক্ষমতা অসামান্য। বাইরের ভাষার বহুশব্দ ও সাংস্কৃতিক উপকরণ বাঙালি সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছে। উত্তর ভারতে সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণ-মহাভারত ও পুরাণ থেকে রাম-সীতা, রাধা-কৃষ্ণের মতো চরিত্র বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে গেছে। আরব-পারস্যের কাহিনি ঐতিহ্যও সমাদৃত হয়েছে দোভাষী পুঁথিতে যা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, শিরি-ফরহাদ বাঙালি সংস্কৃতিতে মর্যাদা পেয়েছে ঘরের মানুষের মতো।
বাঙালি সংস্কৃতির এই আত্তীকরণের গুণটি নজরুল সাহিত্যে যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সেভাবে আর কারো সাহিত্যে হয়নি। অপ্রতিম নৈপুণ্যে তিনি আরবি-ফারসি শব্দের সমাবেশ ঘটিয়েছেন তাঁর রচনায়। একই সঙ্গে শ্যামাসঙ্গীত, বৈষ্ণবপদ ও হামদ-না'ত-ইসলামী সঙ্গীত রচনায় যে পারদর্শিতা নজরুল দেখিয়েছেন তা নজিরবিহীন। এমনকি অভিন্ন চিত্রকল্প চাঁদ-সূর্য দিয়ে তিনি শ্যামাসংগীত ও না'ত নির্মাণ করেছেন 'বনগীতি' ও 'জুলফিকার' শিরোনামে।
নজরুলের এই অদ্বিতীয় প্রতিভার তাৎপর্য বহুমাত্রিক লেখক বুদ্ধদেব বসু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। ত্রিশের আধুনিক কবিদের দলপতি বুদ্ধদেব বসু লক্ষ করেছেন-
"... সত্যেন্দ্রনাথকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথেরই সংলগ্ন, কিংবা অন্তর্গত, আর নজরুল ইসলামকে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের পরে অন্য একজন কবি-ক্ষুদ্রতর নিশ্চয়ই, কিন্তু নতুন। ... কবিতার যে-আদর্শ নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, নজরুলও তা-ই, কিন্তু নজরুল বৈশিষ্ট্য পেয়েছিলেন তাঁর জীবনের পটভূমিকার ভিন্নতায়। মুসলমান তিনি, সেইসঙ্গে হিন্দু মানসও আপন করে নিয়েছিলেন- চেষ্টার দ্বারা নয়, স্বভাবতই। তার বাল্য-কৈশোর কেটেছে শহরে নয়, মফস্বলে; স্কুল-কলেজে 'ভদ্রলোক' হবার চেষ্টায় নয়, যাত্রাগান লেটোগানের আসরে; বাড়ি থেকে পালিয়ে রুটির দোকানে, তারপর সৈনিক হয়ে। এই যেগুলো সামাজিক দিক থেকে তাঁর অসুবিধা ছিল, এগুলোই সুবিধা হয়ে উঠলো যখন তিনি কবিতা লেখায় হাত দিলেন। যেহেতু তাঁর পরিবেশ ছিল ভিন্ন, এবং একটু বন্য ধরনের, আর যেহেতু সেই পরিবেশ তাঁকে পীড়িত না- করে উল্টো আরো সবল করেছিল তাঁর সহজাত বৃত্তিগুলোকে, সেই জন্য, কোনোরকম সাহিত্যিক প্রস্তুতি না নিয়েও শুধু আপন স্বভাবের জোরেই রবীন্দ্রনাথের মুঠো থেকে পালাতে পারলেন তিনি, বাংলা কবিতায় নতুন রক্ত আনতে পারলেন।"
এই নতুনত্বই নজরুল কাব্যের বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের সক্ষম ও অক্ষম অনুকারকেরা কাব্যক্ষেত্রে যে ভাবালুতার পরিচয় দিয়েছিলেন তার থেকে একটি পৃথক কাব্যধারা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল। কালের সেই প্রয়োজন নজরুল মেটালেন, সমাজ ও কাব্য উভয়ের দিক দিয়ে। পৃথিবীকে পরিবর্তন করার কথা তিনি বললেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সংকটে পীড়িত, ধর্মীয় অনাচার ও পরাধীনতার নাগপাশে জড়িত মানুষ যা শুনতে চেয়েছিল, নজরুল তাই শোনালেন। এভাবেই তাঁর কবিতা জনমন স্পর্শ করল, তিনি অর্জন করলেন অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা।
বিশাল ভারতবর্ষে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষজনের বাস। সম্প্রদায়গত বৈচিত্র্য কম নয়। বংশপরম্পরায় এরা পাশাপাশি বাস করছে। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে পারস্পরিক সম্প্রীতি রক্ষা করে চলাই হতো আদর্শ। কিন্তু মাঝেমধ্যে সেই সম্প্রীতি চিড় খায়। সাম্প্রদায়িকতা বোধ প্রবল হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে আছে সংকীর্ণতা, ভেদবুদ্ধি, স্বার্থপরতা। নজরুল তাই সাম্প্রদায়িকতার ঘোরবিরোধী। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি যে সমাজকে দুর্বল করে, মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবধান বাড়ায়, নজরুল সে সর্ম্পকে পুরোমাত্রায় সচেতন ছিলেন।
নজরুল অনুভব করেছিলেন যে বিদেশি শাসক, মতলববাজ রাজনীতিবিদ এবং সুচতুর মোল্লা-পুরোহিতের দল উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস, ঘৃণা ও অবজ্ঞা জিইয়ে রাখতে চায়। এর ফলে দেশের সংহতি ও ঐক্য বিনষ্ট হয়। নজরুল এই বিভেদ-বিরোধের অবসান ঘটাতে চেয়েছেন। দুটি সম্প্রদায়কে কাছাকাছি আনতে চেয়েছেন। 'মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান'- এই ছিল তাঁর উপলব্ধি। প্রচলিত ধর্মতন্ত্রের বিরোধী নজরুল, মানবধর্মের জয়গানে মুখরিত তাঁর কাব্যসম্ভার। 'বিংশ শতাব্দী' কবিতায় ঘোষণা করেন- "কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা,/ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা।/ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ,/ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/এক মানবের একই রক্ত নেশা।/কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা!"
১৯২৬-এর ২২ মে কৃষ্ণনগরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির বার্ষিক সম্মেলনে নজরুল যে উদ্বোধন সংগীত পরিবেশন করেন, তাতেও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। 'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার' সেই সংগীত। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় দেশ তখন ক্ষত-বিক্ষত। নজরুল এই গীতিতে সাম্প্রদায়িক বিভেদের তীব্র বিরোধিতা করলেন। সাম্প্রদায়িক ঐক্যের আহ্বান জানালেন- "হিন্দু না ওরা মুসলিম?' এই জিজ্ঞাসে কোন জন?/কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র!' হিন্দু বা মুসলমান পরিচয়ে নয়, মানুষকে মানুষের পরিচয়েই দেখতে চেয়েছেন নজরুল।
'হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ' কবিতায় ভ্রাতৃঘাতী রক্তপাতের নিন্দা করেছেন- "কে কাহারে মারে, ঘোচেনি ধন্দ, টুটেনি অন্ধকার,/জানে না আঁধারে শত্রু ভাবিয়া আত্মীয়ে হানে মার!/উদিবে অরুণ, ঘুচিবে ধন্দ,/ফুটিবে দৃষ্টি, টুটিবে বন্ধ,/হেরিবে মেরেছে আপনার ভায়ে বন্ধ করিয়া দ্বার!/ভারত-ভাগ্য করেছে আহত ত্রিশূল ও তরবার!"
নজরুলের কবিতা ও গানে একই সঙ্গে হিন্দু ও ইসলামি পুরাণ প্রসঙ্গ ও চরিত্রের অবতারণা ঘটেছে। প্রয়োজনে তাঁর রচনায় আরবি ফারসি শব্দ ব্যবহূত হয়েছে। এ ব্যাপারে শুচিবায়ুগ্রস্ত ছিলেন না তিনি। অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁকে একটি চিঠিতে লিখেছেন-
''বাংলা সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান উভয়ের সাহিত্য। এতে হিন্দু দেবদেবীর নাম দেখলে মুসলমানের রাগ করা যেমন অন্যায় হিন্দুরাও তেমনি মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মধ্যে নিত্য প্রচলিত মুসলমানি শব্দ তাদের লিখিত সাহিত্যে দেখে ভুরু কোঁচকানো অন্যায়। আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের এই সংস্কারে আঘাত দেবার জন্যই মুসলমানি শব্দ ব্যবহার করি বা হিন্দু দেবদেবীর নাম নিই।''
ধর্মের নামে নজরুল ভণ্ডামি তিনি সহ্য করেন না। মন্দির, মসজিদ, গির্জার বাহ্যিক চাকচিক্য তাকে মুগ্ধ করেনি। 'সাম্যবাদী' কবিতায় তিনি বলেন, প্রকৃত মন্দির মসজিদ, গির্জা আছে মানুষের হৃদয়ে -"মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,/এইখানে বসে ঈশা মূসা পেল সত্যের পরিচয়।" মানুষের চেয়ে ধর্মশাস্ত্র বড় নয়। মানুষের প্রয়োজনেই ধর্মশাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্রের প্রয়োজনে মানুষ নয়।
'মানুষ' কবিতায় সমস্ত বিভেদের বিরুদ্ধে নজরুল সোচ্চার হয়ে উঠেছেন- "মানুষেরে ঘৃণা করি,/ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল, চুম্বিছে মরি মরি!/ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে,/যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে।" কবি স্মরণ করিয়ে দেন- "পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল। - মূর্খরা সব শোনো,/মানুষ এনেছে গ্রন্থ - গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।"
ধর্মের সেবককে মানুষের সেবক হতে হবে। ক্ষুধার্ত মানুষ মন্দির-মসজিদের দরজা থেকে ফিরে যায়। পূজারি এবং মোল্লা খাবার লোপাট করে তাকে ফিরিয়ে দেন। ক্ষুব্ধ নজরুল বলেন- "খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?/সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি-শাবল চালা।/হায় রে ভজনালয়,/তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।"
চিরবিদ্রোহী নজরুলের অসংযত আবেগ ও উচ্ছ্বাস কখনো কখনো তাঁর কবিতাকে দুর্বল করেছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন- "তুমি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচ্ছ, তবে ও কাজের জন্য ক্ষুরই প্রশস্ত।" এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ তাঁর ছিল না। তাঁর দর্শন ছিল- "দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।"
সদ্যপ্রয়াত গবেষক ও লেখক আনিসুজ্জামান নজরুলের কবিতা সম্পর্কে বলেছেন-
"এইসব বিদ্রোহমূলক কবিতাগুচ্ছ যে বিদ্রোহ বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে, দেশি শোষকের বিরুদ্ধে, নারীর অধীনতার বিরুদ্ধে, প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, মোল্লা-পুরুতের বিরুদ্ধে ও শ্রেণিসমাজের বিরুদ্ধে- তার সবই যে ভালো কবিতা এ দাবি বোধ হয় কেউ করবেন না। তবে এ মন্তব্য খুবই যথার্থ যে, ওই সব প্রসঙ্গ নিয়ে তখন পর্যন্ত যেসব ভালো কবিতা লেখা হয়েছিল, তা নজরুলের হাত দিয়েই বের হয়।"
যে প্রসঙ্গকে নজরুল কবিতার উপজীব্য করেছিলেন সে প্রসঙ্গটি বাঙালির চিরায়ত সমন্বয়বাদী ঐতিহ্যের ধারক। যে সময়ে দুই প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় ভেদবুদ্ধি ও হানাহানিতে লিপ্ত সেই সময়ে স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নজরুল তাঁর সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িকতা ও মনুষ্যত্বের জয়গান গেয়েছেন এবং হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির সমন্বয়বাদী ঐতিহ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। এখানেই নজরুলের সার্থকতা।
*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক সমকাল পত্রিকার কালের খেয়া-তে, ২৮ আগস্ট ২০২০। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনরায় প্রকাশিত।