Media School

Dhaka    Sunday, 24 November 2024

By সজীব সরকার

মানুষ : একটি দার্শনিক বিচার - ৩

Media School March 4, 2021

বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক ভগবান গৌতম বুদ্ধ মোক্ষ লাভকেই মানবজীবনের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে দেখেছেন। বুদ্ধের দর্শনে মানুষের চূড়ান্ত উৎকর্ষ হচ্ছে সব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে চূড়ান্ত বোধি প্রাপ্তি যার ফলে জীবন-মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তি ঘটে (আধ্যাত্মিক সাধক ও দার্শনিক ঋষি অরবিন্দও জীবন-মৃত্যুর এই চক্র থেকে মুক্তির দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন)। নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধ ধর্মে প্রচলিত অন্য ধর্মগুলোর মতো অতিপ্রাকৃত শক্তিধর কোনো ঈশ্বরের উপস্থিতি নেই। বুদ্ধের দর্শনে তাই মানুষের অবস্থান অখণ্ড, অদ্বিতীয় ও মহত্তম। মানুষের পরিচালক বা নিয়ন্ত্রণকর্তা মানুষ নিজেই; মানুষের ওপরে আর উচ্চতর কোনো সত্তা নেই যে মানুষের ভাগ্যের নিয়ন্তা।

মহামতি বুদ্ধ মনে করতেন, আকাঙ্ক্ষাই হলো মানুষের জীবনের যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের কারণ। বুদ্ধের শিক্ষা হলো, মানুষকে এই আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে মুক্ত করে দুঃখবোধ থেকে মুক্তি পেতে হবে এবং সব ধরনের বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হবে; এই অবস্থাকে বৌদ্ধ ধর্মে বলা হয়েছে ‘নির্বাণ প্রাপ্তি’। বুদ্ধের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, ভগবান বুদ্ধ বোধিপ্রাপ্তির মাধ্যমে নির্বাণলাভের পাশাপাশি ‘কার্মা’-কে অতিক্রম করেছেন এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকেও নিজেকে মুক্ত করেছেন। এ খানে উল্লেখ্য, সনাতন ধর্মেও আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছে; নিষ্কাম কর্ম সাধনের মাধ্যমে কর্মের বিপরীতে ফললাভের আকাঙ্ক্ষাকে এখানে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।

বুদ্ধের দর্শনে মানুষকে চেতন বা মানসের অধিকারী হওয়ার কারণে প্রাণশীল অন্যসব সত্তা থেকে আলাদা ও মহত্তর হিসেবে দেখা হয়েছে। সংস্কৃত ‘মনুষ্য’ শব্দ থেকে ‘মানুষ’ শব্দের উৎপত্তি; ‘মনুষ্য’ বলতে এমন প্রাণী বোঝায় যার ‘মন’ বা স্বজ্ঞা আছে। এই দর্শনে মনে করা হয়, প্রাণিজগতের সবার মধ্যে মানুষের অবস্থান অনেক বেশি মর্যাদাকর কেননা প্রাণিকুলের মধ্যে একমাত্র মানুষেরই বোধিপ্রাপ্তির ক্ষমতা রয়েছে। রুশোর ভাবনাতেও প্রাণিকুলের মধ্যে মানুষের বিশিষ্ট হয়ে ওঠার পেছনে তার চেতন বা স্বজ্ঞাকে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে দেখা যায়।

বুদ্ধ মানুষের ভাবনাকে কর্মের সাথে সমান্তরালে দেখেছেন। বুদ্ধের দর্শনে মানুষ আসলে তার ভাবনাসমূহের সমষ্টি। এজন্যে তিনি বলেছেন, মানুষ যা ভাবে, সে তা-ই হয়ে ওঠে। তাই সৎ ভাবনা ও সৎ কর্ম বুদ্ধের দর্শনের মৌলিক ভাবনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমরা দেখি, ধর্ম ও ভারতীয় লৌকিক দর্শনে মানবস্বভাব হিসেবে সদ্ভাবকে সবসময়ই সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে দেখা হয়েছে। বাঙ্গালি ধর্মগুরু ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রও (১৮৮৮-১৯৬৯) বুদ্ধের মতো সবসময় বলেছেন, 'সাধু সেজো না, সাধু হও'।

জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ নীৎশে (১৮৪৪-১৯০০) মনে করেছেন, মানুষ সবসময় নিজেকে উন্নততর করে তোলার পর্যায়ে অবস্থান করে; এখান থেকে সে ক্রমান্বয়ে উন্নততর হওয়ার চেষ্টা করতে পারে কিন্তু কখনোই এর সর্বোচ্চ অবস্থানে চূড়ান্তভাবে অবস্থান করে না। নীৎশের মতে, মানুষ যতোই উন্নততর হওয়ার চেষ্টা করে বা এমন অবস্থান অর্জনের দাবি করে, ততোই আসলে মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতি ও নিজের মানবসুলভ সত্তার অবনয়ন ঘটে। অর্থাৎ মানুষের বাহ্যিক যাবতীয় অর্জন আসলে মানুষের স্বভাবজাত অস্তিত্বকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তে (১৫৯৬-১৬৫০) মানুষকে একই সাথে চেতনা (মাইন্ড) ও কায়া (বডি) - ভিন্ন এ দুই অস্তিত্বের সমন্বয়ে গঠিত সত্তা হিসেবে দেখেছেন। দেকার্তে বিশ্বাস করতেন, একটি অস্তিত্ব রয়েছে মানে হলো এর পূর্বতন কোনো অস্তিত্ব ছিলো যা পরেরটিকে তৈরি করেছে। এই যুক্তিতে একজন পরিপূর্ণ সত্তা হিসেবে ‘ঈশ্বরের’ দ্বারা মানুষের সৃষ্টি হওয়ার পক্ষে সমর্থন মেলে যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও এর সাথে প্রাসঙ্গিকভাবে ধর্মানুসারে মানুষ ও মানবপ্রকৃতির ব্যাখ্যা হাজির হয়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) মনে করেছেন, মানুষের যে অবিচ্ছেদ্য বা অনিবার্য বৈশিষ্ট্য (মনুষ্যত্ব) মানুষকে ‘মানুষ’ করে তোলে, সেটিই মানুষের ধর্ম : মানবধর্ম। প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোকে তিনি কেবল 'লোকাচার' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের এই উদার মানবতাবাদী ধারণার প্রতিচ্ছবি মেলে কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) ভাবনাতেও; নজরুল ধর্মের ক্ষুদ্র পরিসরে মানুষকে না মেপে সবার মধ্যে তার 'মানুষ' পরিচয়টিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি যা মানুষকে সাম্যবাদী অস্তিত্বে রূপ দেয়।

মানুষের প্রকৃতি বিষয়ক দ্বৈতবাদের ধারণার সাথে পুরোপুরি অভিন্ন না হলেও এর সাথে মানুষের অস্তিত্ব বিষয়ে দেকার্তের ধারণার সামঞ্জস্য রয়েছে। দ্বৈতবাদের দর্শনে মনে করা হয়, দেহ (বডি) ও ব্যক্তিত্ব বা চেতনা (পারসন) - এই দুইয়ে মিলেই মানুষ। দেকার্তের ধারণার সাথে এখানে পার্থক্যটি হলো, তিনি চেতনাকে পুরোপুরি অনঙ্গ বা মনসিজ (মানসজাত বা মনসঞ্জাত) বিষয় হিসেবে বিবেচনা করেছেন কিন্তু দ্বৈতবাদের দর্শনে চেতনাকে ভাব (থট) বা স্বজ্ঞার (কনশাসনেস) মতো সম্পূর্ণরূপে মানসিক বিষয় হিসেবে দেখা হয়নি।

মানুষ সম্বন্ধে ইংরেজ দার্শনিক জন লক (১৬৩২-১৭০৪) থমাস হবসের বিপরীত ধারণা পোষণ করতেন। লকের মতে, মানবপ্রকৃতি নির্ধারিত হয় যুক্তি (রিজন) ও সহনশীলতা (টলারেন্স) দ্বারা। তবে হবসের মতো লকও মনে করেছেন, মানুষ সহজাতভাবেই স্বার্থবাদী হয়। অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন, মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটবার পর থেকে হবস ও লকের এই ধারণার পক্ষে জোরালো প্রমাণ মিলতে শুরু করেছে। একধারার চিন্তাবিদেরা বিশ্বাস করেন, মানুষের চারটি সহজাত অধিকার (ন্যাচারাল রাইটস) রয়েছে; লকের মতে এই চারটি অধিকার হলো : প্রাণ (লাইফ), স্বাধীনতা (লিবার্টি), সম্পত্তি (প্রপার্টি) ও মানবজাতির পরিরক্ষণ (প্রিজারভেশন অব ম্যানকাইন্ড)। লকের মতে, চতুর্থটি (মানবজাতির পরিরক্ষণ) মানুষের জন্যে প্রকৃতিদত্ত অধিকারগুলোর মধ্যে সবচাইতে মৌলিক।

জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার (১৮৮৯-১৯৭৬) অস্তিত্বের কাঠামোবদ্ধ সংজ্ঞা নিরূপণের চেয়ে বরং উত্তর খোঁজার দিকেই মনোযোগ দিয়েছেন বেশি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্যে তিনি সত্তা বা অস্তিত্বের প্রকৃতি সম্পর্কিত অধিবিদ্যার বিশেষ যুক্তি (অনটোলজি) চর্চাকেই মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। হাইডেগারের ভাবনায় তাই অস্তিত্বের (বিইং) সাথে কাল (টাইম) ও ইতিহাসের মেলবন্ধন ঘটেছে যেখানে মানবজাতির অস্তিত্বের প্রপঞ্চবাদী বিশ্লেষণ (ফেনোমেনলজিক্যাল অ্যানালিসিস) মুখ্য হয়ে উঠেছে। এজন্যে হাইডেগারের ভাবনায় অস্তিত্বের পাশাপাশি জীবনের অর্থ বা জীবনের প্রামাণিকতা এবং এসব অনুষঙ্গের ঐক্যের মাধ্যমে জীবনের সমগ্রতায় পৌঁছার মতো বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে।

স্বামী বিবেকানন্দ মানুষের জন্যে প্রচলিত ধর্মসমূহকে দুটি উপাদানে ভেঙ্গে দেখিয়েছেন : এক. লোকাচার, ও দুই. ধর্মের সার। তিনি দ্বিতীয়টিতেই (সার) বেশি বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, 'জীবে প্রেম'-ই হলো ঈশ্বরের সেবা। বিবেকানন্দের ভাবনায় তাই মানুষের প্রতি প্রেম বা ভ্রাতৃত্বের বোধই হলো মানুষের জীবনদর্শন। মহাত্মা গান্ধী (১৮৬৯-১৯৪৮) মনে করেছেন অহিংসা, সত্য ও সত্যনিষ্ঠা মানুষের জীবনের মূলমন্ত্র হওয়া দরকার।

চলবে...