By সজীব সরকার
ডিকয় ইফেক্ট (Decoy Effect)
Media School December 11, 2024
বেশি দামের পণ্যটি কিনতে ক্রেতাকে প্রলুব্ধ করতেই এমন `ডিকয়` ব্যবহার করা হয়।
সবার খুব পরিচিত একটি উদাহরণ দিয়েই এ আলোচনা শুরু করা যাক।
ধরুন, বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে গেছেন। সেখানে টিকিটের পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে গরম গরম পপকর্ন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখবেন, সেখানে পপকর্নের ৩টি ভিন্ন আকারের বাকেট থাকে : ছোট, মাঝারি ও বড়।
আপনি যেন ছোট বাকেট না কিনে বড় বাকেটটি কেনেন, এজন্য এ দুটোর মাঝখানে আরেকটি অপশন হিসেবে মাঝারি বাকেটটি যোগ করা হয়েছে; আর তাই মাঝারি এই বাকেটটি হলো একটি ডিকয় (decoy) বা ফাঁদ।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক।
ধরুন, পপকর্নের বাকেট কেবল ২টি : ছোট ও বড়। ছোটটির দাম ২০০ টাকা এবং বড়টির দাম ৩০০ টাকা। আপনি এখন তাহলে কোনটি কিনবেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা হয়তো ২০০ টাকার বাকেট কিনতে চাইবো। কারণ, দুটো বাকেটের দাম তুলনা করলে আমাদের কাছে ছোট বাকেটটি কেনাই যৌক্তিক মনে হবে। কিন্তু, বিক্রেতারা চাইবে আপনি যেন ৩০০ টাকায় বড় বাকেটটি কেনেন, কারণ এতে তাদের লাভ বেশি। এ কারণেই তারা ক্রেতাদের সিদ্ধান্ত বদলের জন্য তৃতীয় একটি অপশন (মাঝারি বাকেট অর্থাৎ ডিকয়) তাদের মেন্যুতে যোগ করেন।
আগে আমাদের হাতে অপশন ছিলো ২টি : ছোট বাকেট ও বড় বাকেট কিংবা ২০০ টাকা ও ৩০০ টাকা। এখানে আমাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব সহজ এবং দামের কথা ভেবে বেশিরভাগ ক্রেতাই কম দামে ছোট বাকেটটি কেনার সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু, দ্বিতীয় পর্যায়ে যখন মাঝারি বাকেটটি যোগ করা হলো, তখন ক্রেতাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খানিকটা কঠিন হয়ে পড়ে। ধরা যাক, ছোট বাকেটের দাম ২০০ টাকা, মাঝারি বাকেটের দাম ২৮০ টাকা এবং বড় বাকেটের দাম ৩০০ টাকা। এখন আপনি কী সিদ্ধান্ত নেবেন?
এ ক্ষেত্রে অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে পড়েন। অনেকের কাছে মনে হয়, ২৮০ টাকা দিয়ে মাঝারির চেয়ে ৩০০ টাকায় বড় বাকেটেই তো অনেক বেশি লাভ! ফলে, অনেকেই তখন বড় বাকেট কেনার সিদ্ধান্ত নেন।
তাহলে, প্রথম উদাহরণে আমাদের তুলনাটি হয় ছোট আর বড়র মধ্যে; অর্থাৎ, পপকর্নের পেছনে ২০০ টাকা খরচ করবো, না কি ৩০০ টাকা - এটি থাকে প্রশ্ন। কিন্তু, দ্বিতীয় উদাহরণে ৩টি বাকেটের মধ্যে ২০০ টাকায় ছোট বাকেটের কথাটি আমরা সহজেই আমাদের অপশনের তালিকা থেকে বাতিল করে দিই; আমরা তখন চিন্তায় পড়ে যাই মাঝারি আর বড় বাকেট নিয়ে। আমাদের ভাবনায় তখন কাজ করতে শুরু করে- ২০ টাকা কমে মাঝারি বাকেট নেবো, না কি ২০ টাকা বাড়তি যোগ করে সবচেয়ে বড় বাকেটটাই নেবো যেটাতে ২০ টাকার তুলনায় পপকর্নের পরিমাণ অনেক বেশি।
তাহলে, তৃতীয় অপশন হিসেবে মাঝারি আকারের বাকেট যোগ করার কারণে ২০০ টাকাতেই পপকর্ন কেনা যেতো- এই ভাবনাই আর আমাদের মনোজগতে থাকে না; মাঝারি আর বড় বাকেটের মধ্যে কোনটি আমাদের জন্যে লাভজনক - আমরা অর্থাৎ ক্রেতারা তখন সেটিই তুলনা করি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৩০০ টাকা খরচ করে বড় বাকেটটিই কেনার সিদ্ধান্ত নিই। এটিই হলো ডিকয় ইফেক্ট।
মাঝারি বাকেট বিক্রি করা বিক্রেতাদের উদ্দেশ্য নয়; মেন্যুতে অপশন হিসেবে মাঝারি বাকেট যোগ করার পেছনে তাদের আসল উদ্দেশ্য হলো কম দামের ছোট বাকেট থেকে ক্রেতার মনোযোগ সরিয়ে বেশি দামের বড় বাকেটটি বিক্রি করা। অর্থাৎ, মাঝারি বাকেটটি আসলে এখানে একটি ফাঁদ বা ডিকয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এখানে খেয়াল করলে দেখবো, ছোট বাকেটের পরিমাণের সঙ্গে মাঝারি বাকেটের খাবারের পরিমাণ ও দামের পার্থক্য - দুটোই অনেক বেশি। কিন্তু, মাঝারি বাকেটের সঙ্গে বড় বাকেটের খাবারের পরিমাণের তুলনায় দামের পার্থক্য বেশ কম। আর, এ কারণেই ক্রেতারা সবচেয়ে বড় বাকেটটি কিনতে প্রলুব্ধ হন।
আরেকটি উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক :
ছোট গ্লাস বা ২০০ মিলি সফট ড্রিংক = ৮০ টাকা
বড় গ্লাস বা ৩০০ মিলি সফট ড্রিংক = ১৫০ টাকা
- এখানে বেশিরভাগ ক্রেতাই ৮০ টাকায় ছোট গ্লাস কিনতে চাইবেন। কেননা, ১০০ মিলি বেশির জন্য তারা ৭০ টাকা বেশি খরচ করতে চাইবেন না। এ ছাড়াও, ১৫০ টাকা আর ৮০ টাকার মধ্যে ৮০ টাকা খরচ করাই সাশ্রয়ী মনে হবে।
কিন্তু :
ছোট গ্লাস বা ২০০ মিলি সফট ড্রিংক = ৮০ টাকা
মাঝারি গ্লাস বা ২৫০ মিলি সফট ড্রিংক = ১৪০ টাকা
বড় গ্লাস বা ৩০০ মিলি সফট ড্রিংক = ১৫০ টাকা
- এখানে অনেক ক্রেতাই ৮০ টাকায় ২০০ মিলির গ্লাসের অপশনের চেয়ে অন্য দুটিকে (মাঝারি ও বড় গ্লাস) নিয়ে ভাববেন বেশি। এখন তুলনার চিত্র বদলে যাচ্ছে : ১৪০ টাকায় ২৫০ মিলির চেয়ে মাত্র ১০ টাকা বাড়তি যোগ করেই আরো ৫০ মিলি বেশি পাওয়া যাচ্ছে - অনেকের কাছে বিষয়টি অনেক বেশি লাভজনক মনে হবে। ফলে, অনেক ক্রেতাই তখন ছোট গ্লাসের অপশন বিবেচনায় না নিয়ে মাঝারি আর বড় গ্লাসের মধ্যে তুলনা করে 'বেশি লাভজনক' মনে করে শেষ পর্যন্ত ১৫০ টাকায় ৩০০ মিলির বড় গ্লাসটিই কেনার সিদ্ধান্ত নেবেন।
ফাস্ট ফুডের দোকানগুলোর মেন্যুতে বিশেষ করে তাদের 'প্যাকেজ' বা 'মিল' অপশনগুলোতে হরহামেশাই এমন 'ডিকয়' দেখা যায়। যেমন ধরা যাক : আলাদা করে এক পিস ফ্রাইড চিকেনের দাম ১০০ টাকা, এক গ্লাস ড্রিংকের দাম ৮০ টাকা আর ১ প্যাকেট ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের দাম ১৫০ টাকা। আপনার মূল উদ্দেশ্য হয়তো ১০০ টাকা খরচ করে একটি চিকেন খাওয়া। কিন্তু, চিকেন+ড্রিংক যদি ১৫০ টাকা দাম হয়, তাহলে হয়তো আপনি মনে করবেন- শুধু চিকেন না কিনে এই প্যাকেজ কিনলে ৮০ টাকার ড্রিংক ৫০ টাকায় পাওয়া যাবে। অথচ, আপনার হয়তো ১৫০ টাকা খরচ করার ইচ্ছেই ছিলো না।
এভাবে, শুধু একটি আইটেমের বদলে চিকেনের সঙ্গে বা ড্রিংকের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের প্যাকেজ মূল্য বেশ কম মনে হবে আপনার কাছে; এ কারণে কম খরচে একটি আইটেম না কিনে আপনি হয়তো একটি প্যাকেজ বা মিল অপশন বেছে নিলেন। কতো টাকা খরচ করবেন - এ ব্যাপারে আপনার যে সিদ্ধান্ত, তা থেকে আপনাকে বের করে এনে বাড়তি খরচ করানোই বিক্রেতাদের উদ্দেশ্য কেননা এতেই তাদের লাভ বেশি। এজন্যেই বিক্রেতারা ক্রেতাদের বাড়তি পয়সা খরচে প্রলুব্ধ করতে ডিকয়-এর মতো নানা কৌশল অবলম্বন করে।
অন্য উদাহরণে যদি দেখি :
একটি ব্র্যান্ডের নির্দিষ্ট একটি মডেলের ফোন হয়তো ২টি অপশনে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন :
অভিন্ন ফিচার+১২ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা = ১৭ হাজার টাকা
অভিন্ন ফিচার+১৬ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা = ২০ হাজার টাকা
- এখানে অনেকেই ৩ হাজার টাকা বেশি খরচ করে হয়তো ১৬ মেগাপিক্সেল ক্যামেরার ফোনটিই কিনবেন। অথচ, সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য আসলে ১২ বা ১৬ মেগাপিক্সেল ক্যামেরায় কার্যত কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু, ওই ফোন কোম্পানি ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে ক্যামেরায় ৪ মেগাপিক্সেল বেশি দিচ্ছে- এর কারণ হলো, তারা চায় আপনি ৩ হাজার টাকা বেশি খরচ করে দ্বিতীয় অপশনটিই যেন বেছে নেন। অর্থাৎ, আপনার কাছে তারা ১৭ হাজার টাকার নয় বরং ২০ হাজার টাকার ফোনটিই বিক্রি করতে চায় কারণ এতে তাদের লাভ বেশি।
এখন প্রশ্ন হলো, ৪ মেগাপিক্সেল বেশি পেতে ৩ হাজার টাকা বাড়তি খরচ করা কি ক্রেতার জন্য আসলে খুব লাভজনক হলো?
ভালো মানের ছবির জন্যে পিক্সেলই একমাত্র বিষয় নয়; এর সঙ্গে যে ক্যামেরার পিক্সেল ছাড়াও সেন্সর, শাটার স্পিড, লেন্স, শার্পনেস, ফোকাস, ফ্রেমিং, কম্পোজিশন, লাইট, ডেপথ - এমন আরো অনেক বিষয় সম্পর্কিত, অনেকের হয়তো এসব বিষয়ে স্পষ্ট ধারণাও নেই। তাহলে, এমনও হতে পারে- ক্যামেরা ৮ বা ১০ কিংবা ১২ মেগাপিক্সেল হয়তো আমার খুব কাজের বিষয় নয়; বরং, ক্যামেরার স্টোরেজ বা প্রসেসরের গতি বাড়তি পেতে ৩ হাজার টাকা বেশি খরচ করলে হয়তো আমার বেশি কাজে লাগতো। ক্যামেরা, স্টোরেজ বা প্রসেসর - কার কোনটি বেশি দরকার, তা নির্ভর করে ব্যবহারের ধরনের ওপর; সবার সবকিছু দরকার পড়ে না। কিন্তু, এ উদাহরণে, অন্যটির চেয়ে মেগাপিক্সেল বেশি হওয়ার বিষয়টিকে এখানে ডিকয় হিসেবে ব্যবহার করার কারণে ক্রেতা হিসেবে অনেকেই এর ফাঁদে পড়বেন এবং 'বেশি মেগাপিক্সেল মানেই বেশি ভালো' মনে করে হয়তো বাড়তি ৩ হাজার টাকা এখানে খরচ করতে রাজি হবেন।
তাহলে, এমন ডিকয়ের কারণে প্রলুব্ধ হয়ে ক্রেতারা নিজের সিদ্ধান্ত বদল করে এই যে বিক্রেতাদের উদ্দিষ্ট পণ্যটিই কেনেন, এটিই হলো ডিকয় ইফেক্ট। এটি ক্রেতাদের বেশি দামের জিনিস কেনার ফাঁদে ফেলতে মার্কেটিংয়ের বহুল ব্যবহৃত একটি কৌশল।
ডিকয় ইফেক্ট বা ক্রেতাদের এমন পরিবর্তিত আচরণকে একটি পক্ষপাত বা বায়াস (bias) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।