Media School

Dhaka    Friday, 22 November 2024

By আবু সাঈদ খান

সংবাদমাধ্যম, রাষ্ট্র ও রাজনীতি

Media School September 28, 2020

আবু সাঈদ খান : লেখক, গবেষক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

সংবাদমাধ্যম ছাড়া এক মুহূর্তও আমরা ভাবতে পারি নাসংবাদপত্র আধুনিক জীবনেরই অংশতথ্য জানা প্রতিটি নাগরিকের অধিকার, সংবাদমাধ্যম হচ্ছে তার প্রধান বাহনটমাস জেফারসনের একটি উক্তি স্মরণীয়তিনি বলেছিলেন, '...were it left to me decide whether we should have a Government without newspapers or newspapers without a Government, I should not hesitate to prefer the latter.' বলা বাহুল্য, যখন তিনি কথাটি বলেছিলেন, তখন সংবাদমাধ্যম বলতে শুধু সংবাদপত্রই ছিল, এখন সেটা বহুমাত্রিক

সংবাদপত্র তথা সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে একটি কথা আছেবচনটির আইনি ভিত্তি না থাকলেও গুরুত্বহীন নয়কারণ, রাষ্ট্রের স্বীকৃত স্তম্ভ আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগআইনসভা বা পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন নীতিনির্ধারণ করেনির্বাহী বিভাগ শাসন-প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেআর আইনের ব্যাখ্যা এবং অপরাধের প্রতিবিধান করা বিচার বিভাগের এখতিয়ারপাশাপাশি সরকার-প্রশাসনে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতি, ভুলত্রুটি গভীর পর্যবেক্ষণে খুঁজে প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যমইদানীং বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ আমলে নিয়ে আদালত থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়, রুলনিশি জারি করা হয়রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা এবং ন্যায্যতার সুযোগ সৃষ্টি হয়সংবাদমাধমের এই ভূমিকা আপেক্ষিকসংবাদমাধ্যম ততটুকু স্বাধীন ভূমিকা পালন করতে পারে, যতটুকু রাষ্ট্র অনুমোদন করেকারণ শ্রেণী-বিভক্ত সমাজে রাষ্ট্রের অবস্থান শ্রেণীর ঊর্ধ্বে নয়তাই কোনো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে সংবাদমাধ্যমের এমন কোনো ভূমিকা পালনের সুযোগ থাকে না, যা পুঁজির স্বার্থ বিদীর্ণ করেএর মানে এই নয় যে, সংবাদমাধ্যম শ্রমিকের স্বার্থে কথা বলতে পারে নাআলবৎ বলতে পারে এবং বলেওতবে ক্ষমতাসীনদের এবং  প্রচলিত ব্যবস্থার বিপক্ষে গেলে সমূহ বিপদ

রাষ্ট্রের কর্তারা সংবাদমাধ্যম সাংবাদিকদের নিকট বন্ধু বলে উল্লেখ করেনতবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এমন বন্ধুত্ব ক্ষণস্থায়ী এবং বিপজ্জনকও বটেসংবাদমাধ্যম যখন রাষ্ট্র রাজনীতির সমালোচনা করে, কর্মকর্তাদের অনিয়মের খবর প্রকাশ করে - তখন রাষ্ট্রযন্ত্র খড়গহস্ত দ্রুত প্রসারিত করেকথাটি গণতন্ত্রের ছদ্মবেশী স্বৈরাচারী সরকারের বেলায় চরম ভাবে সত্যযখন কোনো রাজনৈতিক শক্তি বিরোধী দলে থাকে, তখন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে, কালাকানুন বাতিলের কথা বলেসরকারে গিয়ে তা তারা মনে রাখে না, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণেও দ্বিধা করে নাশাসক শ্রেণীর এই দ্বিমুখী চরিত্রের প্রকাশ ঘটে ক্ষমতায় থাকা আর না থাকা সময়ে

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গভীর যোগ রয়েছেপাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার দাবিও অন্তর্ভুক্ত ছিলতখন রাজনৈতিক নেতারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন১৯৫৬ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে সংবিধান প্রণয়নসম্পর্কিত বিতর্কে শেখ মুজিবুর রহমান স্পিকারের উদ্দেশে বলেছিলেন,

You say that ‘freedom of expression’ means freedom of press. Do you know that in East Bengal how the editors are called and it is said ‘you cannot write this, you cannot write that.’ They cannot write facts, sir, I can prove it.

The Government of East Bengal writes, or a Clerk writes it; the orders goes from Secretariat that ‘you cannot discuss these things’. A Sub-inspector goes on behalf of the Government to stop the press from writing a particular thing. ...Therefore, it should be laid down that the press will have freedom, the press will have liberty to write their mind and mobilise public opinion.

এই বক্তব্য এখনো প্রাসঙ্গিকবাংলাদেশের সংবিধানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-

. চিন্তা বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল

. রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে

. প্রত্যেক নাগরিকের বাক ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং

সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা করা হইল

 

কিন্তু আসল ব্যাপার হচ্ছে- সরকার কীভাবে ব্যাখ্যা করছে বা কীভাবে দেখছে? আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, সব সরকারই অনুগতদের ওপর তুষ্ট, ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি খড়গহস্তশাসকশ্রেণী সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে সর্বদাই তাঁদের গুণকীর্তন আশা করে, তাঁদের অন্যায়-অবৈধ, অন্যায্য কাজের সমালোচনা সহ্য করে না

বাংলাদেশসহ গণতন্ত্রের পথে অনগ্রসর দেশগুলোতে সংবাদমাধ্যমকে হুমকি-ধমকি এবং শাসকদের বেঁধে দেয়া সীমার ভেতরই থাকতে হয়জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক দল, পুলিশ, প্রশাসন, চোরাচালানি সিন্ডিকেট, মাদক অস্ত্র ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু সংবাদমাধ্যমযখন যার স্বার্থে ঘা লাগছে, তখন সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সংবাদমাধ্যমের ওপর ক্ষিপ্ত হচ্ছে, সংবাদকর্মীদের ওপর চড়াও হচ্ছেঅপর দিকে রাষ্ট্রযন্ত্রও সংবাদমাধ্যমকে নিরাপত্তা না দিয়ে পক্ষান্তরে বিপরীতে অবস্থান নিতে বিলম্ব করে না

ব্রিটিশ ভারত : ব্রিটিশ ভারতে আধুনিক সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিলতখন যেসব সংবাদপত্র শাসকগোষ্ঠীর কার্যকলাপ সমর্থন করত, জয়গান গাইত তারা পুরস্কৃত হতো, আর সমালোচকদের ওপর নির্যাতনের খাঁড়া নেমে আসত১৮৫৭ সালের বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সময়ে ইংরেজদের মালিকানাধীন সংবাদপত্রের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে স্বদেশী পত্রপত্রিকার একাংশ ব্রিটিশরাজের গুণকীর্তন প্রতিযোগিতায় নেমেছিল প্রসঙ্গে সংবাদ প্রভাকর সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কথা বলা যায়তিনি সিপাহী বিপ্লবে ব্রিটিশ শাসকের পক্ষাবলম্বন করেন, বিপ্লবের আগে পরে দুহাতে বিদ্রোহী সিপাহীদের বিরুদ্ধে অকাতরে লিখেছেন১৮৫৭ সালের ২০ জুন সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদকীয় স্তম্ভে লেখা হয়, ‘...চিরকাল হয় যেন, ব্রিটিশের জয়।/ব্রিটিশের রাজলক্ষ্মী, স্থির যেন রয়/এমন সুখের রাজ্য, আর নাকি হয়।।/শাস্ত্র মতে এই রাজ্য, রামরাজ্য কয়।।/’ এঁদের ওপর ব্রিটিশের আশীর্বাদ নানা ভাবে বর্ষিত হয়। পক্ষান্তরে বিপ্লবে ‘উস্কানিদেওয়ার অভিযোগে ভারতের নানা ভাষায় প্রকাশিত বেশকিছু পত্রপত্রিকা, বিশেষ করে উর্দু পত্রপত্রিকা এবং পত্রিকা সংশ্লিষ্টরা চরম দমন-পীড়নের শিকার হয়েছিল।

সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের কালাকানুন সেটিও প্রণীত হয়েছিল ওই ব্রিটিশ ভারতেইসূচনা থেকেই নানা আইনে সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ করা হতো১৮৭৮ সালে দেশীয় পত্রিকা নিয়ন্ত্রণের জন্যভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্টজারি করা হয়তখন একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। “১৮৭৭-এর মার্চ মাসে স্যার উইলিয়ম হান্টারের সহযোগিতায় প্রেস-কমিশন গঠিত হলোএবং শেষ পর্যন্ত ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে দেশীয় ভাষার সংবাদপত্র, বিশেষ করে হালিশহর অমৃতবাজার অবিলম্বে কঠোর হাতে দমন করার জন্যভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্টপ্রবর্তিত হলোঅমৃতবাজার কৌশলটি ধরতে পেরে তৎক্ষণাৎ ইংরেজি পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়।” পরবর্তী সময়ে এটি বাতিল হলেওনিউজপেপারস (ইনসাইটমেন্ট অফেন্সেস) অ্যাক্টসহ নানা কালাকানুন, এমনকি টেলিগ্রাফ আইন, ডাকঘর আইন ইত্যাদির মাধ্যমেও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল

বিগত শতাব্দীর ত্রিশ-চল্লিশের দশকে রাজনীতিতে কংগ্রেস মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব ব্রিটিশ শাসককে স্বস্তি দিয়েছিল সময়ে কলকাতাসহ সারা ভারতের পত্রপত্রিকা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়একদিকে কংগ্রেস সমর্থক অমৃতবাজার, আনন্দবাজার, যুগান্তর, বসুমতি, স্টেটসম্যান ইত্যাদি, অপরদিকে মুসলিম লীগের নাজিমউদ্দীন-আকরম খাঁ গ্রুপের দৈনিক আজাদ, মর্নিং নিউজ, সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের সাপ্তাহিক মিল্লাত ইত্তেহাদতখন কংগ্রেস সমর্থক সংবাদপত্র মুসলিম লীগকে এবং মুসলিম লীগ সমর্থক সংবাদপত্র কংগ্রেসকে তুলোধুনা করতে থাকেতাতে লাভ-সুখ হতো ইংরেজ শাসকদের

শেরে বাংলা ফজলুল হকের মালিকানাধীন মোজাফ্ফর আহমদ কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ, নজরুল সম্পাদিত ধূমকেতু, লাঙল, মোজাফ্ফর আহমদের গণবাণী দৈনিক স্বাধীনতা ছিল সেক্যুলার প্রগতিবাদী ধারার পত্রিকাপাঠক ছিল হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষসেক্যুলার প্রগতিশীল ধারার পত্রপত্রিকার লক্ষ্যবস্তু ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকই, ফলে এসব পত্রপত্রিকার ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত ছিলকাজী নজরুল ইসলামসহ অনেককে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়েছেনজরুলের বই প্রকাশের পরক্ষণে নিষিদ্ধ হবার ঘটনা ঘটেএক্ষেত্রে আর একজনের নাম উল্লেখ করা যায়তিনি অরবিন্দ ঘোষপত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তাঁর পত্রিকায় ব্রিটিশবিরোধী লেখার কারণে গ্রেফতার হন, নির্জন কক্ষে কারাভোগ করেনএক বছর পরে কারামুক্তি ঘটেতখন দেখা যায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে গেছেতিনি পত্রিকার প্রকাশ, লেখালেখি, ব্রিটিশ বিরোধিতার পথ সবকিছু ত্যাগ করে ধর্মের আশ্রয়ে চলে যানহয়ে যান ঋষি অরবিন্দ

দমন-পীড়নের ধারা অব্যাহত ছিল পাকিস্তান আমলেও১৯৬০ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খান সাংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য পাকিস্তান সরকার প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স জারি করেদৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা কয়েকদফা নিষিদ্ধ হয়পত্রিকাটির সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াও একাধিকবার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন

তবে অধিকাংশ পত্রিকাই তখন জাতীয়তাবাদী প্রগতিশীল আন্দোলনের পক্ষাবলম্বন করেছিল প্রেক্ষাপটে সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানায় দৈনিক পাকিস্তান প্রকাশ করে। (স্বাধীনতা-উত্তর দৈনিক পাকিস্তানের নাম পরিবর্তিত হয়ে দৈনিক বাংলা হয়।) প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও পত্রিকাটির ভূমিকা অপরিবর্তিত ছিলজেনারেল এরশাদের আমলে প্রথম পাতায় তাঁর লেখা কবিতাও ছাপা হতো

ভাষা আন্দোলনে মর্নিং নিউজ, সংবাদ, উর্দু দৈনিক পাসবন আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল; আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয় পাকিস্তান অবজারভারআজাদ প্রথমে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পর আন্দোলনের পক্ষাবলম্বন করেমিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে পত্রিকাটির সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভা থেকে পদত্যাগ করেন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল তমদ্দুন মজলিশের সাপ্তাহিক সৈনিক মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিক ইত্তেফাকইত্তেফাক ১৯৫৩ সালে দৈনিকে পরিণত হয়পরে পত্রিকাটি ভাসানীর হাত থেকে ছিনতাই হয়ে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মালিকানাধীনে চলে যায়

ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুসলিম লীগের ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের রাজনীতির পতন ঘটেরাজনীতিতে বেগবান হয়ে ওঠে দুটি ধারা - বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারার আওয়ামী লীগ বাম ধারার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মতপার্থক্য সত্বেও দৈনিক ইত্তেফাক ছিল আওয়ামী লীগ রাজনীতির সক্রিয় সমর্থক প্রচারকআর ১৯৫৪ সালে মালিকানা বদলের পর দৈনিক সংবাদের ভূমিকা পরিবর্তিত হয়সংবাদ হয়ে ওঠে বাম মতাদর্শের বাহকষাটের দশকে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে উপেক্ষা করা কোনো সংবাদপত্রের পক্ষেই সম্ভব ছিল নাআন্দোলনের হাওয়া থেকে দূরে ছিল না দৈনিক আজাদ, সরকারি ট্রাস্ট পরিচালিত মর্নিং নিউজ দৈনিক পাকিস্তান

পাকিস্তান আমলে সাহসী সাংবাদিকতার অনন্য উদাহরণ পাওয়া যায়শেষ বয়সে মোহাম্মদ আকরম খাঁ এবং শুরু থেকেই তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী, ফয়েজ আহমদ, নির্মল সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, এবিএম মূসা, সিরাজুদ্দিন হোসেন, কামাল লোহানী প্রমুখ সাহস মেধা দিয়ে সাংবাদিকতাকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছেনতাঁরা কিন্তু একই মত পথের ধারক ছিলেন নাতবে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মর্যাদার প্রশ্নে তাঁরা পরস্পর ছিলেন মতভিন্ন এবং রাষ্ট্রের কাছে মাথা নোয়াতেন না

উল্লেখ্য, ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অধ্যাদেশ পরিবর্তন করে প্রেস পাবলিকেশন্স (সংশোধনী) অধ্যাদেশ জারি করেনএই অধ্যাদেশে ছিল সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠ চেপে ধরার অগাধ ক্ষমতাতখন এই কালাকানুনের প্রতিবাদে সাংবাদিক সমাজ প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেমিছিলে নেতৃত্ব দেন নবতিপর মওলানা আকরম খাঁআন্দোলনের মুখে এক বছরের মাথায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান অধ্যাদেশটির কার্যকারিতা স্থগিত করতে বাধ্য হন

১৯৭১ সালে দৈনিক ইত্তেফাক পিপলস কার্যালয়ে হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী৩১ মার্চ ১৯৭১ সংবাদ কার্যালয়ে আগুন দিলে ভস্মীভূত হন সাহিত্যিক-সাংবাদিক শহীদ সাবেরপাকিস্তানি সেনাদের হাতে আরও নিহত হন সাংবাদিক-সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, গোলাম মোস্তফা, খোন্দকার আবু তালেব, শেখ আবদুল মান্নান, শিবসাধন চক্রবর্তী, সেলিনা পারভীনঢাকাসহ অবরুদ্ধ দেশে পত্রপত্রিকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নজরদারিতে প্রকাশিত হতোতখন স্বাধীনতার পক্ষে এবং বাঙালিদের উদ্যোগে কলকাতা, আগরতলা, লন্ডন, নিউইয়র্কসহ নানা স্থান থেকে প্রকাশিত হয়েছিল অর্ধশতাধিক সাপ্তাহিক পাক্ষিকএদের মধ্যে আবদুল রফিক (জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নানের ছদ্মনাম) সম্পাদিত আওয়ামী লীগের মুখপত্র জয়বাংলা, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতায় সংগ্রামী বাংলা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র মুক্তিযুদ্ধ, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির স্বাধীন বাংলা, আবদুল কাদের সিদ্দিকী পরিচালিত রণাঙ্গন, হাবিবুর রহমান সম্পাদিত বাংলার বাণী, সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত অভিযান, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর দেশ বাংলা, মো. জিনাত আলী সম্পাদিত দাবানল, আবু সাঈদ খান সম্পাদিত উত্তাল পদ্মা ইবনে আদম (খোন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ) সম্পাদিত মুক্তি উল্লেখযোগ্যসাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, সিকান্দার আবু জাফর, ফয়েজ আহমদ, তোয়াব খান, নির্মল সেন, কামাল লোহানী, এম আর আখতার মুকুল, সলিমুল্লাহ, সাদেকীন প্রমুখ সাংবাদিক কলকাতা যান এবং মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখেন

১৯৭১ সালে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদানে স্বাধীনতা এলো, কিন্তু স্বাধীন দেশে সাংবাদিকতা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হলো নাপুরনো আইন সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটল নাস্বাধীন বাংলাদেশের কোনো সরকারের আমলেই সংবাদপত্র সাংবাদিকরা হামলা-মামলা-বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত ছিল বা আছে- এমনটি দাবি করার কোনো সুযোগ নেইস্বাধীনতা-উত্তর দৈনিক গণকণ্ঠের প্রকাশনায় বাধা দেওয়া হয়গণকণ্ঠ সম্পাদক কবি আল মাহমুদ হলিডে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান কারাবন্দী হনদৈনিক অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালামকে সরকারি আদেশে চাকরিচ্যুত করা হয়১৯৭৫ সালে বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনকালে সরকারি মালিকানায় ৪টি পত্রিকা (ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, অবজারভার বাংলাদেশ টাইমস) বাদে দেশের সকল দৈনিকের প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয়

১৯৭৭-এর জুন টাঙ্গাইলের এক বিল থেকে সাংবাদিক আবদুল গফুরের মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়পরের বছর মার্চ মাসেরিকাডেন্সওষুধ ঘটিত রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে তিনজন সাংবাদিক ঈশ্বরদীতে প্রহৃত হন সময়ে সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা অবিরাম ঘটেছেস্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে বাংলার বাণী, দৈনিক খবর, দৈনিক মিল্লাত, যায়যায়দিন, রোববার প্রভৃতি পত্রপত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়েছিলতখন হরহামেশা টেলিফোনে প্রেস অ্যাডভাইস দেওয়া হতোহরতাল, বোমা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারনিষিদ্ধছিলতাই এসব বোঝাতে সংবাদমাধ্যমকে কৌশল গ্রহণ করতে হয়েছেতখন সংবাদপত্রে লেখা হতো, সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্তকর্মসূচীপালিত হয়েছেকিংবা শহরের নানা স্থানে ১০টিকর্মসূচীফুটেছেপাঠকদের বুঝতে অসুবিধা হতো নাকর্মসূচীবলতে কী বোঝানো হয়েছে!

নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট সংশোধন করেএর আগ পর্যন্ত সংবাদপত্রের উপর বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্টের খাঁড়া ঝুলে ছিল২০০৭- সালে বিজ্ঞাপন বিতরণে ডিএফপির কর্তৃত্ব খর্ব হওয়ার আগ পর্যন্ত সরকারি সংস্থা ডিএফপিও সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতোবিশেষ ক্ষমতা আইন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট এবং বিজ্ঞাপন নীতি পরিবর্তনে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্র আপাতত প্রসারিত হয়

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেসংবাদমাধ্যমে বৃহৎ পুঁজি আধুনিক প্রযুক্তি প্রবেশের ফলে মুদ্রণ কারিগরি দিকে এক ধরনের বিপ্লব ঘটে যায়এর আগে সীসার অক্ষর, কাঠের ব্লক, ট্র্যাডল মেশিনকে বিদায় করেছিল যে লিথোপ্রিন্ট অফসেট, তাদেরকে হটিয়ে দিয়ে চালু হয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, কম্পিউটার থেকে প্রেস (সিটিপি)। অতি অল্প সময়ে ছাপা হচ্ছে একই মেশিনে হাজার হাজার কপিবিনিয়োগ হচ্ছে বড় অঙ্কের পুঁজিব্রিটিশ পাকিস্তান আমলে সম্পাদকরাই অনেক ক্ষেত্রে মালিক ছিলেনতবে কোনো কোনো পত্রিকায় রাজনীতিকদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল, অর্থানুকূল্য ছিলসাংবাদিকরাই ছিলেন পত্রপত্রিকার প্রাণশক্তি১৯৪৭-এর দেশভাগের পর ভারতের সংবাদপত্রে বাণিজ্যিক পুঁজির প্রবেশ ঘটেপূর্ব-পাকিস্তানেও অবজারভার সংবাদ দুই ধনাঢ্য পরিবারের মালিকানাধীন ছিল, তবে আজাদ, ইত্তেফাকসহ প্রভৃতি সংবাদপত্র সাংবাদিক-সম্পাদকের মালিকানায় পরিচালিত হতো

৯০-এর দশকে একে একে প্রকাশিত হয়েছে আজকের কাগজ (অধুনালুপ্ত), ভোরের কাগজ, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, মানবজমিন, জনকণ্ঠ, যুগান্তর, সমকাল, কালেরকণ্ঠ, আমাদের সময়, বাংলাদেশ প্রতিদিন, মানবকণ্ঠ, দেশ রূপান্তর প্রভৃতি কর্পোরেট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানায় বৃহৎ পুঁজির সংবাদপত্রদেশে এখন সংবাদমাধ্যমের এক বিশাল জগৎ গড়ে উঠেছে, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ৫০২টি সহ সারা দেশে দৈনিকের সংখ্যা এখন হাজার ১৪৮, সাপ্তাহিক হাজার ১৯২, মাসিক ৪১৪ অন্যান্য ৪১টি এবং অনলাইন মিডিয়া হাজার ২১৭ টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে ৩০টি, ইতিমধ্যে অনুমতি পেয়েছে আরও ১৪টিউল্লেখ্য, সাংবাদিক রাজনৈতিক কর্মীদের টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিলকিন্তু লাইসেন্সপ্রাপ্তরা রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স প্রাপ্তির পর অর্থলগ্নির প্রয়োজনে বিনিয়োগের জন্য ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়এতে মালিকানা ব্যবসায়ীদের নিকট চলে যায়বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন টিভি চ্যানেলগুলোর সিংহভাগ অংশীদারএফএম রেডিওগুলোও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে গেছেতবে এখনো রাজধানীসহ জেলা উপজেলা থেকে প্রকাশিত স্বল্প বাজেটের অনেক দৈনিক অনলাইন পোর্টালের মালিকানা সাংবাদিকদের হাতে রয়েছেঅনলাইন মাধ্যমেও দ্রুত বৃহৎ পুঁজির প্রবেশ ঘটছেকেবল সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারেই পুঁজির দরকার নেইব্যবহারকারী সবাই ব্যবহারকারী এবং মালিক

এক সময়ে সংবাদমাধ্যমের মালিক ছিলেন সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা বা সমাজসেবীএখন প্রধানত ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা সংবাদমাধ্যমের মালিকএটি তাদের অর্থনৈতিক বিনিয়োগবিনিয়োগের পেছনে রয়েছে মালিকের ব্যবসায়িক স্বার্থ; যদিও সংবাদমাধ্যমে পুঁজি খাটিয়ে খুব বেশি আয়ের সুযোগ নেইপ্রশ্ন হচ্ছে, তার পরও কেন এত বিনিয়োগ হচ্ছে? কারণ সংবাদমাধ্যম শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের মুনাফা লাভের আশায় থাকে, সেই সঙ্গে ক্ষমতা মর্যাদার ঢাল, পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রকাশের সুযোগ তৈরিতে সহায়তা করে থাকে। ওদিকে সম্পাদকদেরও পুঁজির স্বার্থের কথা ভাবতে হয়, সদা তটস্থ থাকতে হয়বলা যায়, সম্পাদকদের পুঁজির পাহারাদারে পরিণত হতে হয়েছেএই বাস্তবতায় সরকার-প্রশাসনের পক্ষেও সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়েছেঅবলীলায় সেটা করাও হচ্ছে

১৯৯১- বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট সংশোধিত হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের মধ্যে বেশ একটা আনন্দ-হিল্লোল বইছিলধারণা হয়েছিল, সংবাদমাধ্যমের ওপর আর হস্তক্ষেপের সুযোগ রইল নাকিন্তু অলিখিত নিষেধাজ্ঞায় সাংবাদিক সংবাদপত্র এখন তটস্থসাংবাদিকরা সরকার, প্রশাসন, পুলিশ, মাস্তান সবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেগত তিন দশকে দুর্বৃত্তের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন যশোরে সাইফুল আলম মুকুল শামসুর রহমান, খুলনার হুমায়ুন কবীর বালু মানিক সাহা, ফরিদপুরে গৌতম দাস, ঢাকায় সাগর-রুনি দম্পতি, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের আবদুল হাকিম শিমুলসহ অন্যূন ৩০ জন সাংবাদিক

গৌতম হত্যা ছাড়া আর কোনো সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়নি২০০৫ সালের ১৭ নভেম্বর সরকারের আশ্রিত সন্ত্রাসীরা সমকালের ফরিদপুরের ব্যুরোপ্রধান গৌতম দাসকে সমকাল কার্যালয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেহত্যার পর তার লাশ ঝুলিয়ে রাখেফরিদপুরসহ সারাদেশে এর প্রতিবাদ হয়তখন আন্দোলনের মুখে পুলিশ আসামীদের গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছিল২০১৪ সালের এপ্রিলে দ্রুত বিচার আদালতে অভিযুক্তদের মধ্যে জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছেযশোরের মুুকুল শামসুর রহমান, খুলনার বালু মানিক সাহা হত্যার পেছনে স্থানীয় মাফিয়া চক্রের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে

খুবই আলোচিত ঘটনা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসাগর মাছরাঙা টেলিভিশনে এবং রুনি এটিএন বাংলায় কাজ করতেন২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ইন্দিরা রোডের বাসায় তাঁদের একই সঙ্গে হত্যা করা হয়এই নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিকদের দুই ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি পালন করেতৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে ঘোষণা দেনতদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা বলেছিলেন, ঘটনার ক্লু খুঁজে পেয়েছেনপুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছিলেন, তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছেপরবর্তী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও দ্রুত রহস্য উন্মোচনের আশ্বাস দিয়েছিলেনগত বছরেও ঘটনা তদন্তে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নিআইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ৬০ বারের বেশি সময় নিয়েছেআমরা জানি না কেন, কার বা কাদের স্বার্থে মামলার অগ্রগতি হচ্ছে নাবিষয়টি আজ অবধি রহস্যপূর্ণই রয়ে গেছে

একাত্তরে রাজাকারদের নৃশংস অপকর্ম-অপকীর্তি নিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রতিবেদন প্রকাশের কারণে ২০০১ সালে হামলার শিকার হন পত্রিকাটির প্রতিবেদক শহীদ-সন্তান প্রবীর শিকদারঅভিযুক্তদের কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছিলঅভিযুক্ত আট ব্যক্তি জামিনে বেরিয়ে আসার পর তারা একে একেঅন্তকোন্দল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গেবন্দুকযুদ্ধেনিহত হয়জনমনে ধারণা, প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করতেই অভিযুক্তদের হত্যা করা হয়েছেপঙ্গুত্ব নিয়ে প্রবীর শিকদার এখনো সাংবাদিকতায় সক্রিয় রয়েছেন

জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, সন্ত্রাসী, প্রভাবশালী ব্যক্তি, ক্ষমতাসীন ক্ষমতার বাইরে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের হাতে সাংবাদিকদের নির্যাতিত লাঞ্ছিত হতে হয়েছে এবং হচ্ছেওসবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন রিপোর্টার ফটোগ্রাফাররাতাদের ওপর পুলিশের চড়াও হওয়া অতি পরিচিত দৃশ্যসংবাদ সংগ্রহকালে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর পৌরসভার মেয়রের গুলিতে নিহত হন সমকালের স্থানীয় প্রতিনিধি আবদুল হাকিম শিমুল

সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সচিত্র প্রতিবেদন সকলের দৃষ্টি কেড়েছিল, পুলিশ জনৈক সংবাদকর্মীকে পেটাচ্ছিল আর বলছিল, সাংবাদিক পেটালে কী হয়... কিছুই নাএটিই হচ্ছে সাংবাদিকদের প্রতি পুলিশের আচরণের - হয়রানির সূচক, যার সীমা-পরিসীমা নেই

২০১৬ সালে একটি টিভি চ্যানেলে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম ওয়ান-ইলেভেনে নিশ্চিত না হয়ে খবর প্রকাশের জন্য ভুল স্বীকার করেনএরপর দেশের নানা স্থানে তাঁর বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানি ক্ষতিপূরণের মামলা দেওয়া হয়অথচ দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যক্তির পক্ষে বাদী হয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার সুযোগ নেইরাষ্ট্রপক্ষ থেকেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করতে হয়আর সরকারদ্রোহ রাষ্ট্রদ্রোহ এক নয়তাছাড়া বাংলাদেশের প্রচলিত আইন সংবিধান অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে একই অপরাধে একাধিক মামলা হতে পারে নাকারও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ক্ষমতাসীন দলের কর্মী সমর্থকদের করা বেআইনী মামলার সবগুলোই ছিল হয়রানিমূলক

২০১৮ সালে খবর সংগ্রহকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, সন্ত্রাসী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হাতে ২০৭ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেনদুর্বৃত্তের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন দুজন সাংবাদিক ২০১৭ সালে নির্যাতনের শিকারের সংখ্যা ১২২ এবং প্রাণ হারিয়েছিলেন একজন সাংবাদিক নির্যাতনের মাত্রা বর্তমান সরকারের শাসনামলে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে

তাছাড়া তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের হয়রানির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে২০০৬ সালে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) প্রণীত হওয়ার সময়ে সরকার বলেছিল সাংবাদিকদের ভয় পাওয়ার কিছু নেইকারণ আইনটি করা হয়েছে সাইবার অপরাধ ঠেকানো সাইবার অপরাধীদের দমনের জন্যকিন্তু বাস্তবে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির ৫৭ ধারায় সাংবাদিকরাই কারাভোগ হয়রানির শিকার হয়ে চলেছেনউল্লেখ্য, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯ ৩১ ধারার মধ্যে পুনর্জীবিত করা হয়েছেএই আইনে পুলিশকে সন্দেহবশতঃ গ্রেফতার, বাসাবাড়ি-অফিসে প্রবেশ তল্লাশি, কম্পিউটার-কম্পিউটার নেটওয়ার্ক-সার্ভার-ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম জব্দ করার সুযোগ দিয়েছে, যা সাংবাদিক সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হবে বলে আশঙ্কাপুলিশের এমন লাগামহীন ক্ষমতা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে

২০১৮ সালে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৪০ জন গ্রেফতার হয়েছেন এবং একই বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এঁদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, ব্লগার ফেসবুক ব্যবহারকারী২০১৮ সালের জুন ডেইলি স্টারের ওয়েবসাইট ২২ ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং একই বছরের ১৮ জুন কয়েক ঘণ্টা বন্ধ ছিল অনলাইন পোর্টাল বিডিনিউজ২৪নিরাপদ সড়ক আন্দোলন চলাকালে থ্রিজি ফোরজি মোবাইলের ডাটা বন্ধ ছিলআলজাজিরা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়ায় গ্রেফতার হয়েছিলেন বিখ্যাত আলোকচিত্রী শহীদুল আলমএসমস্ত সাংবাদিক নিগ্রহের সংবাদ দেশের বাইরে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসেরদেওয়া সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তমএতেই প্রকাশ প্রমাণিত হয় বাংলাদেশে সংবাদপত্র সাংবাদিকদের অবস্থা এখন কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে

সংবাদমাধ্যমের কাছে আজ বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্ভয়ে সরকার-প্রশাসনসহ নানা ক্ষেত্রের অনিয়ম দুর্নীতি তুলে ধরা, অবাধে স্বাধীন মত প্রকাশ করাএকজন সংবাদকর্মী হিসেবে সমাজ রাষ্ট্রে অনাহূত ঘটন-অঘটন জনসমক্ষে প্রকাশ করা পেশাগত তো অবশ্যই নৈতিক দায়িত্বও বটেসেটা পালনে অপারগ কোনো সাংবাদিক তাঁর পেশার সঙ্গে একপ্রকার বিশ্বাসভঙ্গই করে থাকেনপ্রশ্ন থাকছে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাধীনে স্বাধীন মত প্রকাশ এবং প্রকৃত সত্য ঘটনা প্রকাশ করতে পারি কি না

সরকার বলছে সংবাদমাধ্যমের ওপর কোনো হস্তক্ষেপ নেইথাকলে সংবাদমাধ্যমের এমন প্রসার ঘটত নাএটি সত্য যে, সরকার সরাসরি কোনো সেন্সরশিপ আরোপ করেনিকী লেখা যাবে না তা উল্লেখ করে কোনো ফরমানও জারি করা হয়নিতাই বলে পরোক্ষ চাপ যে নেই তা মোটেই সত্য নয়সাংবাদিকরা এখন সরকারের আচরণে কৌশলী হুকুমদারিতে স্বআরোপিত সেন্সরশিপে আক্রান্তবলা বাহুল্য, স্বআরোপিত সেন্সরের পেছনে ভীতি প্রাপ্তিযোগ দুই- কাজ করে থাকে এবং করেসর্বোপরি, স্বআরোপিত নিয়ন্ত্রণ বাইরের নিয়ন্ত্রণের চেয়েও শ্বাসরুদ্ধকর

সংবাদমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকদের দুই ইউনিয়নে বিভক্তিসাংবাদিক সমাজ ব্রিটিশ পাকিস্তান আমলে তো বটেই, এমনকি স্বৈরাচার এরশাদ আমলেও অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করেছেএরশাদের পতনের পরে গণতন্ত্রের পুনর্বাসনকালেই ১৯৯২ সালে হীন রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) বিভক্ত হয়এক গ্রুপ হয়ে পড়ে বিএনপি-জামায়াতপন্থী এবং অপর গ্রুপ আওয়ামী লীগপন্থীএই বিভক্তির কারণে সাংবাদিক সমাজ শক্তি মর্যাদা দুই- হারিয়েছেলাভবান হয়েছে বিএনপি আওয়ামী লীগপন্থীদের অনেকেইবিএনপিপন্থীরা বিএনপির আমলে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, আওয়ামী লীগপন্থীরা আওয়ামী লীগের আমলে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন নিচ্ছেনবলে রাখা ভালো যে, একজন সংবাদকর্মী যে কোনো দল করতে পারেন, যে কোনো মতাদর্শে বিশ্বাসী হতে পারেন, তা নিয়ে বলার অবকাশ নেইসেটা ব্যক্তির নাগরিক মানবিক অধিকার; আপত্তি হচ্ছে দলকানা সুবিধাবাদীদের নিয়ে, যারা নিজ নিজ দলের স্বার্থে প্রকৃত তথ্য জনগণকে অবহিত করতে চান না, যারা সাংবাদিক সমাজের অধিকার মর্যাদা নিয়ে আন্দোলনও করতে চান না, ভয় পান পাছে সুবিধার দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়দলবাজির সঙ্গে হলুদ সাংবাদিকতার যোগ আছেহীন স্বার্থে দলবাজরা অতিরঞ্জন অতিকথনে সত্য আড়াল করতে চানএমনকি মিথ্যার আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করেন নাতখন সাংবাদিকতার চরিত্র বদলে যায়

একশ্রেণীর সাংবাদিক প্রাপ্তির আশায় সরকারপন্থী হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণতাদের লক্ষ্য, কে বেশি সরকারের স্তুতি-বন্দনা করে লোভনীয় পদ-পদবি বৈষয়িক সুবিধা বাগাতে পারেনতাই বিভিন্ন হাউজে এখন সরকার বিরোধী দলেরনিজস্ব লোকরয়েছেনতারা সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের ঘুঁটি হিসেবে কাজ করছেন

দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিকদের অনেকেই ব্যক্তিগত স্বার্থের কাছে নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছেনসাংবাদিকতায় মূল্যবোধ পেশাদারিত্বের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে, যা সুস্থ সাংবাদিকতার জন্য মোটেই সহায়ক নয়সংবাদমাধ্যমে যে দুর্বলতা অদক্ষতা রয়েছে- চেষ্টা থাকলে তা কাটিয়ে তোলা সম্ভব; কিন্তু স্তাবকদের বাগে আনা সহজ নয়দলীয় চিহ্নিত স্তাবকদের বাইরে আছে সুবিধাপন্থীরাসরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এদের ঠিকানা বদলে যায়দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রকৃত সত্য কথা লেখা বা বলার মতো সাংবাদিকের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে

শুরুতে ব্রিটিশ শাসকের আনুগত্যেদালালি কথা বলেছিতবে এটি বলতেই হয়, ব্রিটিশ ভারতে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, এমনকি রাজা রামমোহন রায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্রিটিশ শাসন সমর্থনের পেছনে ব্যক্তিগত সুবিধা-লোলুপতা ছিল না যে তা কিন্তু নয়মনে-প্রাণে তারা বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশ শাসন ভারতের জন্য আশীর্বাদ; তারা ব্রিটিশের হাত ধরে নিজেদের সুযোগ-সুবিধার জগৎটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেনএকে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণই বলা যায়

সাংবাদিক সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দেশের রাজনৈতিক আবহের সঙ্গে সম্পর্কিত ক্ষেত্রে সাংবাদিক সমাজের ঐক্য অতীব গুরুত্বপূর্ণসংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা বিকাশে সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে রাষ্ট্র রাজনীতির সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন, এটাই প্রত্যাশিতসংবাদিকতার স্বাধীনতা মর্যাদা সমুন্নত রাখার দায়িত্ব সাংবাদিকদেরই প্রথমে নিতে হবেএটা তো খুবই স্পষ্ট যে, সাংবাদিকসমাজ যতোদিন দলবাজি না ছাড়ছে, সাংবাদিকতায় আদর্শবাদী ধারায় পুনঃপ্রবর্তন না ঘটছে, ততোদিন সাংবাদিক সংবাদমাধ্যমের মাথা তুলে দাঁড়াবার উপায় নেই

তথ্যসূত্র

. মোনায়েম সরকার সম্পাদিত, বাঙালির কণ্ঠ, আগামী প্রকাশনী, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০১৫, পৃ : ২৩

. কমল চৌধুরী, সিপাহি বিপ্লবের ১৫০ বছর : একটি ঐতিহাসিক দলিল, দে পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ : ৪৮৩

. তারাপদ পাল, ভারতের সংবাদপত্র সাংবাদিকতার ইতিহাস (প্রকাশ ২০১০), পত্র ভারতী, কলকাতা, পৃ : ১৫৯

. হাছান মাহমুদ, তথ্যমন্ত্রী, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯- জাতীয় সংসদে প্রদত্ত পত্রপত্রিকা-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান, প্রথম আলো, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

. মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০১৮, ওয়েবসাইট, আইন সালিশ কেন্দ্র

  মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০১৭, ওয়েবসাইট, আইন সালিশ কেন্দ্র

. মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১৮, ওয়েবসাইট, অধিকার