Media School

Dhaka    Wednesday, 27 November 2024

By সজীব সরকার

কমিউনিকেটিভ বা যোগাযোগধর্মী হওয়া মানে কী?

Media School July 13, 2024

প্রতীকী ছবি।

সাধারণভাবে কমিউনিকেটিভ বা যোগাযোগধর্মী হওয়া বলতে বোঝায় যোগাযোগমুখী হওয়া। অনীহা, জড়তা বা ভীতি কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক যোগাযোগ চলমান রাখা। তবে, যোগাযোগ শাস্ত্রের প্রেক্ষাপটে কমিউনিকেটিভ বা যোগাযোগধর্মী হওয়ার আরেকটি অর্থ রয়েছে; তা হলো- যোগাযোগ এমনভাবে করা, যেন নিজেকে অন্যের কাছে স্পষ্টভাবে বা সঠিকভাবে তুলে ধরা যায়। অর্থাৎ, আমি যখন কারো সঙ্গে কথা বলছি, তখন কথাগুলো এমনভাবে বলা যেন আমি তাকে যা বোঝাতে চাইছি, তা সে ঠিকভাবে বুঝতে পারে।

যোগাযোগ শাস্ত্রে বলা হয়, মানুষ উদ্দেশ্য ছাড়া কোনো যোগাযোগ করে না; সবসময় এর পেছনে একটি উদ্দেশ্য বা কারণ থাকে। সাধারণভাবে দেখলে, যোগাযোগ মানে হলো মানুষে মানুষে তথ্য, ধারণা বা মনের ভাব বিনিময়। এই বিনিময়ের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অন্যজনকে বুঝতে চায়; অন্যজনের কাছে নিজের কথা বলতে চায়, নিজের মনের ভাব বা তার ভাবনাগুলো তুলে ধরতে চায়। তাহলে, আপনি যখন কারো সঙ্গে কথা বলছেন কিন্তু সে আপনার কথা বুঝতে পারছে না- এর মানে হলো সেখানে প্রকৃত অর্থে 'যোগাযোগ' ঘটছে না। আপনাদের দুজনের বাক্যালাপকে সত্যিকার যোগাযোগ কেবল তখনই বলা যাবে, যখন আপনারা দুজনই দুজনকে বুঝতে পারবেন। আলাপচারিতার সময় পরস্পরকে বুঝতে পারাই হলো যোগাযোগ শাস্ত্রের ভাষায় 'কমিউনিকেটিভ' বা 'যোগাযোগধর্মী' হওয়া।

তাহলে, সহজ কথায় বলা যেতে পারে- কমিউনিকেটিভ বা যোগাযোগধর্মী হওয়ার মানে হলো এমনভাবে যোগাযোগ করা, যেন অন্যরা এ যোগাযোগের কারণ, উদ্দেশ্য ও অর্থ সহজেই বুঝতে পারে।

আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক :

আমরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষকের ক্লাস করেছি; ক্লাসে সবার পড়ানোর ধরন কি এক ছিলো? সবার কাছে কি পড়াগুলো একইভাবে বুঝেছি? নিশ্চয়ই এমন হয়েছে- কোনো শিক্ষকের ক্লাসে পড়াগুলো খুব ভালোমতো বুঝতে পেরেছি; তাহলে, ওই শিক্ষককে কমিউনিকেটিভ বা যোগাযোগধর্মী বলা যেতে পারে। আবার, কেউ এমনভাবে পড়িয়েছেন বা পাঠগুলো এমনভাবে আলোচনা করেছেন, যা সহজে বুঝতে পারিনি; এর মানে হলো, ওই শিক্ষক কমিউনিকেটিভ বা যোগাযোগধর্মী ছিলেন না।

ধরা যাক, তিনজন ব্যক্তিকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়ে এক পৃষ্ঠা করে লিখতে বলা হলো। অবশ্যই তিনজনের লেখার ধরন তিন রকম হবে। আমরা যদি ওই লেখাগুলো পড়ি, তাহলে দেখবো, কারোটা সহজে বুঝতে পারছি কিন্তু কারোটা একটু কঠিন লাগছে। এমনও হতে পারে, একজনের ক্ষেত্রে হয়তো এমন হলো যে তিনি এ বিষয়ে কী লিখেছেন অর্থাৎ তার লেখায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়ে তিনি কী বলতে চেয়েছেন- এর কিছুই বোঝা গেল না। এখানে সবার লেখাকে তাহলে কমিউনিকেটিভ বা যোগাযোগধর্মী বলা যাবে না।

আমরা কথা বলি, চিঠি লিখি, পড়া বুঝিয়ে দিই, কোনো বিষয় ব্যাখ্যা করি, কোনো কাজের নির্দেশ বা নির্দেশনা দিই, পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখি, নোটিস লিখি - এমন নানা উপায়ে যোগাযোগ করি। যে উপায়েই যোগাযোগ হোক, বাক্য বা ভাব বিনিময়ের সময় পরস্পরের কথা সঠিকভাবে বুঝতে পারা জরুরি। তাহলে, মুখের কথায় বা লেখনীর মাধ্যমে আমি কাউকে যা বলতে চাই, নিশ্চিত করতে হবে, তা যেন সে সহজেই বুঝতে পারে। আপনি যা বললেন বা লিখলেন, তা যদি অপরজন সহজেই বুঝতে পারে, তাহলে আপনি 'যোগাযোগধর্মী' হলেন।

আপনি একটি সেমিনারে বক্তব্য দিলেন যা কেউ বুঝতে পারলো না। অথবা, ক্লাসে যা পড়াচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা তা বুঝতে পারছে না। তাহলে, আপনার ওই বক্তৃতা বা ক্লাসের আলোচনা যোগাযোগধর্মী হলো না। যে বিষয়ে বক্তব্য দিলেন বা ক্লাসে যা পড়াচ্ছেন, তা যদি আপনার অডিয়েন্স সহজেই ও সঠিকভাবে বুঝতে পারে, তাহলে আপনার ওই বক্তব্য বা ক্লাসের আলোচনা যোগাযোগধর্মী হলো এবং আপনি নিজেও কমিউনিকেটিভ বা যোগাযোগধর্মী হলেন।

কমিউনিকেটিভ বা যোগাযোগধর্মী হওয়ার কৌশল

এর কোনো সুনির্দিষ্ট বা সবার জন্য উপযোগী একক কোনো ফর্মুলা নেই; তবে, নিজেকে কমিউনিকেটিভ করে তোলার জন্য এমন কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে :

সহজ করে বলা : রাজশেখর বসুর উদ্দেশে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক কবিতায় বলেছিলেন, "সহজ কথা লিখতে আমায় কহ যে/সহজ কথা যায় না লেখা সহজে"। সত্যিই তাই। নিজেকে যোগাযোগধর্মী করে তুলতে হলে কঠিন এই কাজটিই আয়ত্ত করতে হবে।

আপনি যখন কিছু বলবেন বা লিখবেন, তখন আপনার অডিয়েন্স কে বা কারা - তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখুন। ধরুন, আপনি আইনস্টাইনের 'থিওরি অব রিলেটিভিটি' বা নিউটনের তিনটি সূত্র দুজন ব্যক্তিকে বোঝাবেন; তাদের একজনের বয়স ১০, অন্যজনের ৪০। এই দুজনকে কি একই রকম ব্যাখ্যায় বোঝাবেন? অথবা, সায়েন্স পড়ে আসা একজন ব্যক্তিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করবেন, সায়েন্স না পড়া একজন ব্যক্তিকেও কি ঠিক একইভাবে বোঝালে তিনি তা বুঝতে পারবেন?

আপনার জানা-বোঝার মাত্রার বিচারে নয় বরং আপনার অডিয়েন্সের কথা বিবেচনায় নিয়ে বলুন বা লিখুন।

অডিয়েন্সের পরিচিত শব্দ ব্যবহার করুন : কম প্রচলিত শব্দ ব্যবহার না করে অডিয়েন্সের পরিচিত অর্থাৎ তাদের চেনা-জানা শব্দ ব্যবহার করুন।

জার্গন বা টেকনিক্যাল টার্ম বাদ দিতে চেষ্টা করুন : প্রতিটি শাস্ত্রের নিজস্ব কিছু শব্দ থাকে, যা ওই শাস্ত্রে বিশেষ কোনো অর্থ তৈরি করে। এগুলো অন্যরা বুঝতে পারে না। এমন ক্ষেত্রে সম্ভব হলে এসব শব্দ বাদ দিয়ে তাদের কাছে বোধগম্য শব্দ ব্যবহার করুন। এমন বিকল্প না থাকলে জার্গন ব্যবহার করতে হলেও অবশ্যই এর অর্থ ব্যাখ্যা করুন।

সহজ শব্দ ব্যবহার করুন : কঠিন শব্দ ব্যবহার করলে যোগাযোগধর্মী হওয়া যাবে না। আপনার বলায় বা লেখায় এমন শব্দ ব্যবহার করবেন না, যার অর্থ বোঝার জন্য অডিয়েন্সকে ডিকশনারি বা অভিধান ঘাঁটতে হয়। 'ভারিক্কি' ভাব আনার জন্যে অনেকে ইচ্ছে করেই কঠিন শব্দ ব্যবহার করেন; অকারণ এমন করা উচিত হবে না। এমন হলে অডিয়েন্স আগ্রহ হারাবে। ভেবে দেখুন, যোগাযোগের উদ্দেশ্য আসলে কী- কথা বা লেখা 'ভারী' করা, না কি কাউকে কিছু জানানো বা বোঝানো?

ছোট শব্দ ও ছোট বাক্য ব্যবহার করুন : বড় শব্দ ব্যবহার না করে বিকল্প হিসেবে ছোট কোনো শব্দ ব্যবহার করুন। একটি বাক্যকে খুব লম্বা করা ঠিক নয়; বড় একটি বাক্যকে ভেঙ্গে ছোট ছোট কয়েকটি বাক্যে বলুন।

সরল বাক্য ব্যবহার করুন : শুধু ছোট নয়, সরল বাক্য বেশি ব্যবহার করতে চেষ্টা করুন। জটিল (কমপ্লেক্স) বা যৌগিক (কম্পাউন্ড) বাক্য এড়িয়ে যতোটা সম্ভব সরল (সিম্পল) বাক্য ব্যবহার করুন।

স্পষ্ট করে বলুন : যা বলতে চান, তা স্পষ্ট করে বলুন; কথার মধ্যে কোনোরকম অস্পষ্টতা রাখবেন না।

উদাহরণ দিন : কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার সময় যথাসম্ভব উদাহরণ দিতে চেষ্টা করুন। একটানা আলোচনা বা ব্যাখ্যার বদলে প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দিলে অডিয়েন্স সহজে সেটি বুঝতে পারবে।

সার্বিকভাবে বলতে গেলে- অডিয়েন্সের জানা-বোঝার পরিধি খেয়াল রাখা, পরিচিত ও সহজ শব্দ ব্যবহার করা, ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করা, প্রাসঙ্গিক উদাহরণ ব্যবহার করা - এমন কিছু সাধারণ কিন্তু জরুরি বিষয় যোগাযোগের সময় বিবেচনায় রাখলে যোগাযোগধর্মী হয়ে ওঠা খুব কঠিন হবে না।