By সজীব সরকার
জাতীয় সংকটকালে গণমাধ্যমের ভূমিকা
Media School July 31, 2024
ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত না-ও হতে পারি, কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমি আমার জীবন উৎসর্গ করতে পারি।’ গণতন্ত্র ও পরমতসহিষ্ণুতার পক্ষে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ আর হতে পারে না। গণমাধ্যমের উচিত সরকার ও জনসাধারণের মধ্যে এমন আস্থা, উদারতা ও সহিষ্ণুতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। তাহলে নিদারুণ সংকটকালেও সংঘাত এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান সহজ হতে পারে।
কবি জীবনানন্দ দাশ সেই কবে লিখেছিলেন, ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ।’ এমন আঁধার সময় যুগে যুগেই ফিরে আসে। এটি অনিবার্য। কিন্তু, এমন কঠিন সময়ে গণমাধ্যমকেই যুক্তি ও সহিষ্ণুতার আলোক-মশাল নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশ ও দশের প্রতি এটিই গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় দায়।
মানুষ সাধারণত কোনো ঘটনা বা বিষয় সম্বন্ধে সঠিক তথ্য ও বিস্তারিত জানতে গণমাধ্যমের দ্বারস্থ হয়। তবে গণমাধ্যমের কাজ শুধু তথ্য সরবরাহ করা নয়। বিশেষ করে জাতীয় সংকটকালে গণমাধ্যমের দায়িত্ব বেড়ে যায় আরও বহুগুণ। অস্বাভাবিক, অশান্ত বা সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমের বড় একটি দায়িত্ব হলো ওই সংকট নিরসনের পক্ষে সহায়ক ভূমিকা নেওয়া।
সংকটময় পরিস্থিতিতে দ্বন্দ্বে লিপ্ত পক্ষগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক ও আস্থার সম্পর্ক নষ্ট হয়। ফলে খুব সহজেই সেখানে পরস্পরকে অবিশ্বাস ও আক্রমণের প্রবণতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে এমন সময়ে সাংবাদিকদের উচিত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের মধ্যে স্বাভাবিক যোগাযোগের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দেওয়া। এতে তারা নিজেদের মধ্যে সহজ ও স্বাভাবিক উপায়ে যোগাযোগ করতে পারবে। আর যোগাযোগশাস্ত্রে বলা হয়, স্বাভাবিক যোগাযোগ বজায় থাকলে কেবল আলোচনার মাধ্যমেই বড় বড় দ্বন্দ্বের সমাধান সম্ভব।
বাংলাদেশে চলমান সংঘাত-সহিংসতার অভিজ্ঞতাতে বস্তুনিষ্ঠভাবে বিচার করলে দেখা যাবে, দেশের কিছু কিছু গণমাধ্যম তাদের সঠিক ভূমিকা পালনে অনেকখানিই ব্যর্থ হয়েছে। চাকরিতে ‘কোটা সংস্কার’ ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের মাঠে নামার সময় থেকে এখন অবধি অনেক গণমাধ্যম তাৎক্ষণিক, অসম্পূর্ণ, একপেশে ও পক্ষপাতমূলকভাবে সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করে যাচ্ছে।
শুরু থেকেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সহজ ও স্বাভাবিক যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা গণমাধ্যমে দেখা যায়নি। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি ক্রমশ আন্দোলনে রূপ নেওয়া এবং এরপর একটি অপশক্তির হস্তক্ষেপে খুব দ্রুতই সেটি ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে পরিণতি পাওয়ার ঘটনাক্রমের মধ্যে গণমাধ্যমগুলোর একটি দায়িত্বশীল ও শক্তিশালী ভূমিকা পালনের সুযোগ ছিল। চলমান পরিস্থিতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও সরকারকে একটি আস্থার জায়গায় আনতে পারলে ‘তৃতীয় শক্তির’ এমন ধ্বংসাত্মক উত্থান হয়তো ঠেকানো যেত।
কিন্তু অনেক গণমাধ্যম এ ঘটনার সুদূরপ্রসারী প্রভাব এবং বিশেষ করে সমাসন্ন সংঘাতের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেনি। কোটা সংস্কার ইস্যুতে সরকারের প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থাহীনতা দূর করা এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারের ইতিবাচক ও কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করার ব্যাপারে গণমাধ্যমের সচেতন কোনো প্রচেষ্টা শুরু থেকেই দৃশ্যমান ছিল না।
আন্দোলন-সংঘাতের পুরো সময় গণমাধ্যমগুলো কেবল ঘটনাস্থল থেকে ‘দৃশ্যমান’ খবর প্রচার করেছে; ‘খবরের পেছনের খবর’ কিংবা ‘ঘটনার ভেতরের ঘটনা’ তুলে আনার যে সত্যিকার সাংবাদিকতা, তা কিন্তু আমরা দেখিনি।
যেকোনো সহিংসতায় দেখা যায়, আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলো ঘটনাস্থল থেকে সেখানকার খবর জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সবকিছু ‘লাইভ’ বা সরাসরি দেখাতে শুরু করে। কোথায় কী ঘটছে–সাংবাদিকতার গণ্ডি কেবল ওইটুকুতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। চলমান সংকটের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে।
অনেক গণমাধ্যমই একটি বিষয় বুঝতে পারে না, অথবা ভুলে যায়–যারা ভাঙচুর করে, সহিংস তাণ্ডব বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়, তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ‘মিডিয়া কাভারেজ’। গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে তারা নিজেদের শক্তির জানান দিতে পারে খুব সহজেই।
সংকটকালে দেখা যায়, দেশের গণমাধ্যমগুলো মোটা দাগে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে–কেউ নির্বিচারে সরকারের পক্ষে খবর প্রচার করে, আর কেউ সরকারের বিপক্ষে। এর কোনোটিই সাংবাদিকতা নয়। সাংবাদিকতার মৌলিক ব্যাকরণ বা নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এটি। ঘটনার নির্মোহ বা বস্তুনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণ, সংঘাতের আশঙ্কা থাকলে সেটি তুলে আনা, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সুস্থ ও ইতিবাচক আলোচনায় আগ্রহী করা, জনগণকে আতঙ্ক ও ক্ষতি থেকে দূরে রাখা এবং সর্বোপরি, সংঘাত ছাড়াই বিদ্যমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্যে সরকারসহ সবার ওপর চাপ সৃষ্টি করা সংকটকালে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
যেকোনো সংকট-সংঘাতের সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা ধরনের ধারণা তৈরি হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো শুরু হয়। এতে জনমনে ভুল ধারণা বাড়ে, আতঙ্ক বাড়ে এবং সংকট দীর্ঘায়িত ও সহিংস হয়। এ ব্যাপারেও গণমাধ্যমকে সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। নির্বিচার আবেগ ও যুক্তির মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করতে না পারলে এ ধরনের সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। এখানেও গণমাধ্যমকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে।
কোটা ইস্যুতে চলমান পরিস্থিতিতে দেশের পুরোনো ও জনপ্রিয় গণমাধ্যমগুলোতে যেমন এমন দায়িত্বশীলতার অভাব দেখা গেছে, তেমনি সিনিয়র সাংবাদিকদের অনেকে একপেশে আবেগ থেকে নানা ধরনের মতামত-মন্তব্য দিয়েছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেলিব্রিটিদের মধ্যেও অনেকে একতরফাভাবে নানা মন্তব্য করেছেন। আমরা হয়তো একটি বিষয় নির্মোহভাবে দেখতে ব্যর্থ হচ্ছি–দেশের যে কেউ যেকোনো কিছু দাবি করতে পারেন; কিন্তু সবসময় সবার সব দাবি মেনে নেওয়া সম্ভবও নয়, যৌক্তিকও হয়তো নয়। কিন্তু দাবি জানানোর নিরাপদ ও অবাধ পরিবেশ পাওয়া যে কারও অধিকার। দাবি মানা না গেলেও বা এর সঙ্গে একমত হতে না পারলেও কোনো কিছুর দাবি জানানো ব্যক্তির ওপর অন্য কেউ আক্রমণ চালাতে পারবে না। এটিই গণতন্ত্র।
গণতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী একটি দেশে একজন মানুষও সংঘাতে-সহিংসতায় মারা যাবে না; কোনো দাবিতে অবস্থান নেওয়া কেউ না, আন্দোলনকারী না, শিক্ষার্থী না, শিশু না, পথচারী না, সরকারি দায়িত্ব পালনকারী না। রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের সম্পদের কোনো ধরনের ক্ষতি এমন দেশে হতে পারবে না। সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় কেউ আক্রমণ করতে পারবে না। এজন্যে, দ্বন্দ্বের একেবারে শুরুতেই সংঘাত এড়ানোর মতো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ দায় সরকারের একার না, অথবা জনগণের একার না; এ দায় দুজনেরই।
আর, এখানেই আসে গণমাধ্যমেরও দায়ের প্রশ্ন; যেকোনো দাবির যৌক্তিক ও স্বাধীন প্রকাশযোগ্যতা এবং সংঘাতের ঝুঁকি এড়িয়ে দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সব পক্ষকে একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা গণমাধ্যমেরই দায়িত্ব। সাধারণ জনগণসহ সব পক্ষের সঙ্গে সরকারের সেতুবন্ধন গড়ে দেওয়া এবং আপৎকালে জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়াই গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
গণমাধ্যমগুলো যথাযথভাবে এ দায়িত্ব পালন করতে পারলে কোনো অপশক্তিরই উত্থান খুব সহজ হবে না।
*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ইনডিপেনডেন্ট ডিজিটাল-এ, ২৮ জুলাই ২০২৪। সম্পাদকীয় বিভাগের মৌখিক অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।