Media School

Dhaka    Thursday, 26 December 2024

By নুসরাত জাহান

করোনা ও ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’

Media School July 1, 2020

নুসরাত জাহান

করোনা নামক ভয়াবহ ছোঁয়াচে এক ভাইরাসের আকস্মিক আঘাতে সারা বিশ্ব আজ প্রায় চার মাস ধরে কার্যত অচল হয়ে আছে। বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। পরিস্থিতির অবনতি হলে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং পরে ২৬ মার্চ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে গণপরিবহন। পরবর্তী সময়ে জনগণের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের একের পর এক জেলা লকডাউন ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছে সরকার।

এ পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি অবস্থায় রয়েছে দেশের জনশক্তির একটি বড় অংশ। এদের মধ্যে অনেকেই রয়েছেন, যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে জীবনযাপন করেন; তারা বর্তমানে শুধু অলস সময়ই কাটাচ্ছেন না, তাদের রোজগারের পথটিও এখন বন্ধ। দীর্ঘমেয়াদে আছে কাজ হারানোর আশঙ্কাও।

সরকার থেকে প্রায় প্রতিদিনই প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক এ কর্মীদের ভবিষ্যত সুরক্ষায় বিভিন্ন পরিমাণ ও মেয়াদের প্রণোদনা ঘোষণা করাসহ ‘দিন আনে দিন খায়’ ব্যক্তি ও তার পরিবারের জন্যে নিয়মিত ত্রাণ সরবরাহের সার্বিক ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যার সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করা গেলে এসব মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে হবে অনেক বড় উপকার। এছাড়া দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখাসহ অন্য যেসব খাত ভয়াবহ এ দুর্যোগে ভবিষ্যতে গভীর সঙ্কটে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যেসব নিয়েও হচ্ছে আলোচনা ও সে অনুযায়ী নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ।

এ সবকিছুই আশার সঞ্চার করে, অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু এর সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্তমান প্রেক্ষাপটে দৃশ্যমান এবং এর গুরুত্ব মোটেও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কারণ দীর্ঘমেয়াদে এটিও দেশে একটি বড় প্রতিঘাত সৃষ্টি করবে বলেই সবার আশঙ্কা। বিষয়টি হচ্ছে ‘বিষণ্ণতা’! সহজাত কারণেই একটানা ঘরে অবস্থান করা মানুষের স্বভাবের মধ্যে নেই। ফলে বদলে যাওয়া এ বিশ্ব পরিস্থিতিতে গৃহবন্দি মানুষ ইতিমধ্যে আরও একটি অসুখে আক্রান্ত এবং তা হলো এই বিষণ্ণতা। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে লকডাউনের কারণে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ঘরবন্দি যা তাদের মধ্যে গুরুতর মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করছে এবং এ স্বাস্থ্যঝুঁকি করোনাসৃষ্ট অর্থনীতির বিপদকে আরও বাড়িয়ে দেবে (সূত্র : প্রথম আলো, ১৭ এপ্রিল ২০২০)। এছাড়া একই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বে গৃহবন্দি মানুষের সংখ্যা ২৬০ কোটি এবং এ ক্ষেত্রে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পরই বাংলাদেশের অবস্থান।

দীর্ঘসময় ঘরে আটকে থাকা মানুষের মধ্যে সৃষ্ট মানসিক সমস্যার নজির কি এরইমধ্যে আমরা বাংলাদেশে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনায় দেখছি না? ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গ্রামবাসীর দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ থেকে একজনের কাটা পা নিয়ে উল্লাস, এক ব্যক্তির ফেসবুক লাইভে এসে স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা, করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফনে বাধা দেওয়া, করোনা রোগীর সেবা দেওয়া চিকিৎসক ও নার্সদের বাড়িওয়ালা কর্তৃক বাসা ছাড়ার নির্দেশ এবং সর্বশেষ করোনা আক্রান্ত সন্দেহে বৃদ্ধ মাকে সন্তানদের জঙ্গলে ফেলে আসার মতো অচিন্ত্যনীয় ঘটনা এরইমধ্যে দৃশ্যমান। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ হতাশা থেকে এমনকি আত্মহত্যার ইচ্ছার মতো অপ্রত্যাশিত কথাও উল্লেখ করছেন; মনোবিদদের মানুষ জানাচ্ছেন তাদের অনিদ্রা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, হতাশা, বিষণ্ণতা, উগ্র মেজাজ আর অবসাদের কথা। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাসহ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুঃশ্চিন্তাই এসব মানসিক সমস্যার কারণ, নিঃসন্দেহে।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশ যেখানে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র বহু লোকের বসবাস; যেখানে অর্থনৈতিক থেকে সামাজিক - প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে নিরাপত্তার ব্যাপক অভাব; যেখানে মৌলিক চাহিদা পূরণ করতেই সমাজের প্রায় প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষকে প্রতিনিয়ত ব্যাপক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়; যেখানে অধিকাংশেরই শারীরিক অসুখের যথাযথ সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই বা থাকলেও এর পেছনে ব্যয় করতে হয় উপার্জনের বড় একটি অংশ, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া তো দূর, এ নিয়ে চিন্তা করাও বর্তমান সমাজে অনেকের কাছেই ‘গরিবের ঘোড়া রোগের’ মতো!

তাছাড়া আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা তেমন সহজলভ্যও নয়। এ নিয়ে নেই যথেষ্ট প্রচার-প্রচারণা; তৃণমূল পর্যায়ে এ ধরনের সেবার কথা শোনা যায় না বললেই চলে। ফলে গ্রামের অধিকাংশ অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত এমনকি অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষের কাছেও মানসিক রোগের চিকিৎসা মানেই ওই ব্যক্তির গায়ে ‘পাগল’-এর তকমা জোটার আশঙ্কা (!) যা তাদের এ সেবা নিতে আরও বিমুখ করে আসছে বহুকাল ধরে।

এ অবস্থায় বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের জন্যে এক বিরাট অশনিসঙ্কেত। এ দুর্যোগ থেকে দেশবাসীকে রক্ষায় তাদের শারীরিক রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ভবিষ্যত অর্থনৈতিক মন্দা সামলাতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নীরবে ঘটে যাওয়া মানসিক এ পরিবর্তনের দিকেও সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দেশের গণমাধ্যমগুলো হতে পারে সরকারের নির্ভরযোগ্য সহযোগী।

বর্তমানে গণমাধ্যমে যেভাবে প্রতিনিয়ত করোনাভাইরাসমুক্ত থাকতে এ সংক্রান্ত নির্দেশনাগুলো প্রচার ও প্রকাশ করা হচ্ছে, একইভাবে গৃহবন্দিত্বের অস্বাভাবিক এ সময়টিতে মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও প্রতিনিয়ত সহজবোধ্য করে প্রচার ও প্রকাশের পাশাপাশি এ সংক্রান্ত সেবার পরিধি ব্যাপকভাবে বাড়ানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তা শুধু রাজধানী বা বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে দায়সারা গোছের কাজ করলে হবে না; বরং দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে গ্রাম-পাড়া-মহল্লা এমনকি দুর্গম এলাকাগুলোকেও এ সেবার আওতায় নিয়ে আসার বিষয়টি সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

এক্ষেত্রে প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা এনজিওগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে, যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভুক্তভোগীর জন্যে এ সেবা নিশ্চিত করবে। তবে এ সংক্রান্ত তথ্য এমনভাবে প্রচার ও প্রকাশ করতে হবে যেন তা মানুষের মনে আস্থা তৈরি করে। অর্থাৎ এটি যে একটি গুরুতর সমস্যা এবং এর ভবিষ্যত পরিণতি যে ব্যক্তি থেকে শুরু করে তার পরিবার এমনকি সমাজ ও রাষ্ট্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এ বোধটি মানুষের মধ্যে জাগাতে হবে। একইসঙ্গে মানসিক সেবা নেওয়া যে সবার জন্যই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, এ বার্তাটিও মানুষের মধ্যে এমনভাবে পৌঁছে দিতে হবে, যেন এর গুরুত্ব অনুধাবন করাসহ এ সংক্রান্ত সেবা নিতে তারা উৎসাহী ও উদ্যোগী হয়।

একটি দুর্যোগের রয়েছে হাজারো রকমের পরিপ্রেক্ষিত যার অধিকাংশ ফলাফলই সুখকর নয়। তাই এক্ষেত্রে সব বিষয়কে সমান গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাওয়া তথা প্রতিটি ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এবং যথাযথভাবে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্র নিশ্চিত করার মধ্যেই রয়েছে এ থেকে পরিত্রাণের প্রধান উপায়। যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সফলভাবে তা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে চলমান এ উদ্যোগ থেকে দেশবাসীকে উদ্ধার করবেন, এ আশাই দেশের প্রতিটি জনগণের।

নুসরাত জাহান : লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

[লেখাটি ২৬ এপ্রিল ২০২০ আমাদের সময় পত্রিকায় 'করোনা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা' শিরোনামে প্রকাশিত হয়; মূল লেখা থেকে ইষৎ পরিবর্তিত।]