By নুসরাত জাহান
আমি একজন সাধারণ নাগরিক বলছি...
Media School July 31, 2024
মনটা বেশ কিছুদিন থেকেই খুব ভারাক্রান্ত। মন ভারাক্রান্ত নিহত শিক্ষার্থীদের জন্য, ভারাক্রান্ত নিহত নিরীহ জনগণ ও সাংবাদিক ভাইদের জন্য। মন ভারাক্রান্ত সেই পুলিশ সদস্যের জন্য, হত্যার পর যার লাশটি উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। তারা সবাই তো কারও সন্তান, কারও স্বামী, কারও ভাই, কারও বন্ধু, কারও আত্মীয়-পরিজন। কিন্তু, আজ তারা কেউ বেঁচে নেই এ পৃথিবীতে। এ জগতের নির্মম নিষ্ঠুরতার বলি হতে হয়েছে সবাইকে। তাদের মধ্যে কার পেশা কী, কার এজেন্ডা কী, কে কোনো দল করে বা করে না— এসব কিছুর ঊর্ধ্বে তাদের পরিচয়, তারা সবাই মানুষ। এটাই কি এই পৃথিবীতে আমাদেরকে আর সবার থেকে আলাদা করেনি? দেয়নি অন্য সব জীবের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠের মর্যাদা? তাই, সেই ‘মানুষ’ হয়েও যদি তাদের এই করুণ পরিণতি ভোগ করতে হয়, তাহলে এর থেকে দুঃখজনক ব্যাপার আর কী হতে পারে!
এখানে কোনো দলের কথা বলছি না। হচ্ছে না কোনো ইস্যুর কথাও। এখানে শুধু একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের জন্য সহানুভূতির কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু, সারা বিশ্বেই যেন আজ বড় অভাব দেখা দিয়েছে এই সহানুভূতির। মানবসভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে, উন্নতির আরও শিখরে নিয়ে যেতে মানুষে মানুষে যে সৌহার্দ্যের প্রয়োজন ছিল, সেটারই বড় অভাব আজ। উল্টো, মানুষে মানুষে হানাহানি, রেষারেষি আর কাদা ছোঁড়াছুড়ির রাজনীতির মধ্যে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সব মূল্যবোধ; হারিয়ে যাচ্ছে সহনশীলতা, আর ওষ্ঠাগত হচ্ছে সাধারণের প্রাণ।
আমার সন্তানের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা চলছিল এই জুলাই মাসে। বছরের ৭ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও সে এখনও অর্ধবার্ষিক পরীক্ষাই শেষ করতে পারেনি। দেশে বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরীক্ষার মধ্যেই স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে এখন ঘরবন্দি! মনে মনে শুধু ভাবছি— যে চাকরির জন্য কোটা যৌক্তিকভাবেই সংস্কার হলো, সেই চাকরির বাজার পর্যন্ত আদৌ সময়মতো সে যেতে পারবে?
যে দিনমজুর, রিকশাচালকের ধার-দেনা বেড়ে গেলো, খাওয়া জুটলো না কতোদিন; বরং, একটু উপার্জনের আশায় পথে বের হয়ে জীবনটাই যার খোয়াতে হলো; সারাজীবনের জন্য যে পঙ্গুত্বের শিকার হলো; যে মা-বাবা সন্তানহারা হলো; যার এইচএসসি পরীক্ষা আটকে গেলো; যে শিশুদের স্কুল আবারও বন্ধ হয়ে পড়াশোনায় নেমে এলো স্থবিরতা; পুরো দেশের অবকাঠামোগত এতো ক্ষতি হয়ে গেলো; পোশাক খাত থেকে শুরু করে সার্বিকভাবে রপ্তানি খাতে এতো ক্ষয়ক্ষতি; শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা; পর্যটন খাতে একপ্রকার ধস নামা; জরুরি রোগীদের সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়া; ব্যাংক-বীমা-শেয়ার বাজারে ক্ষতি— এসবের দায়ভার কার?
এর দায় যারই থাকুক, ভুক্তভোগী আসলে সাধারণ মানুষই। সেইসব মানুষ, যারা নিজের ছোট্ট একটি চাকরি বা ব্যবসা, নিজের একটি পরিবার নিয়ে নিজের ছোট্ট একটি পৃথিবীতে শুধু দু’বেলা একটু খাওয়া-পড়ার নিশ্চয়তা আর একটুখানি ‘সুখ’ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চায়।
কিন্তু, পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে সহনশীলতার অভাবে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে ভুক্তভোগী হচ্ছি আমরা এই সাধারণ মানুষ। অনাকাঙ্ক্ষিত এসব পরিস্থিতির কারণে কারও দেখা দিচ্ছে জীবিকার একমাত্র অবলম্বন চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা, কারও বা কাজের সুযোগ হারিয়ে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, কারও বহু কষ্টের পুঁজিতে গড়ে তোলা ব্যবসা পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া, শিক্ষার্থীদের ঘরবন্দি-পড়াশোনাহীন-বন্ধুহীন নিরানন্দ জীবন। আবার, কারও হয়তো জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হয়ে নিজের মূল্যবান জীবনটাই হারিয়ে ফেলা; আর, পেছনে পড়ে থাকে নিহত ওই সাধারণ মানুষটির ওপর আর্থিক ও মানসিকভাবে নির্ভরশীল অসহায় কয়েকটা নিরীহ মুখ।
কিন্তু, এ সঙ্কটকাল জিইয়ে রাখা যায় না। তাহলে এর যে ক্ষত সৃষ্টি হবে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের মনে, তা থেকে পরিত্রাণের হয়তো আর কোনো উপায় থাকবে না। হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে একটি রাষ্ট্র, সমাজ ও সমাজের মানুষ। তাই, এ ক্ষত সারিয়ে তোলার এখনই সময়। সব ভুল-বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সহমর্মিতা ও সহনশীলতার চর্চার মধ্য দিয়ে আবারও আমরা নির্মাণ করতে পারি সুন্দর, নির্মল একটি পরিবেশ; সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য আদতে যার কোনো বিকল্প নেই। আর, তাহলেই অকাতরে ঝরবে না কোনো প্রাণ; নিঃস্ব হতে হবে না কোনো মানুষের, বেঁচে থাকবে সাধারণের স্বপ্নগুলো।
*নুসরাত জাহান : সাংবাদিক।
**লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক বাংলা-তে, ৩০ জুলাই ২০২৪। সম্পাদকীয় বিভাগের মৌখিক অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।