Media School

Dhaka    Thursday, 26 December 2024

By সজীব সরকার

পৃথিবী আমার নয়, আমিই পৃথিবীর...

Media School June 28, 2021

পৃথিবী হোক সবার জন্যে কল্যাণকর। ছবি : waca.associates

বিবর্তনবাদীরা দেখিয়েছেন, বানর থেকে মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে শ্রমের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া 'আদিম মানুষ' থেকে ক্রমে 'আধুনিক ও বুদ্ধিমান' মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে দুই পায়ে ভর করে দাঁড়াতে শেখা, হাতের অন্য আঙুলের সাথে বুড়ো আঙুলের দূরত্ব বাড়া, আগুনের ব্যবহার শেখা, কৃষিকাজ ও পশুপালন শেখা ইত্যাদি বিষয়ও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এসব ঘটনার পাশাপাশি মানুষের মধ্যে 'আমিত্বের' বোধ জাগ্রত হওয়াটাও ঐতিহাসিকভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

উদ্বৃত্ত সম্পদ মানুষের মধ্যে 'আমরা' ও 'আমাদের'-এর পরিবর্তে 'আমি' ও 'আমার' - এই বোধকে উস্কে দিয়েছে; তবে মানুষ এর ভার সামলাতে পারেনি। দলগতভাবে বেড়ে ওঠা মানুষ এই 'আমিত্বের' দেয়াল তুলে পরিবারের মধ্যে থেকেও নিজেকে ক্রমেই নিঃসঙ্গ করেছে। এই আমি-কেন্দ্রিক চিন্তার কারণে একজন মানুষ অন্য মানুষের ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করে নিজে প্রবল হয়ে উঠতে চাইছে। পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র সবকিছুর ক্ষতিসাধন করে হলেও অধিকতর সম্পদ ও ক্ষমতা অর্জন করতে চায় সে। এজন্যে যে প্রকৃতির মাঝে তার বসবাস, সেই প্রকৃতিকেও সে নির্বিচারে তুচ্ছ জ্ঞান করছে।

কিন্তু এসবের পরিণতি কী?

এক ছাদের নিচে থেকেও মানুষ পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন। মানবীয় সম্পর্কগুলো গাছের চারার মতো; একে পরম যত্নে লালন-পালন করতে হয়। কিন্তু অর্থ-বিত্ত-খ্যাতি-ক্ষমতার পেছনে অন্ধের মতো ছুটে চলা মানুষ তার কাছের মানুষগুলোকে যে আসলে পেছনে ফেলে যাচ্ছে, তা দেখতে পায় না। ফলে অনিবার্যভাবেই অযত্নে ফেলে রাখা সম্পর্কগুলো দুর্বলতর হচ্ছে। কায়িক নৈকট্য থাকলেও মানুষে মানুষে মানসিক দূরত্ব বাড়ছে। রাষ্ট্রে-সমাজে-প্রতিষ্ঠানে এমনকি পরিবারের মধ্যেও সম্পর্কগুলো হয়ে উঠছে মূলত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। মানবীয় সম্পর্ক বা আবেগের চেয়ে 'বিনিময়মূল্য' ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে; আবেগীয় মিথষ্ক্রিয়া প্রতিস্থাপিত হচ্ছে বস্তুগত বিনিময়ের দ্বারা।

প্রবল থেকে প্রবলতর হওয়ার বাসনা মানুষের মনকে স্বার্থচিন্তার অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে। যার কিছু নেই, সে চায় সম্পদ গ্রাস করতে; আর যার সম্পদ আছে, সে গ্রাস করতে চায় পুরো পৃথিবীকে। তাই অন্যের অর্থ-সম্পদ-ক্ষমতা হস্তগত করে নিজে স্ফীত হতে মরিয়া মানুষ। শিশুদের খেলার মাঠ, খাল-নদী-সমুদ্র দখল করে চলছে স্ফীতিলাভের আয়োজন। এই স্ফীতি অসার; এতে সারবস্তু নেই। কিন্তু সেই বোধ কাজ করার মতো সংবেদনশীলতা মানুষের মস্তিষ্কে অবশিষ্ট নেই।

মানুষ যখন অনুভব করে 'পৃথিবীটা আমার', তখন সে এই পৃথিবীর প্রতিবেশ-পরিবেশ সবকিছুকে নিজের সম্পত্তি মনে করে। আর এর অনিবার্য পরিণতি হলো এসবের যথেচ্ছ ও ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার। মানবেতিহাসের শুরু থেকে মানুষের মধ্যে এই আমিত্ববোধের প্রাবল্য ছিলো না; তাদের ভাবনায় 'পৃথিবীটা আমার নয়, বরং আমিই পৃথিবীর' - এমন বোধই লালিত হয়ে এসেছে। এভাবে প্রকৃতি বা পৃথিবীর ওপর 'মালিকানা' বা কর্তৃত্বের নির্বুদ্ধিতায় নিমজ্জিত না থাকায় তারা প্রকৃতির কোনো ক্ষতি সাধন করেনি। একই বোধ এখনো লালন করছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আদিবাসী মানুষেরা- তথাকথিত 'উন্নত সভ্যতা' যাদের অন্তরাত্মাকে এখনো দূষিত করেনি। তাই একদিকে এই মানুষগুলো পরিবেশ ও প্রকৃতিকে লালন করে যাচ্ছে প্রাণের মায়ায়, অন্যদিকে 'সভ্যতা'র বিভ্রমে ঘোর লাগা বাকি মানুষেরা নিজের প্রাণের উৎসস্থল ও অস্তিত্বের মূল শর্তকেই অস্বীকার করে একে পরিণত করছে বিরানভূমিতে।

সম্পদের লোভ আর ক্ষমতার দাপট মানুষে মানুষে বিবাদ আর হানাহানি বাড়াচ্ছে; এমনকি একজনকে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছে। মানবীয় সম্পর্ক, আবেগ বা নিরীহ সোশ্যাল ক্যাপিটাল এখন অর্থহীন। সহিষ্ণুতাকে এখন দেখা হয় দুর্বলতা হিসেবে; বিনয়কে মনে করা হয় নির্বুদ্ধিতা। অথচ একে অন্যকে প্রতিযোগী না ভেবে সহযোগী হয়ে উঠলে, পৃথিবীকে নিজের গ্রাসযোগ্য সম্পদ না ভেবে নিজেকে পৃথিবীর অপার বিস্ময়ের অংশ হিসেবে স্বীকার করে নিলে এবং পরমতসহিষ্ণু হয়ে উঠলে পৃথিবীটা প্রকৃতই অনেক সুন্দর হতে পারতো; হতে পারতো মানুষসহ প্রকৃতির সব সৃষ্টির অভয়ারণ্য!

মানুষ একটি আপাদমস্তক স্ববিরোধী প্রাণী। মানুষই সম্ভবত একমাত্র প্রাণী, যে জেনে-বুঝেও নিজেই নিজের জন্যে ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমন মানবজাতির কালে কালে এই যে অস্তিত্বসঙ্কট, তা তো অনিবার্য!

মানবমনের এহেন বিভ্রম কাটুক; মানুষ হোক পৃথিবীর, আর পৃথিবী হোক সবার জন্যে নিঃশর্তভাবে কল্যাণকর।