Media School

Dhaka    Thursday, 26 December 2024

By সজীব সরকার

মানুষ : একটি দার্শনিক বিচার - ৪

Media School March 6, 2021

প্রথম জীবনে বিপ্লবের চেতনায় উজ্জীবিত জাতীয়তাবাদী নেতা অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০)-এর জীবনে আপাদমস্তক পরিবর্তন ঘটে কারাবাসকালে; সেখানে তিনি দিব্যজীবন লাভ করে হয়ে ওঠেন 'ঋষি অরবিন্দ'। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ওই সময় তাঁকে আইনি সহায়তা দেন। ঋষি অরবিন্দ বেদ, উপনিষদ, ষড়দর্শন, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা ইত্যাদি প্রাচীন গ্রন্থ ও শাস্ত্র অধ্যয়ন করে প্রাচীন ভারতের ধর্ম ও দর্শনশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। এসব পাঠ করে অরবিন্দের দার্শনিক চিন্তার ভিত্তি হয়ে ওঠে : এক. সবকিছু ব্রহ্ম থেকে জাত এবং ব্রহ্মেই লয়প্রাপ্ত হয় এবং এই চক্র চিরন্তন; দুই. জীবন ও মৃত্যু একই চক্রের দুটি দিক এবং এটি আত্মার পুনরুজ্জীবন; তিন. বিশ্বজগতের যা শাশ্বত নীতি, তা-ই মানবাত্মা ও নিখিল প্রকৃতির পরিণাম নির্ধারণ করে; এবং চার. মানুষের লক্ষ্য হলো দিব্যজীবন, যা ব্রহ্মে মিশে যায়; আত্মজ্ঞানের মাধ্যমেই এ দিব্যজীবনের সন্ধান পাওয়া যায়।

ঋষি অরবিন্দের ভাবনায় মানুষের পক্ষে মূল্যবোধের শিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করতেন, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটেছে। পুরোনো মূল্যবোধগুলো ক্রমেই নতুনতর মূল্যবোধ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। ঋষি অরবিন্দের মতে, এসব মূল্যবোধের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উচ্চ বা উন্নত মূল্যবোধ হলো ঐক্য। তিনি মনে করতেন শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের চর্চা জরুরি। আর সব মূল্যবোধেরই চর্চা ও বিকাশ প্রয়োজন। তাঁর মতে, এসব মূল্যবোধের চূড়ান্ত বিকাশের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সাধুতা। ঋষি অরবিন্দের মতে শিক্ষার সর্বোচ্চ লক্ষ্য হওয়া উচিত আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের বিকাশ।

দিব্যজীবন লাভের পর ঋষি অরবিন্দ দেশপ্রেমকে স্থূল বা অগুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি; তিনি তখনো মনে করেছেন, স্বাধীনতা হলো মানুষের জীবনের সার্বিক কল্যাণের বিষয়। তিনি সবসময় বলেছেন, ভারতে আধ্যাত্মিকতার পুনরুজ্জীবন ঘটানো দরকার আর এজন্যে দেশপ্রেমসহ বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতার চর্চা দরকার (প্রভু জগদ্বন্ধু সুন্দরেরও জীবনদর্শন এখানে অভিন্ন; তিনিও মনে করেছেন, দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার জন্যে আধ্যাত্মিকতা দরকার)। বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিকতাকে ঋষি অরবিন্দ জীবনের প্রধানতম সম্পদ মনে করতেন; বৈদান্তিক সন্ন্যাসী ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ও (১৮৬১-১৯০৭) একই ভাবধারায় প্রভাবিত ছিলেন।

শ্রী অরবিন্দ মনে করতেন, ধর্ম ও আধ্যাত্মিক সাধনার মতো দেশপ্রেম ও স্বাধীনতা মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। তাঁর মতে, ধর্মশূন্য স্বাধীনতা অর্থহীন আর স্বাধীনতা রক্ষার্থে আধ্যাত্মিকতা ও ব্রহ্মচর্য চর্চা অপরিহার্য।

'দ্য আওয়ার অব গড' গ্রন্থে ঋষি অরবিন্দ লিখেছেন, পশুসত্তার ঊর্ধে উঠলে মনুষ্যত্ব লাভ হয় আর মানবসত্তার ঊর্ধে উঠলে নিজের মধ্যে ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটে। এখানে ঋষি অরবিন্দের এই ধারণার মধ্যে মানবজীবনের উৎকর্ষ বিষয়ে মহামতি গৌতম বুদ্ধের দর্শনের এবং গীতার দর্শনের স্পষ্ট প্রভাব দৃশ্যমান হয়। ঋষি অরবিন্দের মতে, কর্মযোগ দিয়ে অহং বিনাশ করতে হবে এবং কর্মযোগের সাথে জ্ঞানযোগের সম্মিলন ঘটাতে হবে; তাহলেই কামনাশূন্য কর্মের লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে (গীতায় যাকে বলা হয়েছে নিষ্কাম কর্মসাধনা)।

ঋষি অরবিন্দের ভাবনায় ভ্রাতৃত্বের ওপর সাম্য নয় বরং সাম্যের ওপর ভিত্তি করে ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠা বেশি জরুরি। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই ভ্রাতৃত্ববোধের ভাবনায় গড়ে ওঠা বিশ্বপ্রেমে আধ্যাত্মিকতার সিঞ্চনে জীবনের সিদ্ধি ঘটে।

ঋষি শ্রী অরবিন্দের দর্শনে মনের ঊর্ধে সত্য চেতনার পথে এগিয়ে যাওয়াই মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ঠিক একই দর্শন আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫), আর্থার এডিংটন (১৮৮২-১৯৪৪) বা জেমস জিনস (১৮৭৭-১৯৪৬)-এর মতো বিজ্ঞানীদের মনোজগতেও বিদ্যমান ছিলো।

মানুষের মন বা চেতনার বিশ্লেষণে অস্তিত্ববাদ (এক্সিসটেনশিয়ালিজম) ও বিনির্মাণবাদ (ডিকনস্ট্রাকশন) এবং আধুনিক দর্শনের অন্যান্য ধারার প্রয়োগ ঘটানো হয়। এসবের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা মনে করা হয় ইতিহাসবাদকে (হিস্টোরিসিজম)। জার্মান দার্শনিক জি ডব্লিউ এফ হেগেল (১৭৭০-১৮৩১) মানুষকে বরং ইতিহাসবাদী ভাবধারায় দেখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। হেগেলের মতে, মানুষকে অস্তিত্ববাদী কিংবা বিনির্মাণবাদী ধারণার দ্বারা ব্যাখ্যা করা ভুল। তিনি বরং ইতিহাসের কালপর্বে মানবচেতনার বিকাশের ক্রমধারা বিশ্লেষণকে মানুষকে বোঝার সঠিক পদ্ধতি বলে ভেবেছেন। হেগেলের মতামত হলো, এখনকার আধুনিক সময়ে আত্মনিষ্ঠা বা আত্মবাদিতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য (সাবজেকটিভিটি অ্যান্ড ইনডিভিজুয়ালিটি) বিষয়ে যে ধারণা তাত্ত্বিকভাবে আলোচিত হয়, ইতিহাসের শুরু থেকেই মানুষের মধ্যে এসব ধারণা ছিলো না; বরং ইতিহাসের নানা পর্যায়ে ক্রমশ মানুষের মধ্যে এসব বোধ তৈরি হয়েছে। হেগেলের মতে, মানবেতিহাসের শুরুতে মোটেও ব্যক্তির মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে পরিচিত হওয়ার বোধ ছিলো না; মানুষ তখন গোষ্ঠিগত পরিচয়ে নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পেতো।

হেগেলের মতে, চিরাচরিত প্রথা থেকে মানবপ্রকৃতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করতে মানুষ ইতিহাসের সব পর্বেই সংগ্রাম করে আসছে। অবশ্য অন্তঃস্থিত এই মুক্তি অর্জনের বিপরীতে যে মূল্য মানুষকে দিতে হয়, তা কি এর যোগ্য কিনা, এ বিষয়ে হেগেল সন্দিহান ছিলেন।

অনেক তাত্ত্বিক অবশ্য মনে করেন, হেগেল তাঁর মতাদর্শ প্রকাশে বেশ গূঢ় বা অনধিগম্য ভাষা ব্যবহার করেছেন; এর ফলে তাঁর দার্শনিক নৃতত্ত্ব সম্বন্ধীয় তত্ত্ব (যা তাঁর ঐতিহাসিক উৎক্রান্তি সম্পর্কিত ধারণার খুব কাছাকাছি) খুব বেশি স্পষ্ট নয় যে কারণে অনেকেই তাঁর এসব ধারণাকে বোধাতীত বা অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্ত হিসেবে উল্লেখ করে খারিজ করেছেন। জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) অবশ্য হেগেলের দর্শন দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত ছিলেন।

চলবে...