By সজীব সরকার
আত্মবিশ্বাস : তৈরি বা মজবুত করতে করণীয়
Media School February 3, 2025

নিজের সক্ষমতার ওপর আস্থা থাকা জরুরি। প্রতীকী ছবি।
আমি পারি, আমি পারবো বা আমার পক্ষে সম্ভব - এমন ইতিবাচক ও দৃঢ় মনোভাবই তো আত্মবিশ্বাস! নিজের প্রতি এই বিশ্বাস তথা নিজের সক্ষমতার ওপর এমন আস্থা থাকা খুব জরুরি। কিন্তু, নানা কারণেই এই বিশ্বাসে ঘাটতি থাকে বা বিদ্যমান বিশ্বাস দুর্বল হতে শুরু করে। তাই, আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা বা বাড়ানোর প্রতি আমাদের সবসময় মনোযোগী থাকা দরকার।
তবে, শুরুতেই মনে রাখতে হবে, আত্মবিশ্বাস তৈরি বা বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট কোনো গাণিতিক ফর্মুলা নেই। কোনো বই বা তত্ত্ব নেই, যা পড়লেই যে-কেউ নিশ্চিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। অবশ্য, সাধারণ কিছু বিষয় নিশ্চয়ই রয়েছে, যেগুলো নিয়মিত চর্চার মাধ্যমে আমরা এমন একটা জায়গা বা অবস্থা তৈরি করতে পারি, যেখান থেকে ক্রমশ নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলা সম্ভব বা সহজ হবে। এ আলোচনায় আমরা এমনই কিছু বিষয় দেখার চেষ্টা করবো।
আত্মবিশ্বাস তৈরি বা মজবুত করে তোলার জন্য প্রাথমিকভাবে আমরা যা বিবেচনা করতে পারি :
- প্রথমেই মনে রাখতে হবে, আত্মবিশ্বাস রাতারাতি তৈরি বা বৃদ্ধি সম্ভব নয়। এটি একটি অযৌক্তিক ও অবাস্তব চিন্তা। তাই, সময় নিন। নিজেকে সময় দিন। ধৈর্য ধরুন। বিশ্বাস রাখুন, 'হবে'।
- প্রতিদিন নিজেকে একটু একটু করে গড়ে তুলুন। নিজের মনোবল বাড়ানো অথবা নিজের সার্বিক উন্নয়ন তথা আত্ম-উন্নয়ন প্রথমত একটি প্রক্রিয়া এবং দ্বিতীয়ত - একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। লক্ষ রাখুন, প্রক্রিয়াটি চলমান রয়েছে কি না। সবসময় নতুন কিছু শেখা, নতুন কিছু জানা এবং নিজের মধ্যে নানা রকমের দক্ষতা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা চলমান রাখুন। একসময় দেখবেন, অনেকখানিই বদলে গেছেন; নিজের উন্নততর ভার্সন দেখতে পাবেন।
- ঠিক কী কারণে বা কোন বিষয়ে আপনার আত্মবিশ্বাস কম, সেটি নিজেই খুঁজে বের করুন। ভাবুন। দরকার হলে কাগজে নোট নিন। আপনার সত্যিকার শুভাকাঙ্খী যারা, তাদের সহযোগিতা নিন। তাদের দৃষ্টিতে আপনার ভালো-মন্দ দিকগুলো সম্বন্ধে উদার মনে তথ্য ও বিশ্লেষণ গ্রহণ করুন।
- নিজের যেসব ঘাটতি বা দুর্বলতার সন্ধান পাবেন, তা নিয়ে আরো বেশি কাতর না হয়ে বরং এর থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করুন। ওই দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠতে যা করা দরকার, সে ব্যবস্থা নিন। দেখবেন, নিজের কমতিগুলো কাটিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আপনার আত্মবিশ্বাসের মাত্রাও বাড়ছে।
- সবসময় অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা করবেন না। প্রত্যেকের আলাদা কিছু সবল দিক যেমন থাকে, তেমনি দুর্বল কিছু দিকও থাকে। আপনার নিজের ভালো জ্ঞান বা দক্ষতা রয়েছে- এমন দিকগুলোর দিকে মনোযোগ দিন। অন্যের জ্ঞান বা দক্ষতার সঙ্গে সবসময় মেলাতে গেলে ভুল করবেন। মনে রাখবেন, প্রত্যেকের আলাদা আলাদা গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকে। তেমনি, প্রত্যেকেরই আলাদা কিছু দুর্বল দিকও থাকে। সবার সবকিছুর সঙ্গে আপনার বা অন্য কারোরই কিছু মিলবে না। তাই, অন্যের দিকে নয় - নিজের ওপর ফোকাস করুন। নিজেকে আরো ইতিবাচক করে তোলার দিকে মনোযোগী হোন।
- মানসিক প্রশান্তি একটা বড় বিষয়। নেতিবাচকতা যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। চারপাশ থেকে নেতিবাচক মনোভাবের মানুষজন কমিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন। আড্ডায় নেতিবাচক আলোচনা এড়িয়ে চলুন। কিছু বিষয় উপেক্ষা করলে যদি মনের শান্তি বজায় থাকে, সেটাই করুন। পরিবারের ভেতরে ও বাইরে আলোচনাগুলোকে সবসময় ইতিবাচক রাখার চেষ্টা করুন। আত্মিক প্রশান্তি বজায় থাকলে আত্মবিশ্বাসও ধরে রাখা সহজ।
- মানুষ আসলে নানা রকমের সম্পর্কের নেটওয়ার্ক। স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী নানা রকমের সম্পর্কে আমরা জড়িয়ে থাকি জীবনভর। সম্পর্কগুলোর যত্ন নিন। ইতিবাচক থাকুন, যত্নশীল থাকুন। একেবারেই অদরকারি ও নেতিবাচক সম্পর্ক থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন।
- সবসময় সবকিছুতে প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসুন। সহযোগিতার মনোভাব থাকাও জরুরি। আরেকজনের রেজাল্ট আমার চেয়ে ভালো হয়ে গেছে, অন্যে গাড়ি কিনে ফেলেছে, অমুক বিদেশ ট্যুরে চলে গেছে... এভাবে সারাক্ষণ ভাবতে থাকলে জীবনে কখনো শান্তিও যেমন পাবেন না, তেমনি নিজের ওপর আস্থা বা বিশ্বাসও একসময় কমতে শুরু করবে। কারণ, আপনি যতোকিছুই জীবনে অর্জন করেন না কেন, দেখবেন, কেউ না কেউ আপনার চেয়ে বেশি অর্জন করেছে। তাহলে, এই তুলনা ও প্রতিযোগিতার কোনো শেষ আসলে নেই! বরং, নিজের দক্ষতা-জ্ঞান-বুদ্ধি-মেধা বাড়ানো ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে জীবনকে উন্নততর করা চেষ্টা করুন। একটু একটু করে এগোনোর চেষ্টা চলমান রাখুন।
- অন্য কেউ আপনাকে কীভাবে মূল্যায়ন করলো, সবসময় সেটিই চূড়ান্ত নয়। আপনি অনেক ভালো ও দক্ষ মানুষ হওয়ার পরও কেউ আপনাকে খারাপ বা অযোগ্য বলতেই পারে। তাই, কে বলছে- সেটিও ভেবে দেখুন। অন্যের কথায় অল্পতে কাতর হবেন না। নিজেও নিজেকে পাল্টা মূল্যায়ন করুন।
- সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে নিন। কেউ যদি আপনার সমালোচনা করে, এর যথার্থতা আপনি নিজে যাচাই করে দেখুন। প্রয়োজনে আরো দু-একজনের সঙ্গে আলোচনা করুন। এরপর আপনি সার্বিকভাবে তুলনা করে দেখুন। সেখান থেকে যদি আপনার শিক্ষণীয় কিছু থাকে, অবশ্যই সেটি উদার চিত্তে গ্রহণ করুন। যা ভুল, সেটি নিয়ে বিচলিত না হয়ে মন থেকে তা ঝেড়ে ফেলুন।
- নিজেকে নিজে সম্মান দিতে শিখুন। আপনি যদি নিজের মর্যাদা ধরে রাখতে না পারেন; অকারণ ও অন্যায়ভাবে আপনার আত্মসম্মানের বোধে অন্যকে আঘাত করার সুযোগ দেন - তাহলে ভুল করবেন। প্রতিবাদ করুন। নিজের মর্যাদা নিজে আগে রক্ষা করুন। তাহলে অন্য কেউ সহজে আপনার সম্মানবোধে আঘাত করার মতো সাহস করবে না। মনে রাখবেন, আপনি নিজে যদি নিজের পাশে না দাঁড়ান, তাহলেই আপনি সবচেয়ে বেশি অরক্ষিত থাকলেন।
- নিজেই নিজের মূল্যায়ন করুন। আত্ম-প্রতিফলন বা প্রতিফলিত চেতনা অর্থাৎ সেলফ-রিফ্লেকশন (self-reflection) খুব দরকারি; নিয়মিত এর চর্চা করুন। সহজ কথায় যদি বলি- দিন শেষে নিজেই ভেবে দেখুন, সারা দিন আপনি যা করলেন এবং যেভাবে করলেন, তা কি যথাযথ ছিলো, না কি অন্যকিছু করলে বা অন্যভাবে করলে আরো ভালো হতো? - এভাবে মাঝে-মধ্যেই নিজের কাজ বা সিদ্ধান্তগুলোর মুল্যায়ন আপনি নিজে করুন। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করুন। দেখবেন, আপনি নিজেই নিজের অনেক ভুল-ত্রুটি বা ভালো-মন্দ দিকগুলো সম্বন্ধে জেনে যাবেন। এভাবে আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেকে ক্রমেই গড়ে তুলুন।
- নিজের ছোট ছোট অর্জনগুলোও অন্যের সঙ্গে উদযাপন করুন। এতে আত্মবিশ্বাস আরো বাড়বে।
- সবসময় সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করুন। পরিবারের সবার সঙ্গে ইতিবাচক ও আন্তরিক সম্পর্ক আপনার মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। বন্ধু বা সহকর্মীদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। তাই, যে-কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই অকারণ নেতিবাচকতা বা জটিলতা পরিহার করুন।
- জীবনের ক্যানভাসটা অনেক বড়। ভালো-মন্দ-সাফল্য-ব্যর্থতা মিলেই জীবন। জীবনের নানা ক্ষেত্রে ভুল হতেই পারে। ব্যর্থ হতেই পারেন। মনে রাখতে হবে, ওই একটি-দুটি ভুল বা ব্যর্থতা আপনার পুরো জীবনের গল্প নয়। প্রতিটি ভুল বা ব্যর্থতাকে জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখার চেষ্টা করুন। খেয়াল রাখুন, একই ভুল যেন বারবার না হয়।
- জীবনকে সবসময় শুধু সফলতা বা ব্যর্থতা দিয়েই বিচার করা ঠিক নয়। কেউই জীবনের সব ক্ষেত্রে সবসময় সফল যেমন হয় না, তেমনি ব্যর্থও হয় না। জীবনের আরো নানা ঘটনা, দিক ও উপাদান থাকে; সার্বিকভাবে দেখুন।
সর্বোপরি, নিজেকে বোঝার চেষ্টা করুন। সবসময় সব কাজে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করুন। নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখুন। যথেষ্ট ধৈর্য ধরুন। ক্রমেই আপনার আত্মবিশ্বাস ও জীবনের মান - দুটোই বাড়বে।