Media School

Dhaka    Thursday, 26 December 2024

By সজীব সরকার

অনুবাদ : ট্রান্সলেশন ও ট্রান্সক্রিয়েশন

Media School July 14, 2024

প্রতীকী ছবি।

ট্রান্সলেশন (translation) বা অনুবাদকর্মকে প্রধানত দুটি ধরনে ভাগ করা হয় :

১. আক্ষরিক বা মূলানুগ অনুবাদ ও
২. ভাবানুবাদ

অনুবাদকে ইংরেজি ভাষায় literal translation, semantic translation বা calque - এমন নানা ধরনে ভাগ করা হয়।

এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক বা পেশাগত পর্যায়ে অনুবাদের আরো নানা ধরন বা শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। তবে, বর্তমান লেখায় মূলত সৃষ্টিশীল অনুবাদ নিয়েই আলোচনা করা হলো।

অনুবাদের ক্ষেত্রে একটি ভাষাকে অন্য একটি ভাষায় রূপান্তর ঘটানো হয়। যে ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয় তাকে 'উৎস ভাষা' এবং যে ভাষায় অনুবাদ করা হবে তাকে 'লক্ষ্য ভাষা' বলা হয়। ধরা যাক, নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতাটি বাংলা থেকে ইংরেজি করা হবে। তাহলে, এখানে বাংলা হলো 'উৎস ভাষা' আর ইংরেজি হলো 'লক্ষ্য ভাষা'।

আক্ষরিক অনুবাদে মূল টেক্সটকে হুবহু অনুসরণ করা হয়। ধরা যাক, শেক্সপিয়ারের নাটকের একটি প্যারাগ্রাফ বা অনুচ্ছেদ ইংরেজি থেকে বাংলা করা হবে। আক্ষরিক অনুবাদের ক্ষেত্রে তাহলে ইংরেজি প্রতিটি বাক্য ধরে ধরে এবং এদের ক্রম বা ধারাবাহিকতা ঠিক রেখে হুবহু (verbatim) বাংলা করা হবে। এ ক্ষেত্রে বাক্যের পাশাপাশি শব্দগুলোকেও ধরে ধরে অনুবাদের চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, ইংরেজি অনুচ্ছেদে ২০টি বাক্য থাকলে অনুবাদের পর বাংলাতেও প্রায় সমসংখ্যক বাক্যই তৈরি হচ্ছে।

কিন্তু ভাবানুবাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন হয়। যেমন : শেক্সপিয়ারের নাটকের ওই একই অনুচ্ছেদ ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাবানুবাদ করা হবে। ভাবানুবাদের ক্ষেত্রে মূল টেক্সট (এখানে ইংরেজি অনুচ্ছেদ) পড়ে এতে কী বলা হচ্ছে বা কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে, সেটি অনুবাদক নিজের মতো করে বাংলায় বুঝিয়ে লেখেন। এ ক্ষেত্রে উৎস ভাষার বাক্য বা শব্দকে হুবহু অনুসরণ করা হয় না।

তবে, সব ধরনের অনুবাদ বা ভাষান্তরের ক্ষেত্রেই খেয়াল রাখতে হবে, মূল টেক্সট বা উৎস ভাষায় যা বলা হয়েছে, সেই অর্থ বা ভাব যেন বদলে না যায়। ভাবানুবাদের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে আরো সতর্ক থাকতে হবে; অনুবাদক 'নিজের মতো করে' বলতে গিয়ে মূল লেখার অর্থ বা ভাব থেকে যেন বেশি দূরে সরে না যান, তা নিশ্চিত করতে হবে।

অনুবাদের রকমফের : জন ড্রাইডেন-এর শ্রেণিকরণ

সপ্তদশ শতকের ইংরেজ কবি জন ড্রাইডেন কেবল তার কবিতার জন্য নয়, অনুবাদকর্মের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। ১৬৮০ সালে প্রথম প্রকাশিত Preface to Ovid's Epistles গ্রন্থে তিনি তিন ধরনের অনুবাদের ধারণা দেন :

১. মেটাফ্রেজ (Metaphrase): শব্দ ধরে ধরে হুবহু বা অবিকল অনুবাদ। ড্রাইডেনের ভাষায় এটি হলো 'translating word-for-word'.
২. প্যারাফ্রেজ (Paraphrase): মূল ভাব বা ধারণার অনুবাদ। ড্রাইডেনের ভাষায় 'translating sense-for-sense'.
৩. ইমিটেশন (Imitation): মূল লেখার সঙ্গে এর তেমন মিল থাকে না। একে ড্রাইডেন বলেছেন 'loose rewriting'.

ড্রাইডেনের মতে, এই তিন ধরনের অনুবাদের মধ্যে প্যারাফ্রেজ সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ও কার্যকর।

তিনি মনে করতেন, উৎস ভাষা ও লক্ষ্য ভাষা - এ দুটিতেই বিশেষ দখল বা পারদর্শিতা ছাড়া ভালো অনুবাদক হওয়া সম্ভব নয়।

ভাষান্তরের কারণে মূল লেখার মৌলিক সৌন্দর্য যে হারিয়ে যায়, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছিলেন জন ড্রাইডেন। এ ব্যাপারে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন :

"Praise of a translation consists in adding new Beauties to the piece, thereby to recompense the loss which it sustains by change of language".

- অর্থাৎ, ভাষান্তরের কারণে মূল লেখার সৌন্দর্য হারিয়ে যাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনূদিত লেখায় অনুবাদককে নতুন করে যথেষ্ট সৌন্দর্য যুক্ত করতে হবে।

ট্রান্সক্রিয়েশন
কখনো এমন হতে পারে- কোনো একটি লেখার পুরো অংশ বা সব ধারণা অনুবাদে রাখার দরকার হলো না। অনুবাদের সময় মূল লেখা পড়ে সেটি থেকে কিছু তথ্য বা ধারণা নিয়ে এর সঙ্গে বাড়তি তথ্য ও ধারণা যোগ করা হলো। এটি হলো ট্রান্সক্রিয়েশন (transcreation)।

ধরা যাক, ক্ষমতা প্রসঙ্গে দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)-এর লেখা তরুণ পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হবে। আক্ষরিক বা ভাবানুবাদের গণ্ডির বাইরে গিয়ে এখানে ট্রান্সক্রিয়েশন করা যেতে পারে। যেমন : ক্ষমতা প্রসঙ্গে রাসেলের মূল বক্তব্য বা গুরুত্বপূর্ণ ভাবনাগুলো অনুবাদের পাশাপাশি বিষয়টিকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বোঝানোর সুবিধার্থে এ বিষয়ে অন্য ব্যক্তিদের ভাবনাও সেখানে যুক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া, উদ্দিষ্ট পাঠকদের বয়স, জানা-বোঝার পরিধি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাদের পরিচিত উদাহরণ যুক্ত করে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যায়। নতুন এ লেখায় অনুবাদক প্রায়ই নিজের ভাবনাও যুক্ত করেন। ফলে, কেবল অনুবাদের বদলে এটি আসলে নতুন একটি লেখা হয়ে ওঠে।

এসব কারণে স্বাভাবিকভাবেই ট্রান্সক্রিয়েশনের ক্ষেত্রে মূল লেখার প্রেক্ষাপট (context) বদলে যায়। যাদের জন্যে অনুবাদ করা হচ্ছে, সাধারণত নতুন সেই পাঠকদের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপট এতে যুক্ত হয়।

ইংরেজি translation ও creation - এ দুটি শব্দকে এক করে transcreation শব্দটি তৈরি হয়েছে। এর কারণ হলো, এতে translation বা অনুবাদ এবং creation অর্থাৎ অনুবাদকের নিজস্ব কিছু সৃষ্টি - দুটোই থাকে।

বিশেষ করে সংবাদপত্রের ফিচার তৈরিতে ট্রান্সক্রিয়েশনের চল বেশ বাড়ছে।

ভালো অনুবাদক হওয়ার জন্য করণীয়

অনুবাদ একটি সৃজনশীল কর্ম। আর, সৃষ্টিশীল কোনো কাজেরই ধরা-বাঁধা কোনো সূত্র থাকে না। এরপরও, কিছু বিষয় থাকে, যা এ ধরনের কাজের দক্ষতা বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

অনুবাদের দক্ষতা অর্জন করতে হলে এমন কিছু বিষয় অনুসরণ করা যেতে পারে :

- ভালো অনুবাদকর্ম পড়ার অভ্যাস করা
- ভাষাগত (উৎস ও লক্ষ্য ভাষা) দক্ষতা অর্জন করা
- অনুবাদ নিয়মিত অনুশীলন করা
- ভালো অনুবাদ করতে জানেন বা অনুবাদের ব্যাপারে ভালো বোঝেন - এমন কারো সঙ্গে নিজের করা অনুবাদ নিয়ে আলোচনা করা
- কোন লেখাকে কী ধরনের অনুবাদ করতে হবে বা করলে ভালো হবে - এ বিচারবোধ তৈরির চেষ্টা করা
- একই লেখার একাধিক ব্যক্তির করা অনুবাদ পড়ে তুলনা করে দেখা এবং নিজেই ভালো-মন্দ বিচার করা

সবচেয়ে বড় কথা, ভালো মানের অনুবাদকর্ম পড়া আর নিজে হাতে-কলমে নিয়মিত চর্চাই হলো ভালো অনুবাদের সক্ষমতা অর্জনের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল।