Media School

Dhaka    Saturday, 23 November 2024

By সজীব সরকার

করোনাভাইরাস : শতভাগ লকডাউন ছাড়া সমাধান মিলবে না

Media School July 4, 2020

নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এখন পর্যন্ত লকডাউন কার্যকর করাই সঠিক ব্যবস্থা বলে মনে হচ্ছে। ফলে বিশ্বজুড়ে এ ব্যবস্থাই নিচ্ছে প্রায় সব দেশ ও অঞ্চল। তবে সব জায়গায় এই লকডাউন এক ও অভিন্ন উপায়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে না; কোথাও খুব কড়াভাবে মানা হচ্ছে, আবার কোথাও লকডাউন চলছে কিছুটা শিথিলভাবে। কিন্তু লকডাউন কার্যকর করতে কোনো ধরনের শৈথিল্যের সুযোগ রয়েছে কি? আংশিক লকডাউন কি আসলে লকডাউনের উদ্দেশ্য (সংক্রমণ ঠেকানো) পূরণ করবে?

যে চীন দেশে এই ভাইরাসের ‘উৎপত্তি’, সেই দেশের অবস্থা যতটা খারাপ হবে বলে মনে হচ্ছিল, আদতে তা হয়নি। করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণস্থল চীনের উহানে সবচেয়ে বেশি দুরবস্থা ছিল; সেখানে অবস্থা যখন প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে, কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তখন সেখানে একেবারে শতভাগ লকডাউন কার্যকর করা হয়। এর ফলে কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে নতুন সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হয়।

চীনে সংক্রমণের খবর পাওয়ার পর বিশ্বের গুটিকয় দেশ ও অঞ্চল একজনের মধ্যেও সংক্রমণ না থাকার পরও তাৎক্ষণিকভাবে শতভাগ লকডাউন ঘোষণা করে; প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করে বিশেষ প্রয়োজনে বাসা থেকে অফিসের কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেইসব দেশ ও অঞ্চল তাদের এই সিদ্ধান্তের সুফল পেয়েছে। কাছের দেশ শ্রীলঙ্কাও একেবারে গোড়াতেই দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে।

এর বিপরীতে আমরা দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি ‘ভাইরাসের সম্ভাব্য প্রকোপের’ ব্যাপারে সতর্ক করে আসছিল বলে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অনেক সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে। কিন্তু আজন্ম গোঁয়ার ট্রাম্প এ সতর্কবাণীকে অন্যান্য বিষয়ের মতোই স্বভাবসুলভ তাচ্ছিল্য করেছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করার পরও ট্রাম্প তাচ্ছিল্য করে বলেছেন, ‘চীনের তৈরি’ এ ভাইরাসে আমেরিকার মতো (বনেদী?) দেশের কিছুই হবে না। এর পরিণতি কিছুদিনের মধ্যেই দৃশ্যমান হয়েছে; বিশ্বে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ও সর্বোচ্চ মৃতের তালিকায় এখন যুক্তরাষ্ট্রের নাম এক নম্বরে।

এ অবস্থায় সৃষ্ট চাপে বাধ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে লকডাউনের মতো ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত নিলেও তা শতভাগ প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি; প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতোই দেশটির নাগরিকরাও যথেষ্ট উদাসীনতা দেখিয়েছেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে। ‘আমেরিকানিজমের’ সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা নাগরিকরা রোজকার মতোই অফিস-রেস্টুরেন্ট-পার্টি-সমুদ্র বিলাসে মেতে ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে কেন ও কীভাবে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে এবং অল্প সময়ে এতটা ছড়িয়ে পড়েছে—বিষয়টি শুরু থেকে একবার দেখে নেওয়া যাক।

করোনাভাইরাসের খবর পাওয়ার পর চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে প্রবাসীরা মূলত মার্চ থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে শুরু করেন। ফিরে আসা ব্যক্তিদের তখন থেকেই শতভাগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানে যথাযথভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখা উচিত ছিল। এরপর প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চিকিৎসা দিয়ে তাদের সুস্থতার ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই কেবল বাড়ি ফিরতে দিতে হতো। এমনটি করা হলে এ ভাইরাস গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়তো না। কিন্তু তা করা হয়নি; বিদেশ থেকে সংক্রমিত হয়ে ফিরে আসা ব্যক্তিদের থেকে অন্যদের মধ্যে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে প্রথমেই যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে বরং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর প্রতিকারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এটিই ছিল আমাদের প্রথম ও সবচেয়ে বড় ভুল।

এ ছাড়া আকাশ-জল-সড়কপথে যেসব প্রবেশদ্বার ব্যবহার করে প্রবাসীরা বাংলাদেশে ফিরেছেন, তাদের পরীক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত কেন, বলা চলে, একেবারেই কোনো প্রস্তুতি আমাদের ছিল না। কয়েক মাস আগে থেকে চীনসহ অন্য দেশগুলোতে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে দেখার পরও আমরা সেই প্রস্তুতি নেইনি; আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা এজন্যে দায় এড়াতে পারে না।

পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় একেবারে শুরুর দিকে বিদেশফেরতদের মধ্যে আক্রান্তরা অনেকেই নির্বিঘ্নে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গেছেন এবং তাদের মাধ্যমে নানা এলাকায় নতুন সংক্রমণ ঘটেছে। পরে যখন পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলো, তা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য এবং সেখানে পরীক্ষা হয়েছে দায়সারা গোছের; এর মধ্যেও আবার অনেক জায়গায় সরবরাহ করা উপকরণ ছিল নষ্ট।

এখানেই শেষ নয়; ওইসব প্রবেশদ্বারে দায়িত্বরতদের কেউ কেউ বিদেশ থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে ‘সন্দেহভাজন আক্রান্তদের’ ছেড়ে দিয়েছেন নগণ্য অঙ্কের টাকার বিনিময়ে; টাকা দিলে অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা ছাড়াই তাদের ‘সুস্থ’ ঘোষণা করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে—এমনও জানা গেছে।

পরবর্তী সময়ে প্রবাসীরা দেশে ফেরার পর তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখা শুরু হয়। কিন্তু এ নিয়ে শুরু হয় আরেক বিপত্তি; প্রবাসীরা সেখানে কতটা ‘কষ্টে আছেন আর কতোটা মানবেতর জীবনযাপন করছেন’, তা নিয়ে গুঞ্জন ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনসাধারণ এ নিয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের নিন্দায় মাতেন; অনেক গণমাধ্যমও সেই স্রোতে গা ভাসায়। সেখানে যে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ছিল না, তা কেউ কখনোই অস্বীকার করেনি; কিন্তু আমাদের বোঝা উচিত ছিল, ওখানে থাকার ভালো ব্যবস্থা নেই বলে ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের’ বা আক্রান্ত বলে সন্দেহভাজনদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশের সঙ্গতি ও এক অর্থে বিলম্বিত প্রস্তুতি অনুযায়ী যেটুকু ব্যবস্থা তখন পর্যন্ত করা গেছে, এর মধ্যেই দুসপ্তাহের জন্যে সেখানে থাকাটাকে প্রবাসীরাসহ সবার মেনে নিতে হতো সবার মঙ্গলের জন্যেই।

অনেক উন্নত দেশেও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের অবস্থা শোচনীয়; সেবাদানের সক্ষমতার তুলনায় রোগীর সংখ্যা অনেকগুণ বেশি হওয়ায় হাসপাতালগুলোর অবস্থাও চিন্তাতীত রকমের খারাপ। সীমাহীন এই দুর্যোগে সর্বোচ্চ উন্নত দেশের ‘অভিজাত’ হাসপাতালগুলোতেও এখন গরিব দেশের ‘সস্তা হাসপাতালের’ পরিবেশ বিরাজ করছে। এমন অনভিপ্রেত দুর্যোগের সময় ‘আয়োজন’ নয় বরং ‘প্রয়োজনের’ দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। আর এসব বিষয়ে বাংলাদেশের এই যে দুর্বলতা, করোনার এই অভিজ্ঞতার পর অনেক ক্ষেত্রেই নিশ্চয়ই তা কাটিয়ে ওঠা যাবে এবং পরবর্তী সময়ে এমন পরিস্থিতি কখনো তৈরি হলে তখন স্বাস্থ্যসেবার আর এতটা ভঙ্গুর অবস্থা থাকবে না বলে আশা করা যায়। অভিজ্ঞতা থেকে অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশও নিশ্চয়ই শিখবে। যদি আমরা এরপরও না শিখি, তবে নিশ্চয়ই দোষ দেওয়া চলে!

আমরা দেখেছি, পরে যখন সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকার ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো হলো এবং আরও অনেকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সেবার আওতা ও মান দুটোই বাড়ানো গেল, বিদেশ থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা তখনো সেখানে থাকতে রাজি হননি। অনেকেই নানাভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এড়িয়ে গেছেন এবং কোয়ারেন্টিনে নিতে পরবর্তী সময়ে তাদের বাড়িতে খোঁজ করে দেখা গেছে, কোয়ারেন্টিন এড়াতে তারা রীতিমতো গা-ঢাকা দিয়েছেন। দেশে ফিরে তাদের অনেকে বড় অনুষ্ঠান অর্থাৎ লোক-সমাগম করে নিজে বিয়ে করেছেন নয়তো অন্যের বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। অনেকে শ্বশুরবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় আত্মীয়-পরিজনদের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। এর ফলে তাদের মধ্যে যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন, তারা অনিবার্যভাবেই স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের এবং নিজ নিজ এলাকার মানুষদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটিয়েছেন।

কেবল বিদেশফেরতরা নন, দেশের অন্য অনেক নাগরিকও যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেননি। প্রাতিষ্ঠানিক বা হোম কোয়ারেন্টিন থেকে অনেক ব্যক্তি পালিয়েছেন; হাসপাতালে চিকিৎসাধীন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরাও কেউ কেউ পালিয়েছেন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকে মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় বা তথ্য গোপন করার কারণে চিকিৎসক-নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা দেশজুড়ে আক্রান্ত হয়েছেন বলে চিকিৎসকমহল সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন।

দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। তখনও লকডাউন বা সাধারণ ছুটি ঘোষণা না করে অপেক্ষা করা হয় মার্চের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। ওই সময়ের মধ্যে সংক্রমণ যথেষ্ট ছড়িয়ে পড়ার পর মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে ক্রমান্বয়ে নানা প্রতিষ্ঠানে সাময়িক বন্ধ বা ছুটির ঘোষণা দেওয়া শুরু হয়। সরকারিভাবে এই ছুটি ঘোষণার আগে গণপরিবহন বন্ধ না করে তা করা হয় ছুটি ঘোষণার কয়েকদিন পর। ফলে এরইমধ্যে আক্রান্তরা কর্মস্থল ছেড়ে বাড়ি গিয়েছেন গণপরিবহনে অন্যদের সঙ্গে গাদাগাদি করে। এর পরিণতি কী হয়েছে, তা আমরা জানি।

গাজিপুরসহ কয়েকটি এলাকার তৈরি পোশাক কারখানা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আকস্মিক খোলা ঘোষণা করে শ্রমিকদের বাধ্যতামূলকভাবে কাজে যোগ দিতে বলে। হোম কোয়ারেন্টিন যখন চলছে অর্থাৎ সবাইকে যখন ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে, তখন বকেয়া বেতন না পাওয়া ও চাকরি হারানোর হুমকির মুখে শ্রমিকরা পিক-আপ বা ট্রাকে গাদাগাদি করে এবং অনেকে রিকশায় বা পায়ে হেঁটেই গাজিপুর ও ঢাকার দিকে রওনা হন কাজে যোগ দিতে। তৈরি পোশাক শিল্পের অভিভাবক বা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে; তবে বিস্ময় প্রকাশের মাধ্যমে দায় এড়ানোর চেষ্টা না করে ওইসব প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আনলে বরং তাদের আন্তরিকতা প্রকাশ পেত।

অনেক কারখানাই রয়েছে, যারা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করে না; এটি তাদের একরকম সহজাত প্রবৃত্তি। অথচ অন্য অনেক ‘কঠিন’ সময়ের মতো এবার করোনাকালীন দুর্যোগেও ক্ষতির অজুহাতে তৈরি পোশাক খাত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আর্থিক প্রণোদনা পেয়েছে। এরপরও কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের শ্রমিকদের পুরোনো বেতন-ভাতা এখনো পুরোপুরি বুঝিয়ে দেয়নি। ঘোষিত লকডাউন অমান্য করে অনেক শ্রমিককে তাই সড়কে নেমে পাওনা বেতন-ভাতার দাবিতে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে। আর সামাজিক দূরত্ব না মেনে এমন জনসমাগম সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে বৈ কমাচ্ছে না।

একই ধরনের ঘটনা ঘটছে ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রেও; মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বার বার সতর্ক করার পরও ত্রাণ নিয়ে নয়-ছয় বন্ধ হয়নি। ফলে ত্রাণ বা খাদ্য সহায়তা না পাওয়া মানুষগুলো রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে বাধ্য হচ্ছে; এতেও সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি সামলাতে সম্প্রতি দেশজুড়ে গার্মেন্টসহ অন্যান্য কারখানা ‘সীমিত পরিসরে’ খুলতে শুরু করেছে। নির্দেশনা রয়েছে, দূরে থাকা শ্রমিকদের ডেকে না এনে স্থানীয় শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাতে হবে এবং কর্মীদের করোনা থেকে সুরক্ষা দিতে প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। গণমাধ্যমের খবরে আমরা দেখেছি, অনেক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক তাদের প্রতিষ্ঠান এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন। এই বাস্তবতার কথা কি আমাদের অজানা ছিল?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনেক আগে থেকেই সতর্ক করে আসছে, যেসব দেশে করোনা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে, সেখানে এখনই লকডাউন তুলে নেওয়া উচিত হবে না; এতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আর বাংলাদেশে যখন সংক্রমিতের মোট সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে, তখন এই যে কারখানা ও অফিস খুলতে শুরু করেছে, তা সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তবেই খুলছে কিনা, তা দেখা হচ্ছে কি? দেখা না হলে বাংলাদেশকেও যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো বড় বিপর্যয়ে পড়তে হবে।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একাধিক গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, জনসাধারণ এখনো সচেতন না হলে বাংলাদেশে এ দুর্যোগ অনেক বড় মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে যা ঘটলে অন্তত ২০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ মারা যাবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইইডিসিআর (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) এমন দাবিকে ‘অতিরঞ্জিত’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে—দেশের একাধিক গণমাধ্যমে এমন খবর বেরিয়েছে। ওইসব গণমাধ্যম ঠিক কিসের ভিত্তিতে এমন দাবি করেছে, তার স্পষ্টতা নিশ্চিত করে জানা যায়নি বা এর পক্ষে নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়নি। ফলে এই ভবিষ্যদ্বাণীকে এখনই শতভাগ সত্য বলে মেনে নেওয়ার কারণ নেই, তা ঠিক; তবে বিষয়টিকে একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে আরেকটু বেশি সতর্ক হতে দোষ কী! বাংলাদেশের মতো অতি-ঘনবসতির দেশে সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি অন্য অনেক দেশের তুলনায় বেশি হওয়াটা তো অসম্ভব নয়।

দেশে সংক্রমণ শুরুর আগেই শতভাগ লকডাউন ঘোষণা করার দরকার ছিল। এমনকি সংক্রমণ শুরুর পরপরই কালবিলম্ব না করে শতভাগ লকডাউন ঘোষণা করলেও সংক্রমণ গুটিকয়ের মধ্যেই সীমিত রাখা যেত। কিন্তু এর কোনোটিই করা হয়নি; একের পর এক কোভিড-১৯ (করোনাভাইরাস সংক্রমিত) রোগীর সন্ধান মেলার পর প্রথমে বাড়ি, পরে ওই এলাকা এবং সবশেষে পুরো শহর বা গ্রাম এবং পর্যায়ক্রমে জেলা লকডাউন করা হচ্ছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, সংক্রমণ ঠেকাতে আমাদের কৌশল হলো আগে সংক্রমিত হতে দেওয়া এবং এরপর এলাকা লকডাউন করা! অথচ একটি এলাকায় সংক্রমণ ঠেকানোর উপায়ই হলো সংক্রমণ ঘটবার আগেই ওই নির্দিষ্ট এলাকা লকডাউন করা যেন এরইমধ্যে সংক্রমিত কোনো ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করে নতুন করে কাউকে সংক্রমিত করতে না পারে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকা লকডাউন করার ফলে লকডাউনের প্রকৃত সুফল তাহলে পাওয়া যাচ্ছে না। আর এর প্রমাণ হলো, দেড় মাসের মধ্যে বাংলাদেশের মোট আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ষাটের বেশি।

নতুন সংক্রমণ ঠেকাতে মূলত ঘরেই থাকতে বলা হচ্ছে; তবে শিথিলতা দেওয়া হচ্ছে ‘জরুরি প্রয়োজন’ হলে। এই জরুরি প্রয়োজনের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা বা শর্ত কী? প্রতিদিনের খবরেই দেখা যাচ্ছে, অনেকেই নিছক আড্ডা দিতে বাইরে বের হচ্ছেন; অনেকে খুব দরকার ছাড়াই বাইরে বেরোতেও ‘জরুরি প্রয়োজন’ কথাটির অপব্যবহার করছেন। ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে, তবে বাজার-ঘাট খোলা থাকছে; এভাবে মানুষকে ঘরে রাখা যাবে কি?

আর দরকারি কাজে বের হলেও মানুষ প্রয়োজনীয় সুরক্ষা নিশ্চিত করছে না, নির্দিষ্ট শারীরিক দূরত্ব (সামাজিক দূরত্ব) মানছে না। অর্থাৎ জনগণই যেখানে যথেষ্ট সচেতন নয় বা দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, সেখানে শতভাগ লকডাউন সরকারিভাবে বাধ্যতামূলক করা উচিত। শতভাগ লকডাউন কার্যকর করা না গেলে করোনার বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না। আর লকডাউন শতভাগ কার্যকর করতে হলে মানুষ যেন সত্যিই ঘরে থাকে এবং ‘জরুরি প্রয়োজন’-এর অজুহাত এমনকি সত্যিকার জরুরি প্রয়োজনেও মানুষের যেন ঘর থেকে বের হওয়ার দরকার না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

এজন্যে শতভাগ লকডাউন বাধ্যতামূলক ঘোষণা করার আগে অবশ্যই চিকিৎসা থেকে শুরু করে বাজার-ঘাট কিংবা খাদ্য সহায়তার মতো সত্যিকার জরুরি প্রয়োজনগুলো সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির মাধ্যমে সুলভ করার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষ ফোন, ইমেইল বা এমন অন্য উপায়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে নিজের এসব প্রয়োজনের কথা জানাবে এবং ওই কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। তা করা না গেলে মানুষকে বাজার-ঘাট করতে বা ওষুধ কিনতে ঘরের বাইরে বের হতেই হবে এবং এই সুযোগে আরো অনেকেই নিছক ‘হাওয়া খেতে’ বাইরে বেরোবে—এ আর বিচিত্র কি! মানুষ ঘরের বাইরে বেরোলে নতুন সংক্রমণ ঘটবে আর ঘরে থাকলে ঘটবে না—এই সরল অঙ্কের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

করোনা থেকে বাঁচতে এখন পর্যন্ত একমাত্র সমাধান নতুন সংক্রমণ ঠেকানো। এজন্যে পৃথিবীতে করোনাভাইরাসে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত ২১০টির মতো দেশ ও অঞ্চলের বেশিরভাগে চলছে হোম কোয়ারেন্টিন ও লকডাউন; কোথাও কোথাও চলছে কারফিউ। ব্যতিক্রমের মধ্যে রয়েছে সুইজারল্যান্ড; তারা প্রতিরোধের কোনো ধরনের ব্যবস্থাই নেয়নি। তারা মনে করছে, এ ভাইরাস ঠেকানোর চেষ্টা করলেই বরং বিপত্তি ঘটতে পারে। তাই প্রতিরোধের পরিবর্তে দেশটির কৌশল হলো এ ভাইরাসকে সবার মধ্যে অবাধে ছড়াতে দেওয়া; তারা মনে করছে, সবার মধ্যে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যক্তির শরীরে প্রকৃতিগতভাবেই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ব্যবস্থা (হার্ড ইমিউনিটি) তৈরি হবে। তবে এই কৌশল যে কাজে এসেছে, এমন কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত মেলেনি; আক্রান্ত বা অসুস্থ নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে গিয়ে এরই মধ্যে হিমশিম খাচ্ছে দেশটি। উল্লেখ্য, বিশ্বের নানা প্রান্তের স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা এই কৌশলকে শুরু থেকেই অকার্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ বলে আসছেন।

তবে শুরু থেকেই যারা কঠোরভাবে ও সত্যিকার অর্থেই শতভাগ বা শতভাগের কাছাকাছি পর্যায়ে লকডাউন নিশ্চিত করেছে, কেবল তারাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে; বাকিরা ধুঁকে মরছে। যে শিক্ষা আমাদের নেওয়া উচিত ছিল চীনে সংক্রমণ ছড়ানোর তথ্য ফাঁস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, সে শিক্ষা আমরা এখনো নিতে পারিনি; আর এর প্রমাণ হলো এই কোভিড-১৯ রোগ, এই রোগ সংক্রমণের কারণ ও নতুন সংক্রমণ ঠেকানোর উপায় আগে থেকেই জানার পরও বাংলাদেশে দেড় মাসে এখন পর্যন্ত শনাক্ত সংক্রমণের সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়েছে; মৃতের সংখ্যা দেড়শ ছাড়িয়েছে। এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, আক্রান্তের এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি; যত বেশি পরীক্ষা হবে, ততো বেশি শনাক্ত হবে।

তাই আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে; আরো কালবিলম্বের মতো বিলাসিতার সুযোগ আমাদের নেই।

[লেখাটি দৈনিক আমাদের সময়-এ ২৮ এপ্রিল ২০২০ প্রকাশিত হয়।]